Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘এখনো সমাজে মেয়েরা বৈষম্য-অত্যাচারের শিকার হচ্ছে’


৮ মার্চ ২০১৯ ০০:০০

নারী-পুরুষসহ সব ধরনের মানুষ মিলেই একটি দেশ বা একটি সমাজ গঠন করেন। কিন্তু সেই দেশ বা সমাজেই দেখা যায়, শুধুমাত্র সামাজিক বা পরিবেশের কারণে নারীর তুলনায় একজন পুরুষ অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা পান। উল্টো ঘরে-বাইরে, কর্মস্থলে, গণপরিবহনে, পথে-ঘাটে নানাভাবে হেনস্থা করা হয় একজন নারীকে। শিক্ষা বা সামাজিক মর্যাদায় এগিয়ে যেতে নারীকে পাড়ি দিয়ে হয় বহুসংকুল পথ। এরপরেও বাংলাদেশের বিস্ময়কর সাফল্যের পেছনে নারীদের ভূমিকা দিনদিন বাড়ছে। এ সব বিষয় নিয়ে সারাবাংলার মুখোমুখি হয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নিয়ন্ত্রণাধীন কর অঞ্চল-১ এর কর কমিশনার নাহার ফেরদৌসী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শেখ জাহিদুজ্জামান।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা: চাকরি জীবনের শুরুটা কেমন ছিলো?

নাহার ফেরদৌসী: আমার বাবার অনুপ্রেরণাতেই মূলত সরকারি চাকরিতে যুক্ত হওয়া। বাবা দেখতে চাইতেন, তার মেয়েরা সাবলম্বী হয়েছে। সেই জায়গা থেকেই চাকরি করার ইচ্ছার শুরু। এরপর স্বাভাবিক নিয়মে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে বিসিএস পরীক্ষা দেওয়া। একপর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়ে চাকরি শুরু করা। তবে আজকের এই পর্যায়ে আসা যে খুব পরিকল্পনামাফিক হয়েছে সেটা কিন্তু নয়। কিছু একটা করতে হবে সেটা শুরু থেকেই ছিল। বাবার চাকরি সূত্রে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পার করতে অনেক স্কুল পরিবর্তন করতে হয়েছে। এরপর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েন বিজ্ঞান অনুষদ থেকে পড়ালেখা শেষ করে ১৯৮৫ সালে সপ্তম বিসিএসএ উত্তীর্ণ হলাম। আর ১৯৮৮ সালে সহকারী কর কমিশনার হিসেবে যোগদান করলাম। সেই থেকে অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজ কর কমিশনার।

এ চলার পথ এত সহজ ছিল না। পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে। বাবাকে নানা কথা শুনতে হয়েছে, স্বামীকে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবুও দমে থাকেনি আমার পথচলা। এগিয়ে যাচ্ছি সামনে আরও এগিয়ে যেতে চাই।

সারাবাংলা: নারীরা এখনও নানাভাবে হেনস্থার স্বীকার হচ্ছেন, এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

নাহার ফেরদৌসী: এখনো একটা মেয়ে বেতন বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছে, রাস্তায় চলতে ফিরতে বা কাজের স্থানে সব জায়গায় বৈষম্য, অত্যাচারের স্বীকার হচ্ছে। স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে তার যে প্রাপ্যটা সেটা কিন্তু সে পাচ্ছে না। নারী কিন্তু তার প্রয়োজনের তাগিদে ঘরের বাইরে আসছে। কিন্তু ‍এই সমাজ, পরিবার ও শাসন ব্যবস্থার দ্বারা প্রতিনিয়ত নারীরা হেনস্থার স্বীকার হচ্ছে। এটা আসলে দুঃখজনক। এখনো অনেক কর্মস্থলে নারী যৌন হেনস্থার স্বীকার হচ্ছে। সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। কিন্তু আমাদের সমাজেরও তো অনেক দায়িত্ব রয়েছে নারীর প্রতি। সমাজ কি তার দায়িত্ব পালন করছে? পরিবার কি নারীর পূর্ণাঙ্গ অধিকার দিচ্ছে?

বিজ্ঞাপন

আমি মনে নারীর জীবন ও যুদ্ধের আর এই দুইয়ের মধ্য দিয়েই নারীকে তার পথ চলতে হচ্ছে।

সারাবাংলা: এত বাধা তবুও সফলতা অর্জন করেছেন। এর পেছনের গল্পটা জানতে চাই।

নাহার ফেরদৌসী: আমার গ্রামের বাড়ি বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ থানার গারুলিয়া ইউনিয়নে। একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে বা মেয়ে যেভাবে বেড়ে ওঠে আমিও ঠিক সেভাবেই বেড়ে উঠেছি। সফলতার পেছনে অনেক গল্প রয়েছে। তবে আমাদের সমাজে যখন একটা মেয়ে জন্ম নেয়, তখন সামাজিক প্রেক্ষাপটে সে দেখে তার চারপাশে যে নারীরা আছে তারা অধিকাংশ গৃহিনী। সেখান থেকে অন্যরকম চিন্তা ভাবনা করা আমি কারও ওপর নির্ভরশীল থাকব না। আর সেই চিন্তাধারা আমার মধ্যে কাজ করার জন্য আমার বাবার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। কেননা সেই বীজটাই তিনি আমার মাথার ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। আমরা চার বোন এক ভাই। আমাদের সবার মাথার মধ্যেই বাবা এই বীজটা বপন করে দিয়েছেন। বাবা সবসময় বলতেন তোমাকে নিজে কিছু করতে হবে, আর্থিকভাবে যখন স্বাবলম্বী হবে তখন সমাজ, সংসার, পরিবার, বাবা, মা, ভাই-বোন এমনকি তোমার জীবনসঙ্গীও তোমাকে সম্মান দেবে। অর্থাৎ আর্থিকভাবে তোমাকে স্বাবলম্বী হতে হবে। আর সেখান থেকেই কারও ওপর নির্ভরশীল না হওয়ার প্রত্যয় শুরু।

বাবার কিছু বিষয় আমাকে এই পর্যন্ত আসতে তথা চাকরি এবং সার্ভিসে বিশেষ সহায়তা করেছে সেটি হচ্ছে স্বাধীনচেতা মনোভাব। আরেকটি হলো বই পড়ার অভ্যাস। বই পড়ার অভ্যাসটা আমাকে প্রচণ্ডভাবে সহায়তা করেছে বিসিএস এ চান্স পেতে। এছাড়া বাবা মা যখন সন্তানদের উপহার হিসেবে কিছু দিতো তখন আমার বাবা সবসময় আমাদেরকে বই উপহার দিতেন। বাবার আর্থিক সামর্থ্য অত্যন্ত সীমিত ছিলো। পুরো পরিবারটাকে বাবার সামলাতে হতো। তাই আমার সফলতার পেছনে আমার বাবার ভূমিকাই প্রধান।

সারাবাংলা: আপনার দৃষ্টিতে সিভিল সার্ভিসে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে নাকি কমেছে?

নাহার ফেরদৌসী: বর্তমানে নারীদের সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়ার ঘটনা বেশ স্বাভাবিক। সব ক্যাডারে এখন নারীদের পদায়ন হচ্ছে। যদি মানের দিক থেকে বলেন সেদিক থেকেও অনেকটা পরিবর্তিত হয়েছে। একটা মেয়ে শুধু চাকরি করলেও সমাজ ও পরিবার তাকে অন্যান্য দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয় না। সেখানে নারীদেরকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যেতে হচ্ছে। আর কোনো মেয়ে যদি জোর করে কিছু করার চেষ্টা করে সেখানে তাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। ফলে সমাজ তার এই ভূমিকা থেকে এখনো ফিরে আসেনি। ‍এখনো সংসারে কিছু হলে ঐ মেয়েটার ওপরই কিন্তু দায়টা বর্তায়। সেই জায়গা থেকে একটা মেয়ে কিন্তু একসাথে সবগুলো প্রাচীর ভাঙ্গতে পারছে না। আমার ৩২-৩৩ বছরের সরকারি চাকরি জীবনে আমাকেও সংগ্রাম করতে হয়েছে। তার মানে কিন্তু এই নয় আমি আমার দায়িত্ব অবহেলা করছি। মূল কথা আমার নিজের জন্য একটা স্পেস দরকার, কিছু করা দরকার। আর এই বোধটা কিন্তু বর্তমানে নারীদের মধ্যে জাগ্রত হচ্ছে।

সারাবাংলা: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারী দিবস সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি?

নাহার ফেরদৌসী: নিউইয়র্কের একটি গার্মেন্টস কারখানা থেকে এই দিবসের উৎপত্তি। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মজুরি বৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তায় নেমেছিলো নারী শ্রমিকরা। এরপর থেকে ৮ মার্চ নারী দিবস পালন হয়ে আসছে। এই দিবসের মানে একটা মেয়ে তার স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার অধিকারটা চাচ্ছে। সুন্দর পরিবেশে কাজ করতে চাচ্ছে এবং তার দায়িত্ব পালন করতে চাচ্ছে। বেতন বৈষম্য দূর করতে চাইছে। ‍কিন্তু এই বৈষম্য এখনো বিদ্যমান। সমাজ সংস্কার কিংবা পরিবারের বাইরে গিয়ে কিছুই চাওয়া হয়নি। কিন্তু নারীদের সেই দাবি এখনো কিন্তু পুরোপুরি সফল হয়নি।  হয়তো সরকারি চাকরিতে যারা আসছে তাদের ক্ষেত্রে বেতনের বৈষম্য নেই। কিন্তু পরিবেশের দিক থেকে এখানেও কিন্তু অনেক বৈষম্যের স্বীকার হতে হচ্ছে। ফলে নারী দিবসের প্রতিবাদ হিসেবে আমি দেখি একটা মেয়ের স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার অধিকারগুলো। এখনো একটা মেয়ে বেতন বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছে,রাস্তায় চলতে ফিরতে বা কাজের স্থানে সব জায়গায় বৈষম্য, অত্যাচারের স্বীকার হচ্ছে। স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে তার যে প্রাপ্যটা সেটা কিন্তু সে পাচ্ছে না।

সারাবাংলা: একজন নারী হিসেবে সমাজের প্রতি আপনার বার্তা কি?

নাহার ফেরদৌসী: নারীর সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না। কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ ভালো রাখতে হবে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা জরুরি। প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি রোধের ব্যবস্থা থাকতে হবে। সমতার জন্য পুরুষদের সহায়তা ও সমর্থন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আমরা শহরের নারীরা কিছু সুবিধা পেলেও গ্রামীণ নারীরা কিন্তু পিছিয়ে রয়েছে। নারীরা অস্তিত্বের সঙ্গে সংগ্রাম করে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জিং পেশায় কাজ করছেন। কিন্তু এরপরও নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে কিন্ত অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্নবোধক চিহ্ন রয়ে যাচ্ছে। এই প্রশ্নবোধক চিহ্ন থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সমাজকে আরও উদ্যোগী হতে হবে। সমস্যাগুলোর সমাধান করে নারীর পথচলা আরও সুগম করতে হবে।

সারাবাংলাকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

নাহার ফেরদৌসী: আপনাকেও ধন্যবাদ।

ছবি: হাবিবুর রহমান

সারাবাংলা/এসজে/এসএমএন

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

চট্টগ্রামে খালে ভাসছিল অর্ধগলিত লাশ
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৪:৩৩

বিএসইসি‘র চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৩:৫১

সম্পর্কিত খবর