বড় দুর্নীতিতে নজর নেই, তুচ্ছ বিষয়ে ব্যস্ত দুদক: হাইকোর্ট
৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৮:৫৮
।। সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: অপরাধের বড় বড় সেক্টরকে না ধরে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ব্যস্ত হয়ে পড়েছে জানিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট।
বৃহস্পতিবার (৭ ফেব্রুয়ারি) কোচিং বাণিজ্য বন্ধে সরকারের করা নীতিমালার বৈধতা প্রশ্নে জারি করা রুল খারিজ করে রায় দেন হাইকোর্ট । এই রায় ঘোষণার আগে রুল শুনানির সময় আদালত বলেন, ‘ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়ে যাচ্ছে, সেখানে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা স্কুলে যাচ্ছেন কি যাচ্ছেন না, তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে দুদক।’
পরে রুল শুনানি শেষে সরকারি -বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা নীতিমালার বাইরে গিয়ে শিক্ষকরা কোচিং করাতে পারবেন না বলে রায় দেন বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ।
রায়ের পর্যবেক্ষণে তারা বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন জায়গায় দুর্নীতি হচ্ছে সে বিষয়ে দুদকের চোখ দেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে বড় বড় দুর্নীতির দিকে গুরুত্ব বিবেচনায় নজর দিতে হবে। বড় দুর্নীতিতে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চাইতে অনেক বেশি অপরাধ বা দুর্নীতি আছে ব্যাংকিং সেক্টর, কাস্টমস, পোর্ট, ল্যান্ড এসব জায়গায়। সেগুলোতে গুরুত্ব না দিয়ে সিলি বিষয়ে গুরুত্ব দিলে দুদকের জুনিয়র অফিসাররা কি শিখবে? তারাও তো বড় বড় দুর্নীতির দিকে নজর না দিয়ে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে পড়ে থাকবে।’
আদালত আরও বলেন, ‘কোচিং বাণিজ্য অনুসন্ধান এবং তদন্ত করার এখতিয়ার দুদকের আছে। তবে দুর্নীতি দমন কমিশনের একটি অগ্রধিকার তালিকা থাকতে হবে, কোনো বিষয়ে কমিশন তদন্ত বা অনুসন্ধান করবে। কেননা দুদকের পর্যাপ্ত জনবল সংকট রয়েছে।’
পরে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেসুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘কোর্ট পর্যবেক্ষণে দুদকের বিষয়ে একটু বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। আদালত বলেছেন, অন্যান্য সেক্টরের দুর্নীতির যে বিষয়গুলো আসছে, দুদককে অবশ্যই সে বিষয়গুলো অগ্রাধিকার দিতে হবে। সরকারি প্রাইমারী স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে দুদক পারে। কিন্তু সেগুলো বটমে থাকা উচিত।’
আরও পড়ুন: নীতিমালার বাইরে কোচিং নয়: হাইকোর্ট
বৃহস্পতিবার আদালতে এই শুনানিতে দুুদকের পক্ষে আইনজীবী খুরশীদ আলম খান ও রিটকারীর পক্ষে ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম অংশ নেন। এ মামলায় অ্যামিকাস কিউরি ছিলেন ফিদা এম কামাল।
গতবছর কোচিং বাণিজ্যের অভিযোগে মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না সে জন্য কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় সরকার । দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে এ নোটিশ দেয় সরকার। এসব নোটিশ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালা-২০১২ নিয়ে শিক্ষকরা হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন।
গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি ওই চিঠির কার্যকারিতা চার মাসের জন্য স্থগিত কররার পাশাপাশি রুল জারি করেন আদালত।
ওই আদেশের বিরুদ্ধে দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করার অনুমতি চেয়ে লিভ টু আপিল দায়ের করেন। গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি ওই আবেদনের ওপর শুনানি শেষে গত ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফের নেতৃত্বাধীন হাই কোর্ট বেঞ্চকে এ রুলের নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ।
পরে আদালত এ রুল নিষ্পত্তির জন্য সাবেক দুই অ্যাটর্নি জেনারেল হাসান আরিফ ও ফিদা এম কামালকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দেন।
এর আগে, ২০১২ সালের ২০ জুন কোচিং কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা-২০১২ জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রণীত ওই নীতিমালায় বলা হয়, স্কুল চলাকালীন কোনো শিক্ষক কোচিং করাতে পারবেন না। তবে স্কুলের আগে বা পরের কোনো সময়ে অভিভাবকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠান প্রধান অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে উপজেলা পর্যায়ে ১৫০ টাকা, জেলা শহরে ২০০ টাকা ও মেট্রোপলিটন এলাকায় ৩০০ টাকা এবং যেকোনো ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১২শ টাকা পর্যন্ত ফি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। একটি বিষয়ে মাসে সর্বনিম্ন ১২টি ক্লাস অনুষ্ঠিত হতে হবে এবং কোনো ক্লাসে ৪০ জনের বেশি শিক্ষার্থী থাকবে না।
নীতিমালায় আরও বলা হয়, কোনো শিক্ষক তার নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবেন না। তবে প্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতি নিয়ে সর্বোচ্চ ১০ জনের ব্যাচে শিক্ষার্থী পড়ানো যাবে। সে ক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠান প্রধানকে লিখিতভাবে শিক্ষার্থীদের তালিকা জানাতে হবে। শুধু তাই নয়, কোনো শিক্ষক বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কোনো কোচিং সেন্টারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত থাকতে পারবেন না এবং কোনো কোচিং সেন্টারের মালিক হতে পারবেন না।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটিকেও কোচিং বাণিজ্য রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে বলা হয় ওই নীতিমালায়। পাশাপাশি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বিভাগী কমিশনার, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে কোচিং বাণিজ্য বন্ধে মনিটরিং কমিটি গঠনেরও নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এসব নীতিমালা না মানলে শিক্ষকের এমপিও স্থগিত, বাতিল, বেতন-ভাতা স্থগিত, বেতনের ধাপ অবনমতিকরণ, সাময়িক বা চূড়ান্ত বরখাস্ত বা নন-এমপিও শিক্ষকদের ক্ষেত্রে বেতন-ভাতা স্থগিত, বেতনের ধাপ অবনমতিকরণ, সাময়িক বা চূড়ান্ত বরখাস্তের শাস্তির বিধান রাখা হয় ওই নীতিমালায়। আর নীতিমালা ভঙ্গকারী শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থা না নিলে পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়াসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অধিভুক্তি বাতিল করার এখতিয়ারও রাখা হয়।
সারাবাংলা/এজেডকে/জেডএফ