জীবনযুদ্ধে হার না মানা ৫ নারীর হাতে জয়িতা সম্মাননা
৯ মার্চ ২০১৯ ১৭:০৩
।। সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: জীবন সংগ্রামের অবিশ্বাস্য যুদ্ধে এগিয়ে যাওয়া পাঁচ নারী পেলেন জয়িতা সম্মাননা। শনিবার (৯ মার্চ) আন্তর্জাতিক নারী দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সফল পাঁচ নারীর হাতে পদক ও সম্মাননা তুলে দেন।
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সম্মাননা জয়ী পাঁচ নারীর জীবন সংগ্রামের অসামান্য গল্প শোনান মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুন নাহার। জয়িতা সম্মাননাপ্রাপ্ত পাঁচ নারী হলেন পারুল আক্তার, শ্রীমতি অনামিকা ঠাকুর, রাজিয়া মাসুদ, হাসনা বেগম, শাকিরা বানু।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি।অনুষ্ঠানের প্রথম পর্ব শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছুক্ষণ অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেন।
পারুল আক্তারের জন্ম কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার পাথরনগর গ্রামে। তিনি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। তার স্বামী একজন দিন মজুর। চার সন্তানসহ তাদের ছয়জনের সংসার। অভাব-অনটনের কারণে তিনি একসময় সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে পারতেন না। সংসারের খরচ যোগাতে তিনি অন্যের বাড়িতে ঝি এর কাজ করতেন। পরবর্তীতে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় তিনি নার্সারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নেন।
প্রশিক্ষণ শেষে পাঁচশ টাকা পুঁজি করে ১০ শতক জমি বন্ধক রেখে নার্সারি গড়ে তোলেন। বেগম পারুল আক্তার অক্লান্ত পরিশ্রম করে ক্ষুদ্র নার্সারিকে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যেখানে এখন দশজন লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। বর্তমানে এ নার্সারি থেকে তার মাসিক আয় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা।
শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী আরেক নারী শ্রীমতি অনামিকা ঠাকুর শিল্পী। অনামিকার বাবা একজন শ্রবণ প্রতিবন্ধী। তার মা একটা এনজিও’তে চাকরি করতেন। ছেলেবেলায় অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটিয়েছেন। কখনো শুধু ভাতের মাড় খেয়ে স্কুলে গেছেন। লেখাপড়ার খরচ চালানোর জন্য তিনি ছোটবেলা থেকেই টিউশনি করেছেন। নিজেকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর এবং আনসার ভিডিপি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। সেলাই ও সংগীত বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে অন্যদেরও প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এভাবে তিনি অর্থ উপার্জন করেছেন। এভাবেই তিনি নিজেকে তৈরি করেছেন। কোনো সহায়-সম্বল না থাকার পরও অসীম ধৈর্য, কঠোর পরিশ্রম আর একাগ্রতা দিয়ে তিনি দারিদ্র্যকে জয় করেছেন। বর্তমানে রাজশাহী শিশু নিকেতন ইউনিটে চাকরি করছেন অনামিকা ঠাকুর।
সফল জননী হিসেবে বেগম রাজিয়া মাসুদও জয়িতা সম্মাননা পেয়েছেন। তিনি ১৯৬৩ সালের ১১ জুন চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়িতে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার নাম ছিল সবিতা চক্রবর্তী। তিনি উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। ১৯৭৭ সালে ১৩ বছর বয়সে সপ্তম শ্রেণীতে পড়াকালীন কয়েকজন দুর্বত্ত তাকে তার বড়বোন মনে করে অজ্ঞাত স্থানে ধরে নিয়ে যায়। ফটিকছড়ির একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির হস্তক্ষেপে তিনি দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা পান। ওই সময় এক মুসলিম ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়া হয়। নাম রাখা হয় রাজিয়া মাসুদ। এ ঘটনার পর থেকে তিনি তার পরিবারের মুখ আজও দেখেননি।
বেগম রাজিয়া মাসুদের দ্বিতীয় সন্তান গর্ভে থাকাকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির শিকার হয়ে তার স্বামী মিথ্যা মামলায় জেলে যান। নিদারুণ আর্থিক ও মানসিক কষ্ট সত্ত্বেও বেগম রাজিয়া মাসুদ ভেঙে পড়েননি। তিনি সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে তিন হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন।
অনেক সময় নিজে পান্তা ভাতের পানি খেয়ে ভাতগুলো সন্তানদের মধ্যে ভাগ করে দিতেন। এভাবেই খেয়ে না খেয়ে তিনি সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়েছেন। তার চার সন্তানের মধ্যে প্রথম সন্তান বিসিএস পুলিশ, দ্বিতীয় সন্তান বিসিএস পররাষ্ট্র, তৃতীয় সন্তান বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি পেয়েছেন। তার চতুর্থ সন্তান মেয়ে। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স এবং মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
বেগম রাজিয়া মাসুদ ১৯৯১ সালে নানুপুর ইউনিয়ন পরিষদের মহিলা সদস্য হিসাবে মনোনীত হন এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মহিলা সদস্য হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন।
তিনি ১৯৯৬ সালে ফটিকছড়ি উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক কারণে তিনি এবং তার সন্তানেরা বারবার হয়রানির শিকার হয়েছেন। সম্পূর্ণ প্রতিকূল অবস্থায় চার সন্তানকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করায় সফল মা ক্যাটাগরিতে রাজিয়া মাসুদকে এবার জয়িতা সম্মাননা দেওয়া হয়।
নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করা অন্য নারী হাসনা বেগম। মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলায় এক গ্রামে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি সিলেট এমসি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত। লেখাপড়ার পাশাপাশি শহীদ সুদর্শন উচ্চ বিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবেও তিনি চাকরি করছেন। এছাড়াও দৈনিক মৌলভীবাজার বার্তার মফস্বল প্রতিনিধি ও যোগাযোগ প্রতিদিন পত্রিকার রাজনগর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন হাসনা বেগম।
হাসনা বেগম ছিলেন স্কুলের ফাস্ট গার্ল। বড় হয়ে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। এসএসসি পরীক্ষার দিন তার বাবা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে ২০০৫ সালে তিনি এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এইচএসসির দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত অবস্থায় এক প্রতারক ঘটকের প্রলোভনে পড়ে লন্ডন প্রবাসী এক পাত্রের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। লন্ডনে নেওয়ার কাগজপত্র প্রসেস করার জন্য তার স্বামী চার লাখ টাকা বাড়ি থেকে আনার প্রস্তাব দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তার ভাইয়েরা জমি বিক্রি করে সাড়ে তিন লাখ টাকা তার স্বামী ও শ্বশুরের হাতে তুলে দেন।
এর কিছুদিন পর জানতে পারেন, তার স্বামী প্রথম স্ত্রীকে লন্ডনে রেখে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তার ওপর শারীরিক নির্যাতন করা হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় তার লেখাপড়া। নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় স্বামী ও শাশুড়ি মিলে তার মাথার চুল কেটে দেন। এ অবস্থায় তাকে দুইদিন বাথরুমে আটকিয়ে রাখা হয়।
খবর পেয়ে তার ছোট ভাই তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যান। কিন্তু নির্যাতন আর হবে না এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার শ্বশুর-শাশুড়ি আবার হাসনা বেগমকে ফিরিয়ে আনেন। শ্বশুরবাড়িতে আসার পর যৌতুকের জন্য আবার নির্যাতনের শিকার হন তিনি।
২০০৮ সালে রমজান মাসের দুপুর বেলায় শ্বশুরশাশুড়ি দেবর-ননদ সবাই মিলে বাঁশের লাঠি তাকে পেঠায়। তিনি রক্ষা পাওয়ার জন্য দৌড়ে ছাদে গেলে সেখানে থেকে তাকে হাওরে ফেলে দেওয়া হয়। সাঁতার কেটে তিনি নৌকার কাছে যান এবং সোনার নাকফুলের বিনিময়ে নৌকায় ওঠেন। তবে দূর থেকে শ্বশুরবাড়ির লোকজন আপত্তি জানালে নির্দয় মাঝি তাকে কচুরিপানার মধ্যে ফেলে দিয়ে চলে যান। পরবর্তীতে চিনু মিয়া নামের এক মাঝি অজ্ঞান অবস্থায় হাসনাকে উদ্ধার করেন। সবকিছু জানার পর তার বড় ভাই ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে কর্মহীন হয়ে পড়েন। তার মাতাও ব্রেন স্ট্রোকে মারা যান। অত্যন্ত বিপর্যস্ত অবস্থায় অনাহারে অর্ধাহারে থেকেও হাসনা বেগম আবার কলেজের শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
শিক্ষকদের সহায়তায় তিনি ২০০৯ সালে মানবিক বিভাগ হতে এইচএসসি পরীক্ষা এবং ২০১২ সালে বিএড পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। হাসনা বেগম ২০১০ সালে নারী ও শিশু আদালতে নারী নির্যাতন মামলা করেন। এই মামলাটি এখনও চলছে।
বেগম শাকিরা বানু। খুলনার দৌলতপুর উপজেলায় জন্ম তার। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেছেন। বর্তমানে দৌলতপুর দিবা-নৈশ কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন। তার বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকাররা তাদের বাড়ি লুট করে। ফলে মাত্র ১১ বছর বয়সে শাকিরা বেগম বানুর জীবন সংগ্রাম শুরু হয়। কিশোরী বয়সে তার থেকে ১৪ বছরের বড় এক ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে হয়। সংসারের সব কাজ সামলিয়ে তিনি লেখাপড়া করতেন। এখাবেই তিনি সন্তান লালনপালন ও সংসার সামলে এগিয়ে গেছেন।
সারাবাংলা/এনআর/একে