হাইকোর্টের আদেশের পর ৯ বছরেও নির্মাণ হয়নি ‘ভাষা শহীদ জাদুঘর’
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:৩৮
।। সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: হাইকোর্টের আদেশের নয় বছরে অতিক্রান্ত হলেও নির্মিত হয়নি ভাষা শহীদদের স্মৃতি রক্ষায় ‘ভাষা শহীদ স্মৃতি জাদুঘর’। ২০১০ সালে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের পাশে জাদুঘরটি নির্মাণের আদেশ দেন হাইকোর্ট।
জাদুঘর নির্মাণের পাশাপাশি সেখানে সার্বক্ষণিক গাইড নিয়োগ, ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস সন্নিবেশ করে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় ব্রুশিয়ার তৈরিসহ আট দফা নির্দেশনাও ছিল ওই আদেশে। কিন্তু এর দু’য়েকটি ছাড়া বাকিগুলো বাস্তবায়ন হয়নি এতো বছরে।
বার বার সময় নিয়েও ‘ভাষা শহীদ স্মৃতি জাদুঘর’ নির্মাণ না করায় ফের সংস্কৃতি সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ দায়ের করা হবে বলে জানিয়েছেন এ বিষয়ে রিটকারী আইনজীবী।
প্রসঙ্গত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মর্যাদা রক্ষায় ২০১০ সালে আট দফা নির্দেশনা সম্বলিত রায় দেন হাইকোর্ট। এরপর দীর্ঘ আট বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি সেই আট দফা।
নেই কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, শহীদ মিনারের পাশে আদালতের নির্দেশনার আলোকে কোন জাদুঘর এখনো স্থাপন করা হয়নি। বিদেশি দর্শনার্থীদের জন্য নেই কোন তথ্যবহুল নির্দেশনা। দূর থেকে আসা সাধারণ দর্শনার্থীসহ কারো জন্য নেই কোনো শৌচাগার।
শহীদ মিনারে প্রবেশের ক্ষেত্রে জুতা নিয়ে কতটুকু যাওয়া যাবে— তার জন্য নেই কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা। যদিও হাইকোর্টের আদেশে বলা হয়েছে, মূলবেদিতে জুতা নিয়ে ওঠা যাবে না। কিন্তু মূল বেদির সীমানা কোন সিঁড়ি থেকে শুরু তার দিক নির্দেশনা দেওয়া নাই। যার ফলে অনেকেই জুতা নিয়েই শহীদ মিনারে প্রবেশ করছে।
এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছে স্লোগান নামে একটি সংগঠন। এ সংগঠনের দাবি শহীদ মিনার চত্বরে প্রবেশের পর প্রথম সিড়ি থেকেই কেউ জুতা নিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। কিন্তু তাদের এ দাবি অনেকেই মানছেন না। তাছাড়া জুতা রেখে শহীদ মিনারের প্রবেশের ক্ষেত্রে জুতা সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থাও নেই। এ বিষয়টি সমাধানের জন্য তারা সরকারের কাছে বার বার দাবি জানিয়ে আসছে।
এ প্রসঙ্গে স্লোগানের সমন্বয়ক আসাদুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, হাইকোর্টের আদেশ সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন তো হয়নি বরং আদালতের আদেশ মোতাবেক মূলবেদিতে জুতা নিয়ে প্রবেশ করা যাবে না, সেটিও অনেকে মানছেন না। তারা মনে করেন মূলবেদি মানে মিনারের পাশের কয়েক ধাপ সিঁড়ি এবং লাল চিহ্নিত অংশ টুকু। তারা ওই পর্যন্ত জুতা নিয়ে প্রবেশ করে। কিন্তু আমাদের বক্তব্য হচ্ছে শহীদ মিনার চত্বরে প্রবেশের পর যেখান থেকে সিঁড়ির প্রথম ধাপ, সেখানে জুতা রেখেই সবাই প্রবেশ করুক। এ নিয়ে আমরা দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন করে আসছি। প্রশাসন আমাদের দাবির প্রতি কোনো ভ্রূক্ষেপই করছে না।
সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য কোনো বিশ্রামাগার ও শৌচাগার নেই
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা রিয়াদ হাসান সারাবাংলাকে জানান, শুধু ফেব্রুয়ারি নয়, সারাবছরই দেখাশোনা ও পরিষ্কার করে রাখা হয়। তবে এটা ঠিক যে, সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য কোনো বিশ্রামাগার ও শৌচাগার নেই। অনেক সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ শহীদ মিনার দেখতে আসে। কিন্তু প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে তাদেরকে দূরে যেতে হয়। তাছাড়া পুরো চত্বরটি খোলা থাকায় অনেক সময় ভবঘুরেরা আসে। ঝড় বৃষ্টির দিনে দাঁড়ানোর কোনো জায়গা না থাকায় বিব্রত হয় দর্শনার্থীরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এ মামলার সংশ্লিষ্ট আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ সারাবাংলাকে বলেন, শহীদ মিনারের মর্যাদা রক্ষা করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যেটুকু দায়িত্ব আছে, সেটা তারা কেন পালন করছে না, তা বোধগম্য হচ্ছে না। আদালতের রায়কে অবজ্ঞা করার চেষ্টা করলে আবারও আদালতে অবমাননার মামলা করা হবে।
শহীদ মিনারের পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষা এবং জাদুঘর স্থাপনের নির্দেশনা চেয়ে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) হাইকোর্টে রিট দায়ের করে। ওই রিটের শুনানি শেষে ২০১০ সালের ২৫ আগস্ট হাইকোর্ট আদেশ দেন।
আট দফা নির্দেশনা
আদেশে শহীদ মিনারের পাশে গ্রন্থাগারসহ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা এবং জাদুঘরে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সমৃদ্ধ তথ্যপঞ্জিকা রাখা, ভাষা সংগ্রামীদের প্রকৃত তালিকা তৈরি ও প্রকাশ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ ও মর্যাদা রক্ষাসহ আটটি নির্দেশনা দেওয়া হয়।
নির্দেশনাগুলো হচ্ছে- জীবিত ভাষা সৈনিকদের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো এবং সব রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান; কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নির্ধারিত এলাকায় সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা করা ও অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া; শহীদ মিনারের মূল বেদীতে কোনো ধরনের মিটিং, মিছিল, পদচারণা, আমরণ অনশন বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তবে ফেব্রুয়ারি মাসে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চলতে এবং ভাষা সৈনিকসহ জাতীয় ব্যক্তিত্বদের মরদেহে সর্বস্তরের জনগণের সম্মান প্রদর্শনের জন্য শহীদ মিনারের মূল বেদী ব্যবহার বা বিশেষ দিনে ফুল দেওয়া এবং বেদির পাদদেশে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলাতে কোনো নিষেধাজ্ঞা না রাখা; ভাষা শহীদদের সবাইকে মরণোত্তর জাতীয় পদক এবং জীবিতদের জাতীয় পদক দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া; জীবিত ভাষা সৈনিকদের কেউ যদি সরকারের কাছে আবেদন করে, তাহলে তাদের ‘যথাযথ আর্থিক সাহায্য এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা’ করা; সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব ভাষা সৈনিকদের প্রকৃত তালিকা তৈরির জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে একটি এবং জেলায় জেলায় জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে কমিটি গঠনের ব্যবস্থা করবেন। কমিটির সদস্য হবেন ভাষা সৈনিক, কবি, সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ ও মুক্তিযোদ্ধারা; বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ ও সংরক্ষণ করা।
এ নির্দেশনা পর কয়েক দফা সময় নিয়েও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ওই রায় পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না করায় ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংস্কৃতি ও পূর্ত সচিবের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ করেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ।
ওইসময় সংস্কৃতি ও পূর্ত সচিবকে তলব করেছিলেন হাইকোর্ট। পরে ওই বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি তারা আদালতে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দেন। তখন আদালত তাদের ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে গ্রন্থাগারসহ ‘ভাষা শহীদ জাদুঘর স্থাপন এবং ভাষা সংগ্রামীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নসহ রায় বাস্তবায়নে নির্দেশ দেন।
এরপর ২০১৭ সালে আবারও আদালত অবমাননার অভিযোগে মামলা করলে রায়ের আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে বলে জানায়। তারপর আরও দুই বছর কেটে যায়। আজও পূর্ণাঙ্গ রায় বাস্তবায়ন করা হয়নি।
সারাবাংলা/এজেডকে/আরএ