বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম, রাষ্ট্রপতির বৈঠক ফেব্রুয়ারিতে
১৮ জানুয়ারি ২০১৮ ২৩:১৭
হাসান আজাদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগের পরও কিছুই করতে পারছে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। তা ছাড়া বিভিন্ন অভিযোগের কাছে নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
এই প্রেক্ষিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর সুরাহা করতে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন সংস্থাটি।
এই অভিযোগের পর সকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের সঙ্গে বসার আগ্রহের কথা জানান প্রেসিডেন্ট। আগামী ১ ও ৫ ফেব্রুয়ারি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের সঙ্গে আলাদাভাবে রাষ্ট্রপতির বসার কথা রয়েছে বলে জানিয়েছেন, ইউজিসির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা।
ওই কর্মকর্তা জানান, ইউজিসির চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল মান্নান গত ১১ই ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ২০১৬ সালের ৪৩তম বার্ষিক প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে এবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি আলাদাভাবে সংযোজন করা হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে ইউজিসির চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল মান্নান সারাবাংলাকে বলেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি সব ভিসিদের সঙ্গে বসার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
এ ছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের বক্তব্য তো বার্ষিক প্রতিবেদনে লিখিত আকারে বলেছি। নতুন করে কিছু বলার নেই। সুপারিশের পরও অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে না পারায় প্রতিকূল পরিস্থিতির বিষয়টি মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করেছি।
প্রতিবেদনে, অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগ দেওয়া ভিসি, প্রো-ভিসি, কোষাধ্যক্ষ না থাকার, আর্থিক কেলেঙ্কারির মহোৎসব, নিয়মিত অডিট না দেয়া, দিলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৈরি করে দেওয়া প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ফাইনান্স রিপোর্ট (পিইউএফআর) অনুসরণ না করা, নির্ধারিত ২৩ বছর পরও স্থায়ী ক্যাম্পাসের না যাওয়া, নিয়মিত সমাবর্তন না করা, অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় এক টাকাও বরাদ্দ না রাখা, সনদ বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ করা হয়েছে।
বার্ষিক প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০০৬ সালে ৯৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ৫টি বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগ দেয়া ভিসি, প্রো-ভিসি এবং কোষাধ্যক্ষ এ তিনটি পদই পূরণ করেছে। এরমধ্যে ভিসি আছে মাত্র ৪৪টি, প্রো-ভিসি আছে ১৪টি এবং কোষাধ্যক্ষ আছে ৩৪টিতে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য এ তিনটি পদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও টনক নড়ছে না এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের।
এমনকি ভারপ্রাপ্ত ভিসির স্বাক্ষরেও সনদ দেয়া হচ্ছে। সমাবর্তন করার জন্য নিয়মিত ভিসি থাকার কথা থাকলেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ম্যানেজ করে ভিসি ছাড়াই সমাবর্তন করে নিচ্ছেন।
ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, ইসলামি ইউনিভার্সিটিসহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে লিখিত আপত্তি দেয় ইউজিসি। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ম্যানেজ করে তারা সমাবর্তন করেছে ফেলেছে।
আর্থিক অসঙ্গতির বিষয়টি জোরালোভাবে আপত্তি তুলে ইউজিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা ৮৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আর্থিক অডিট রিপোর্ট জমা দিয়েছে মাত্র ২৫টি। এই ২৫টির একটিও অডিট ফরম পিইউএফআর অনুসরণ করেনি। ২০১৭ সালে অডিট রিপোর্ট জমা দিয়েছে মাত্র ২৯টি। তাদের কেউ পিইউএফআর ফরম অনুসরণ করেনি।
২০১৫ সালে অডিট রিপোর্ট দাখিলযোগ্য ৮০টির মাত্র ৩১টি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের আর্থিক প্রতিবেদন ইউজিসিতে জমা দেয়। এরমধ্যে মাত্র ৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুসরণ করে। অডিট রিপোর্টে আর্থিক অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আসছে না বলে অভিযোগ ইউজিসির। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত সিএ ফার্মকে দিয়ে না করিয়ে নিজেদের পছন্দের ফার্মকে দিয়ে অডিট করানোর কারণে আর্থিক অনিয়মগুলো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
ইউজিসি বলছে, যারা অডিট রিপোর্ট দেবে না, তাদের বিরুদ্ধে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী ৪৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী, পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অর্থ কমিটির নিয়মিত কোন সভায় না হওয়া, কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ না করা, কোষাধ্যক্ষ থাকলেও মালিকপক্ষের আজ্ঞাবহ করে রেখে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা অর্থ আত্মসাৎ করছে বিওটির সদস্যরা।
অভিযোগ রয়েছে, আইনের তোয়াক্কা না করে বিওটি সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিলের অর্থ আত্মসাৎ করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ভুয়া কাগজপত্র ও স্বাক্ষর জাল করে সংরক্ষিত তহবিলের (ফান্ড) বিপরীতে ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন।
প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আট ক্যাটিগরিতে মোট ১২ জন সিন্ডিকেট সদস্য মিটিংয় নামে সাড়ে চার লাখ টাকা পর্যন্ত সম্মানী নিচ্ছেন। প্রমোদ ভ্রমণের জন্য অনেক সময় বিদেশেও সিন্ডিকেট মিটিং করে। বিভিন্ন বৈঠকের নামে বিওটির সদস্যরা বছরে সম্মানীর নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। কেনা-কাটায়ও চলছে অনিয়ম, দুর্নীতি। নানা কৌশলে কোটি কোটি টাকা লুটপাটের চিত্র ইউজিসি’র তদন্ত রিপোর্টেও উঠে এসেছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে হন্তান্তর করা প্রতিবদেনে এ ধরনের অভিযোগের কথা বলেছে ইউজিসি। এতে সনদ বিক্রি, সিন্ডিকেটের নামে অর্থ আত্মসাৎ, গবেষণাখাতসহ ১৬ ধরনের আর্থিক দুর্নীতির তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। আয়-ব্যয়ের হিসাব না পাঠানো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকা পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউজিসি।
স্থায়ী ক্যাম্পাস নিয়ে ইউজিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ৯৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৫২টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকাল ৫ থেকে ২৩ বছর হওয়ার পরও স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাননি। বারবার সময় দেয়ার পরও তারা স্থায়ী ক্যাম্পাসে না গিয়ে নতুন নতুন অজুহাত দেখান।
স্থায়ী ক্যাম্পাসের না যাওয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুতে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেওয়ার পরও তা বাস্তবায়ন করতে পারছে না ইউজিসি। এজন্য প্রধান বাধা শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক সমিতি মন্ত্রণালয়কে নানা ধরনের চাপ সৃষ্টি করে। এতে কোন সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন করতে পারছে না ইউজিসি। তবে সব বিশ্ববিদ্যালয়ই স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য জমি কিনেছে এমন তথ্য ইউজিসির কাছে রয়েছে।
সব শেষ তথ্য অনুযায়ী মাত্র ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয় ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করে স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। মাত্র তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী সনদ অর্জন করেছে। এরমধ্যে সিটি ইউনিভার্সিটি ইউজিসির শর্ত সাপেক্ষে এ সনদ অর্জন করলেও এখন আইন কানুনের মানতে চায় বলে অভিযোগ রয়েছে ইউজিসির কাছে। ২০১৬ সাল থেকে ৯৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এরমধ্যে গবেষণা খাতে ২৯টি এক পয়সাও খরচ করেনি।
এ ছাড়াও অধিকাংশরা কোনো প্রকাশনা বা সাময়িকী প্রকাশ করেনি। বাকিরা নামে মাত্র গবেষণা খাতে বরাদ্দ রেখে দায় সেরেছে।
সারাবাংলা/এইচএ/এমআই