‘সব বডি পুড়ে কয়লা, ভাইয়ের লাশটাই খুঁজে পাচ্ছি না’
২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৪:১২
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢামেক থেকে: ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গসহ সবখানেই উদভ্রান্ত নারী-পুরুষের ভিড়। একেকজনের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, তাদের রাত কেটেছে নিদ্রাহীন। হয়তো আগের দিন বিকেল বা সন্ধ্যাতেই শেষবারের মতো খেয়েছেন কিছু। উদভ্রান্ত অবস্থাতেই কখনও ছুটছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে, কখনও হাসপাতালের জরুরি মর্গে। কেউ কেউ জরুরি বিভাগের সামনে টাঙানো রোগীর তালিকায় বারবার খুঁজে দেখছেন স্বজনের নাম। মর্গে যেসব লাশ এসেছে, সেগুলো এতটাই পুড়ে গেছে যে সেখান থেকেও শনাক্ত করা সম্ভব নয় কোনটি কার লাশ।
বৃহস্পতিবার (২১ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকে এমনই দৃশ্য দেখা যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। স্বজনদের আহাজারি আর অশ্রুতে তখন সিক্ত গোটা এলাকা।
ঢামেক মর্গের সামনে সারাবাংলার কথা হয় শাহাদত হোসেনের সঙ্গে। ছোট ভাই আনোয়ার হোসেনকে (৩৫) খুঁজতে এসেছেন তিনি। জরুরি বিভাগের সামনে টাঙানো আহতদের তালিকা কিংবা মর্গে রাখা লাশ— কোথাওই তিনি পাচ্ছেন না ভাইয়ের সন্ধান।
শাহাদত হোসেন জানালেন, তাদের বাড়ি নোয়াখালী সোনাইমুড়িতে। এক ছেলে ও এক মেয়েসহ পরিবার নিয়ে আনোয়ার থাকতেন পুরান ঢাকায়। মেয়েটা অসুস্থ ছিল। বুধবার রাতে বাসায় ফেরার পথে মেয়ের জন্য ওষুধ নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল তার। বাসায় কথাও বলেন তিনি। ফোন করে বলেন, ‘মেয়েটা যেন না ঘুমায়, আমি ওষুধ আনতেছি।’ ওষুধের দোকানেই ছিলেন তিনি। সেই দোকান থেকে আর বের হতে পারেননি তিনি, সেখান থেকে বের হয়েছে তার লাশ।
আনোয়ারের স্বজনদের কাছ থেকে জানা যায়, এর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আগুনের ঘটনা। ওই সময় এমনভাবে শব্দ হচ্ছিল, যেন পটকা ফুটছে। শাহাদত বলেন, শুরুতে মনে হচ্ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে পটকা ফুটছে। এরকম হলে সাধারণত সব দোকানের শাটার আটকে দেওয়া হয়। আনোয়ার ছিল ওষুধের দোকান হায়দার মেডিকো’তে। ওই দোকানের শাটারও আটকে দেওয়া হয়। আনোয়াররা চার বন্ধু ছিল। আরও দুই কাস্টমার ছিল দোকানে। তার মধ্যে এক নারীর কোলে ছিল শিশু। বন্ধ করার শাটারের মধ্যেই সবাই পুড়ে লাশ হয়েছে।
শাহাদত বলেন, এখানে এসে মর্গে গেছি। ছোট মর্গেও গেছি (হাসপাতালের জরুরি মর্গ)। কয়েকবার গেছি। কাউকে তো চেনার উপায় নেই। সব তো পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। এখন কে যে কার বডি নিয়ে যায়, সেইটাই বুঝতে পারছি না।
অশ্রুজড়িত কণ্ঠে শাহাদত বলেন, আমি তো বড় ভাই। নিয়ম অনুযায়ী আমার লাশ ওর কবরে নামানোর কথা। আজ আমি বড় ভাই হয়ে ছোট ভাইয়ের খুঁজে বেড়াচ্ছি। সেই লাশও খুঁজে পাব কি না, তাও তো জানি না।
চকবাজারে ব্যবসা করতেন চাঁদপুরের মামুনুল ইসলাম (২৫)। তার বড় ভাইসহ বাকি সবাইই থাকেন চাঁদপুরে। রাতে আগুন লাগার পর থেকেই মামুনুলের কোনো খোঁজ পায়নি তার পরিবার, ফোন নম্বরটিও ছিল বন্ধ। মামুনুলের বড় ভাই তার বন্ধু নাজমুল হাসানকে ফোন দেন ছোট ভাইয়ের খোঁজ-খবর করার জন্য। রাত থেকেই নাজমুল রয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
নাজমুল বলেন, এখনও মামুনুলের লাশ পাইনি। আহতদের লিস্টেও ওর নাম নেই। মর্গে একটা একটা করে লাশ আসছে, ছুটে যাচ্ছি। কিন্তু বেশিরভাগ লাশই শনাক্ত করার কোনো উপায় নেই।
কেবল শাহাদত বা নাজমুলই নয়, এমন শত শত স্বজন ভিড় করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। চকবাজারের সেই ভয়াবহ আগুনে হতাহতদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন তারা। কিন্তু মর্গে থাকা বেশিরভাগ লাশই শনাক্ত করার মতো অবস্থায় না থাকায় শেষ হচ্ছে না স্বজনদের সন্ধান।
সর্বশেষ ঢাকা মেডিকেল কলেজ সূত্রে জানা গেছে, চকবাজারের ঘটনায় ৮১টি লাশ এসেছে এখানকার মর্গে। এগুলোর স্থান সংকুলান না হওয়ায় সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালসহ আশপাশের হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হবে এসব মরদেহ।
ঢামেক ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ সারাবাংলাকে জানান, ৩৫টি লাশ শনাক্ত করার অবস্থায় রয়েছে। বাকিগুলো ফিংগারপ্রিন্ট বা ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া শনাক্ত করা সম্ভব হবে না।
আরও পড়ুন-
সব পুড়ে ছাই, শুধু পড়ে ছিল ৪টি খুলি
ঢামেক-সলিমুল্লায় উদ্বিগ্ন স্বজনদের ভিড়
নিয়ন্ত্রণে চকবাজারের আগুন, ১১ লাশ উদ্ধার
চারটি ভবনে ছড়ায় আগুন, উদ্ধার হচ্ছে লাশ
সন্তানের খোঁজে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে
চকবাজারে আগুনে দগ্ধ ১৮, নিয়ন্ত্রণে ৩৩ ইউনিট
চকবাজারে একটি পাঁচতলা ভবনে আগুন, দগ্ধ ১৮
বড় হচ্ছে চকবাজারের আগুন, সরু গলি নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা
ধসে পড়তে পারে ওয়াহেদ ম্যানসন, মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৬৭
চারতলা ভবনের নিচতলায় ২৪ লাশ, দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল
‘বিকট শব্দ শোনা যায়, এরপরই জ্বলে ওঠে দাউ দাউ আগুন’
কেমিক্যালের উৎস সরাতে সমন্বিত উদ্যোগ দরকার: আইজিপি
‘আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের পূর্ণ পুনর্বাসন পর্যন্ত পাশে থাকবে সরকার’
মর্গ উপচে লাশের সারি বারান্দায়, ব্যাগের ছাইয়ে প্রিয়জনের খোঁজ
ফের বাড়ছে চকবাজারের আগুন, নিয়ন্ত্রণে যোগ দিলো বিমান বাহিনী
সারাবাংলা/জেএ/টিআর