এগুলো শত্রুতা-হিংসা-জেলাসি: মৃণাল হক
১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:৪৪
।। সৈকত ভৌমিক, নিউজরুম এডিটর ।।
ঢাকা: শিল্পীসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাধারণ মানুষও যখন তার নির্মিত বিভিন্ন ভাস্কর্য নিয়ে সমালোচনায় মুখর তখন মৃণাল হক বলছেন, এর মূলে রয়েছে তার শত্রুতা, হিংসা। তার ভাষ্য, তারই ক্লাসমেট বা বন্ধুদের কেউ কেউ তাকে পচানোর জন্য এগুলো করছে।
মৃণাল হক বলেন, ‘এগুলো শত্রুতা, হিংসা, জেলাসি; আর কিছু না। তারা নিজেরা কাজ করবে না, কেউ করলেও তাদের সহ্য হয় না। আমি আইল্যান্ড লিজ নিয়ে ঢাকা শহরে নিজের উদ্যোগে ভাস্কর্য বানিয়েছি। আমি সেলিব্রেটি গ্যালারি বানিয়েছি। তাই আমার নিন্দুকেরা এটা মানতে পারছে না।’
মৃণাল হকের ভাস্কর্য, বিশেষ করে লন্ডনের মাদাম তুসো জাদুঘরের আদলে বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের ভাস্কর্য নিয়ে গড়ে তোলা সেলিব্রেটি গ্যালারি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। বলা হচ্ছে, এই গ্যালারিতে যেসব ব্যক্তিত্বের ভাস্কর্য স্থান পেয়েছে, সেগুলো ‘বিকৃত চেহারা’র। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মৃণাল হক বলছেন, এসব সমালোচনার একটাই লক্ষ্য, তাকে হেয় করা।
এর আগে, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে গ্রিক দেবী থেমিসের অনুকরণে ভাস্কর্য স্থাপন করে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন ভাস্কর মৃণাল হক। এবারে ‘সেলিব্রেটি গ্যালারি’ ফের তৈরি করেছে সমালোচনা। রাজধানীর গুলশানে স্থাপিত এই জাদুঘরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ফাঁসিতে প্রাণ দেওয়া ক্ষুদিরাম, নোবেলজয়ী মাদার তেরেসা, বলিউড সেলিব্রেটি শাহরুখ খান, আর্জেন্টাইন ফুটবলার লিওনেল মেসিসহ আরও অনেকের প্রতিকৃতিই স্থান পেয়েছে। সমালোচকরা বলছেন, এসব প্রতিকৃতি দেখে বোঝা মুশকিল এটি কার প্রতিকৃতি। বিশেষ করে প্রতিকৃতিগুলো সেলিব্রেটিদের হওয়ায় তাদের ‘বিকৃত’ অবয়ব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এসব আলোচনা-সমালোচনাকে কিভাবে দেখেন— জানতে চাইলে মৃণাল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘মানুষের মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য, ঢাকা শহরের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য আমি কাজ করে যাচ্ছি। এ দেশে যেখানে ভাষ্কর্য বা ম্যুরাল শিল্পকর্মের কোনো চিহ্ন নেই বলে মানুষের যে ভুল ধারণা আছে, আমি সেটা বদলাতে নিজের পয়সা দিয়ে নিজের উদ্যোগে ঢাকা শহরের রাস্তার মোড়ে মোড়ে ২০-২৫টি ভাস্কর্য বানিয়েছি। আমি আমেরিকায় থেকে যে পয়সা উপার্জন করেছিলাম, সেই পয়সা দিয়ে এগুলো বানানো। সবাই ভাবে আমি সরকারি কাজ করি। কিন্তু এগুলো কোনো সরকারি কাজ না।’
যারা মৃণাল হকের ভাস্কর্য নিয়ে সমালোচনা করছেন, তাদের বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দেখুন, এই সমালোচনা যারা করে, তাদের আমি চিনি। এগুলো আমার ক্লাসমেট, আমারই শত্রু। আমারই ফ্রেন্ড সার্কেলের কেউ, আবার আমার আর্টিস্ট ফ্রেন্ড সার্কেলের কেউ। তারা এটা ইচ্ছা করেই করে, যেন মৃণাল হককে পচানো যায়।’
তাকে সহ্য করতে পারেন না বলে শিল্পীরাও তার সমালোচনা করেন বলে মনে করেন মৃণাল হক। তিনি বলেন, ‘তাদের আসলে এটা সহ্য হয় না যে আমাকে কেউ ডেকে কাজ করাচ্ছে, কাজ দিচ্ছে। আর এগুলো নিয়েই তাদের মাথা ব্যাথা। বিমানবন্দরে যখন আমার তৈরি ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হলো তখন আর্ট কলেজের (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) ডিন বলেছিলেন, একটা অপশিল্পকর্ম চোখের সামনে থেকে চলে গেল। কোর্ট চত্বরে (সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ) আমার বানানো ভাস্কর্য যখন ভেঙে দেওয়া হলো তখন সেই তারাই বললো, এমন স্থানে কী ভাস্কর্য হবে তা মৃণাল হক কিভাবে সিদ্ধান্ত নেয়? এটার সিদ্ধান্ত নেব আমরা চারুকলা বিভাগের শিক্ষকরা বা কর্তৃপক্ষ। আসলে এসব কথাবার্তা বা মন্তব্যে আমার কিছু যায় আসে না। আমি কাজ করবই।’
এর মধ্যে সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ভাস্কর্য নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মৃণাল হকের বক্তব্য, ‘এটা কেউ বিকৃৎ মানসিকতা নিয়ে নিচ থেকে ছবি তুলেছে, যেন সমালোচনা করার সুযোগ তৈরি হয়। আমি ফেসবুকে এই ভাস্কর্যের একটি সরাসরি ছবি দেবো, যেটা এই ভুল ধারণা ভেঙে দেবে।’ একজনের অনুরোধে কোনো ধরনের ফান্ডিং ছাড়াই নিজের পয়সায় তিনি ওই ভাস্কর্য তৈরি করেছিলেন বলেও জানান।
মৃণাল হক জানান, গুলশানের ‘সেলিব্রেটি গ্যালারি’ সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে করা। সাবেক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী প্রকৌশলী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ম্যুরালও মন্ত্রীর আহ্বানেই করে দিয়েছিলেন। এমন যেকোনো ব্যক্তিই তাকে কাজের প্রস্তাব দিলে তা ফিরিয়ে দেন না বলেও জানান।
এদিকে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও একটি বিশালাকার ভাস্কর্য নির্মাণের কথা শোনা যাচ্ছে, যেটি হবে বাংলাদেশে তার সবচেয়ে বড় প্রতিকৃতি। এই ভাস্কর্যও মৃণাল হক নির্মাণ করবেন বলেই জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। যারা যোগাযোগ করেছে, তাদের ফান্ডে একটাকাও নেই। বাজেট বা ফান্ড সংগ্রহ হয়ে গেলে কাজ হতেও আরে। তারা বলেছে কেউ সিমেন্ট-বালু-রড দেবে, কেউ বলেছে পাইলিং করে দেবে। তেমন হলে আমি আমার পক্ষ থেকে বিনামূল্যে পরিশ্রম করে দেবো— কথা হয়েছে এটুকুই।
মৃণাল হকের ভাস্কর্য ও তার বক্তব্য প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হয় কবি, চারুশিল্পী ও শিল্প সমালোচক রিঙকু অনিমিখের কাছে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘তার সব কাজ নিয়ে কথা বলব না, তবে তার কিছু কিছু কাজ নিয়ে আমার সমালোচনা আছে। ঢাকা শহরে তার যে কাজগুলো আছে, সেগুলো তিনি নিজে করে থাকলে অনেক কিছুই খুব বাজেভাবে উপস্থাপন করেছেন।’
অনিমিখ বলেন, ‘মৃত সন্তানকে মা ধরে আছে— পরীবাগে এমন একটি ভাস্কর্য আছে তার। সন্তানের লাশ নিয়ে কোনো মায়ের এমন স্বাভাবিক এক্সপ্রেশন হতে পারে না। মৃত সন্তানকে যখন মা ধরে থাকে, তখন সেই মা কখনও এত সোজাভাবে দাঁড়াতে পারেন না। সেই হিসাব তিনি (মৃণাল হক) করেননি। কেন করেননি, সেটা নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে। একজন চারুশিল্পী হিসেবে আমি এই প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে পারি না। এছাড়াও আপনারা যদি জেনে থাকেন, রবীন্দ্রনাথের একটি ভাষ্কর্য করেছেন সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুরে। সেটিও মৃৎশিল্পী ও রবীন্দ্রনাথ ভক্তদের সমালোচনার মুখে পড়েছে। রবীন্দ্রনাথের ঠাকুর বাঙালির আবেগের জায়গা। তাকে এভাবে ভুলভাবে উপস্থাপন করা আমি অন্তত ব্যক্তিগতভাবে মানতে পারি না।’
বাংলাদেশে কোনো শিল্পী এমন করেন না বলে মৃণাল হক ব্যক্তি উদ্যোগে এসব কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রিঙকু অনিমিখ বলেন, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। নিজের টাকা দিয়ে করলে স্পন্সর আসে কিভাবে? রুপসী বাংলার সামনে যে ঘোড়ার গাড়ি, সেটা তো একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টাকা নিয়ে করা। তাহলে নিজের টাকা দিয়ে কিভাবে হলো? তাছাড়া তিনি ব্যক্তিগতভাবেও যদি করে থাকেন, এসব ভাস্কর্য তো ব্যক্তিগত নয়। সর্বসাধারণের জন্য এমন কিছু কেন বানানো হবে যাতে মানুষ আঘাতপ্রাপ্ত হয়? এটা তো আর এমন না যে তিনি নিজের ঘরে ভাস্কর্য স্থাপন করছেন। ভুল জিনিস স্থাপন করা কখনও কাজের কিছু হতে পারে না।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে চারুশিল্পী সংসদের সাধারণ সম্পাদক কামাল পাশা চৌধুরী মৃণাল হককে একা দায়ী করতে রাজি নন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘দায়িত্ব নিয়েই বলছি, দেশের বেশিরভাগ শীর্ষ আমলার কোনো শিল্পজ্ঞান নেই। দেশের বেশিরভাগ মন্ত্রীর কোনো শিল্পজ্ঞান নেই। এ কারণেই মৃণাল হক শিল্পী। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অবস্থার আরও অবনতিও স্বাভাবিক।’
সারাবাংলা/এসবি/টিআর