‘চকবাজারের আগুন স্বামীরে খাইছে, ৩ পোলারে নিয়া কই যামু?’
১২ মার্চ ২০১৯ ২৩:৫৮
।। সাদ্দাম হোসাইন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ‘ঢাকায় রিকশা চালায়ে মাসে ৮-১০ হাজার টাকা গেরামে পাঠাইত। সেই টাকায় তিন পোলারে নিয়ে সংসার চালাইতাম। যেই দিন আগুন লাগল, ওই দিনই কথা হইছিল। কইছে, দুই দিন পর টাকা পাঠাবে। টাকা তো দূরের কথা, দুই দিন পর স্বামীর মরার খবর পাইলাম। এখন তিন পোলা নিয়া কই যাব? কার কাছে হাত পাতব?’
ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন জিয়াসমিন বেগম। চকবাজারের চুড়িহাট্টার সেই ভয়াবহ আগুন কেড়ে নিয়েছিল তার স্বামী রিকশাচালক গোলাম মোস্তফা মিয়ার প্রাণ। তবে আগুনে পোড়া তার মরদেহ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। পরে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করা হয় গোলাম মোস্তফার মরদেহ। সেই মরদেহই আজ মঙ্গলবার (১২ মার্চ) বুঝে নিতে এসেছিলেন জিয়াসমিন বেগম।
জানা যায়, গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টার সেই আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যান রিকশাচালক গোলাম মোস্তফা মিয়া। থাকতেন কামরাঙ্গীরচর শশ্মান ঘাট এলাকায়। তিন ছেলে জিহাদ (১২), জীবন (৭) ও জিসানকে (৬) নিয়ে তার স্ত্রী জিয়াসমিন থাকতেন গ্রামের বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জের ডাসার পাড়া এলাকায়। গোলাম মোস্তফা ওই দিন রাতে রিকশা চালিয়ে যাচ্ছিলেন চুড়িহাট্টা দিয়ে। রাস্তায় প্রচণ্ড ট্রাফিক জ্যাম থাকায় সড়ক থেকে সরতে পারেননি, সেখানেই পুড়ে অঙ্গার হয়েছেন তিনি। সঙ্গে থাকা আরেক রিকশাওয়ালাও আহত হন সেদিনের অগ্নিকাণ্ডে। পরে তিনিই মোস্তফা মিয়ার পরিবারকে খবর দেন।
মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৫টা। তখনও স্বামীর মরদেহ বুঝে পাননি স্ত্রী জিয়াসমিন। একটু পর লাশ বুঝে পাবেন, তাই তিন সন্তানকে নিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে এদিক ওদিক চাওয়া-চাওয়ি করছিলেন তিনি।
জিয়াসমিন সারাবাংলাকে বলেন, স্বামী তো মইরাই গেল। হেরে তো আর ফিরা পামু না। কিন্তু তিনটা পোলা আছে। এগুলানরে যদি একটু মানুষ করতে পারতাম! হের পাঠানো টাকা দিয়াই তো সংসার চলত। কোনো টাকা-পয়সা রাইখা যায় নাই। এখন কী করব? কোনো কূল পাই না!
সহায়তা চেয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, যদি কেউ একটু সহযোগিতা করত, তাইলে ছেলেগুলা এতিম হইলেও মানুষ হইতে পারত। আমি ওদের নিয়া কই যামু? ভাই, আপনারা একটু সরকারকে বলেন না আমাদের একটু সাহায্য সহযোগিতা করতে।
আগের ঘোষণা অনুযায়ীই জেলা প্রশাসন থেকে স্বামীর লাশ নেওয়ার জন্য ২০ হাজার টাকা পেয়েছেন জিয়াসমিন। জানালেন, এর বাইরে আর কোনো টাকাই নেই তার কাছে। বলেন, ‘এই টাকায় স্বামীর লাশ নিয়া বাড়ি যামু। সেইখানে তো কিচ্ছু নাই। ঘরে চাল (চাউল) পর্যন্ত নাই।’ বলতে বলতেই পুলিশের ডাকে চলে যান স্বামীর লাশ বুঝে নিতে।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে স্বামীর লাশ বুঝে পান জিয়াসমিন। অ্যাম্বুলেন্সে করে সেই লাশ নিয়ে রওনা হন রংপুরের পথে। যাওয়ার সময় মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যান্য মরদেহের স্বজনদের কাছ থেকে অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় নেন তারা। একই ঘটনায় স্বজন হারানোয় তারা নিজেরাও যেন কোথাও একটা জায়গায় গিয়ে একাত্ম হয়ে পড়েছেন।
উল্লেখ্য, ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চকবাজারে চুড়িহাট্টার আগুনে ঘটনাস্থল থেকে ৬৭ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে দগ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরও চার জন। তবে উদ্ধার করা ৬৭ মরদেহের মধ্যে শনাক্ত করা সম্ভব হয় ৪৮টি মরদেহ। বাকি ১৯টি দেহ এতটাই দগ্ধ হয়েছিল যে সেগুলো শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। পরে স্বজনদের ডিএনএ নমুনার সঙ্গে মিলিয়ে প্রথমে ১১টি মরদেহ শনাক্ত করা যায়। ডিএনএ পরীক্ষায় দ্বিতীয় ধাপে শনাক্ত হয় আরও চারটি মরদেহ। মঙ্গলবার সেগুলোই বুঝিয়ে দেওয়া হয় স্বজনদের কাছে।
এদিন মোস্তফা মিয়ার মরদেহ ছাড়াও লালবাগের বাসিন্দা রেহেনুম তারান্নু দোলা (২২), চকবাজারের বাসিন্দা ফয়সাল ছারওয়ার (৫৩) ও মিরপুরের বাসিন্দা হাজী ইসমাঈল হোসেনের (৬১) মরদেহ বুঝিয়ে দেওয়া হয় স্বজনদের। এই তিনটি মরদেহ ছিল অন্যান্য হাসপাতালের মর্গে।
সারাবাংলা/এসএইচ/টিআর