রাতে উচ্চ শব্দের গান-বাজনা, নিয়ন্ত্রণ কার হাতে?
২১ জানুয়ারি ২০১৮ ১৫:১১
জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা : রাতের বেলায় উচ্চ শব্দে মাইক এবং গান বাজানো নিয়ে রাজধানীর মানুষের বিরক্তি যখন চরমে তখন এ শব্দদূষণকে কেন্দ্র করেই মৃত্যু হলো পুরান ঢাকার বৃদ্ধ নাজমুল হকের। নগরের বিভিন্ন এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আবাসিক এলাকার ভেতরে বিয়ে, জন্মদিন, গায়ে হলুদ, নববর্ষসহ নানা অনুষ্ঠানে রাতে উচ্চ শব্দে এলাকা কাঁপিয়ে গান বাজানো নতুন ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, উচ্চ শব্দে মাইক বাজানো রীতিমতো একটা অত্যাচার। অথচ, শব্দ দূষণ প্রতিরোধে আইন রয়েছে, আছে কর্তৃপক্ষও।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, এসব অভিযোগ শোনার জন্য কোথাও যেন কেউ নেই, কারও কাছে বিচার দেওয়ার নেই, আইনের কোনো প্রয়োগ নেই।
সাংবাদিক চৌধুরী আকবর হোসেন ফেসবুকে শব্দদূষণ নিয়ে লিখেন, নিউ ইয়ার, ওয়াজ মাহফিল, পূজা, সমাবেশ. গরুর হাট, কনসার্ট, ফোক ফেস্ট, ক্লাসিকাল মিউজিক ফেস্ট, মেলা, জন্মদিন, বিয়ে যাই হোক-আবাসিক এলাকায় উচ্চ শব্দ সৃষ্টি করে এমন আয়োজন ও কর্মকান্ড নূন্যতম রাত ১০ টার পর আইন করে নিষিদ্ধ করা হোক।
শব্দ দূষণ রোধে দেশে রয়েছে ‘শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬’। এ বিধিমালা অনুযায়ী কোনও এলাকায় শব্দের সর্বোচ্চ মানমাত্রা অতিক্রম করতে পারবে না কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান।
কিন্তু পরিবেশবাদী সংগঠন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন বলছে, রাজধানীতে শব্দ দূষণের মাত্রা দিনকে দিন কেবল বেড়েই চলেছে, কিন্তু এ জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট আইন ও বিধিবিধান। অথচ মানুষের অবহেলা ও অসচেতনাই শব্দ দূষণ বাড়িয়ে চলেছে।
শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা অনুযায়ী, কোনো আবাসিক এলাকাতে ৫৫ ডেসিবেল এবং রাতের বেলায় ৪৫ ডেসিবল শব্দের মানমাত্রা নির্ধারিত আছে। বিধিমালা অনুযায়ী, বিয়ে বা কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান, উন্মুক্ত স্থান, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, কনসার্ট, রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে শব্দের মানমাত্রা অতিক্রম করতে পারে। কিন্তু এসব অনুষ্ঠান কোনও আবাসিক এলাকাতে করা যাবে না। আবার যদি মানমাত্রা অতিক্রম করতেই হয় বা মানমাত্রা অতিক্রম করা যন্ত্রপাতি করলে সেক্ষেত্রে অবশ্যই রাত ১০টার মধ্যে এসব অনুষ্ঠান শেষ করতে হবে।
এদিকে, ঢাকাকে এশিয়ার সবচেয়ে হতাশাগ্রস্ত শহর হিসেবে তালিকায় রেখেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা জিপজেট। শব্দ দূষণ, বায়ু দূষণ, ট্রাফিক জ্যাম, মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য ও লৈঙ্গিক সমতাসহ নানা বিষয়ের পর্যবেক্ষণ করে এই তালিকা করেছে জিপজেট।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. সালাহউদ্দিন কাউসার বিপ্লব সারাবাংলাকে বলেন, আধুনিক এই সময়ে আমরা সামাজিকভাবে অন্যের অধিকারের বিষয়টি মনে রাখছি না বা মনে রাখতে চাই না- যে কারণে সমস্যাগুলো তীব্র আকার ধারণ করেছে। পাশের মানুষের সমস্যা, অসুবিধা-এ বিষয়গুলো আমাদের মনে রাখা উচিৎ। কিন্তু এখন সময় এসেছে, অন্য মানুষের সুবিধা-অসুবিধাকে আমাদের বিবেচনায় নিয়ে আসা, বলেন ডা. বিপ্লব।
রাতের বেলায় উচ্চ মাত্রায় গান বাজানোর বিষয়টা আমাদের সামাজিক বিপর্যয়ের মাত্রা বৃদ্ধির একটি ফল- বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়ের সমাজকল্যাণ গবেষণা ইনস্টিটিউট এর সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক।
তিনি বলেন, বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি সম্মানবোধের জায়গায় ঘাটতিটা খুব বেড়েছে। আমাদের পাশে যিনি আছেন, তার অধিকারে বিষয়ে, তার মনোভাবের বিষয়ে, অন্যের যে দায়িত্বশীল মনোভাব সে জায়গার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঘাটতি দেখতে পাচ্ছি।
নিজেদের আমরা যতোই মধ্যম আয়ের দেশ বলি না কেন কিন্তু আমাদের মানসিকতা আসলে সামাজিক এবং মানবিকভাবে খুব বেশি দূরে যেতে পারিনি। সামাজিক অনুষ্ঠানের নামে এক ধরণের স্বেচ্ছাচারি আচরণ করা হচ্ছে।
তৌহিদুল হক বলেন, নগরকেন্দ্রিক আচরণের অভাব অথবা নগরকেন্দ্রিক আচরণ যে আমাদের এখনও তৈরি হয়নি তার প্রমাণ মৃত্যু দিয়ে করে গেলেন নিহত নাজমুল হক।
তিনি ক্ষোভের সাথে বলেন, দেশে কেউ যখন মারা যায়, কিংবা দুর্ঘটনা ঘটে তখনই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবার টনক নড়ে, কিন্তু আগে থেকে সচেতন হলে বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব সেই জায়গাতে আমরা এখনও যাইনি।
এদিকে, পরিবেশ অধিদফতর উচ্চ শব্দের সৃষ্টিকারী ঘটনায় ব্যবস্থা নিতে পারে বলেন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের যুগ্ম সম্পাদক ও প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, পরিবেশ অধিদফতর থেকে এ বিষয়ে কখনো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। তিনি বলেন, যার যা ইচ্ছে তারা তাই করছে। কোথায় উচ্চ শব্দে গান বাজানো যাবে এবং কোথায় যাবে না সেটা বলে দেওয়া পরিবেশ অধিদফতরের কাজ, কিন্তু তারা কেন নির্বিকার তা নিয়ে প্রশ্ন রাখেন ডা. লেলিন চৌধুরী।
তবে পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক মো. জিয়াউল হক এ বিষয়ে বলেন, ‘আমাদের স্বল্প জনবল দিয়ে ঘরে ঘরে এসব রোধ করা আমাদের পক্ষে কীভাবে সম্ভব। এজন্য যে জনবল আমাদের প্রয়োজন সেটা আমাদের নেই। তবে এ ধরনের ঘটনায় প্রতিটি থানা থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা আছে।’
গত ১৮ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর আর কে মিশন রোডের একটি বাড়িতে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে উচ্চ শব্দে গান বাজানো হচ্ছিল। কিন্তু বাইপাস সার্জারি করা নাজমুল হক তার শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে গান থামানোর অনুরোধ করেন। সেদিন রাতে গান থামলেও পরদিন সকালে নাজমুল হক এবং তার ছেলের সঙ্গে ফ্ল্যাট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলতাফ হোসেনের বাগবিতণ্ডা হয়। পরে বাবা-ছেলে মারধর করা হলে হাসপাতালে নেওয়ার পথে নাজমুল হকের মৃত্যু হয়।
সারাবাংলা/জেএ/একে