Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

থামেনি শিশু নির্যাতন, বদলেছে ধরন


১৭ মার্চ ২০১৯ ১১:০৬

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

ঢাকা: গতকাল শনিবার (১৬ মার্চ) গলা কেটে হত্যা করা হয় জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার ধুরইল গ্রামের ১০ বছরের শিশু আব্দুর রহমানকে। শিশু দিবসের ঠিক আগের দিনের এই নৃশংসতা যেন সারা বছরেরই প্রতিচ্ছবি। বছর জুড়েই দেশে নির্যাতন, নিপীড়ন, ধর্ষণ, হত্যার মতো নির্মমতার শিকার হয়েছে শিশুরা। প্রতিনিয়তই বাড়ছে এই সংখ্যা, সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে শিশু নির্যাতনের ধরনও।

বিজ্ঞাপন

শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘বর্তমানে শিশু নির্যাতন যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।’ চলতি বছরের প্রথম সপ্তাহের দিকে ফিরে তাকালেই এর সত্যতা পাওয়া যায়। গত ৭ জানুয়ারি রাজধানীর ডেমরা থেকে ৫ বছরের নুসরাত জাহান ও ৪ বছরের ফারিয়া আক্তার দোলার লাশ উদ্ধার করা হয়। ধর্ষণের পর তাদের হত্যা করা হয়েছিল।

ওই ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া মোস্তাফা ও আজিজুল জানান, লিপস্টিক দিয়ে সাজিয়ে দেওয়ার কথা বলে তাদের প্রথমে বাসায় ডেকে আনা হয়। পরে ধর্ষণের চেষ্টাকালে দুই শিশু চিৎকার করলে দোলাকে গলা টিপে এবং নুসরাতকে গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়।

একইদিনে তুরাগ থানার ভাবনারটেক এলাকাতে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণের পর হত্যার চেষ্টা করে এক যুবক। এর আগের দিনই সাতক্ষীরার আশাশুনিতে ৮ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের পর পুকুরে ফেলা দেওয়া হয়। পরের দিন রাজধানীর গেণ্ডারিয়াতে ২ বছরের আয়েশাকে প্রতিবেশী নাহিদ নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে ধর্ষণের পর হত্যা করে।

বছরের প্রথম সপ্তাহের এই আগে-পরের হিসেবকে বিগত বা পরবর্তী সময়েরই চিত্র বলা যায়। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী- ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩১২ শিশু। হত্যার শিকার হয়েছে ২০৩ শিশু, বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যা করেছে ১৬০ শিশু, নিখোঁজ হয়েছে ১২৮ শিশু, নিখোঁজের পর মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে ৫৭ শিশু, অপহৃত হয়েছে ৭৯ শিশু, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারিরীক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৬৭ শিশু, বাবা-মায়ের হাতে নিহত হয়েছে ২৫ শিশু।

বিজ্ঞাপন

আবার ওই বছরের ২ জুলাই থেকে ডিসেম্বরের হিসাব থেকে জানা যায়, ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২১৮ শিশু, হত্যার শিকার হয়েছে ১৯৯ শিশু, বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যা করেছে ১২৫  শিশু, নিখোঁজ হয়েছে ৮৭ শিশু, নিখোঁজের পর মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে ২২ শিশু, অপহৃত হয়েছে ৬৭ শিশু, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২০ শিশু, বাবা-মায়ের হাতে নিহত হয়েছে ২১ শিশু।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে শিশু নির্যাতন বেড়েছে। একইসঙ্গে শিশু নির্যাতনের ধরনও বদলেছে। বিকৃত মানসিকতা, মাদকাসক্তি, তথ্য প্রযুক্তির সহজলভ্যতা, মামলার ধীরগতি, দীর্ঘসূত্রিতা, ভয়-ভীতির কারণে অপরাধীর সঙ্গে আপস, বিচারহীনতার সংস্কৃতি শিশু নির্যাতন বাড়িয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব। শিশু নির্যাতনের ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন থাকলেও সেটি উপেক্ষিত বলেও মত তাদের।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের চেয়ারপারসন এমরানুল হক চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘শিশু নির্যাতন কমেনি বরং নির্যাতনের ধরন আরও মর্মান্তিক, পৈশাচিক হয়েছে। এ জায়গায় পরিবার এবং সমাজে যারা প্রতিনিধিত্ব করেন তাদের দায়িত্ববোধের অভাব রয়েছে। সমাজে শিশু নির্যাতনের প্রতিরোধ সাধারণত পরিবার ও সমাজ থেকেই শুরু হয়। এ দুই জায়গায় ঘাটতি রয়েছে। আবার বেড়েছে সামাজিক অস্থিরতা, অভাব সচেতনতারও। ফলে শিশু নির্যাতন বেড়েই চলছে।’

তিনি বলেন, ‘সমাজপতিদের দায়িত্বপালনে আরও সোচ্চার হওয়া এবং তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। যেখানে শিশু অধিকার লঙ্ঘিত হয়, শিশু নির্যাতন হয়, শিশু অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় সেখানে তাদের ভূমিকা রাখতে হবে। এ জায়গায় ঘাটতি হলে শিশু নির্যাতন বাড়বেই।’

শিশু নির্যাতনের বিষয়ে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে মনিটরিং থাকতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শিশুর জন্য পৃথক অধিদফতর করার কথা বারবার বলা হলেও সেটি হচ্ছে না। বিচার নিশ্চিত করতে না পারলে নির্যাতন কমবে না।’

মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হকও একই মত দেন। তিনি বলেন, ‘যেকোনও সময়ের চেয়ে শিশু নির্যাতনের ধরন বদলেছে। আর এটা হয়েছে সামাজিক অস্থিরতা, বিভিন্ন ভিডিও গেম এবং বিচার না হওয়ার কারণে। বিচার না হওয়ার সংস্কৃতির কারণেই শিশু নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে না। কিন্তু শিশু নির্যাতন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’

সেভ দ্যা চিলড্রেনের পরিচালক (চাইল্ড প্রটেকশন অ্যান্ড চাইল্ড রাইটস গভর্নেন্স) আবদুল্লা আল মামুন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সম্প্রতি শিশু নির্যাতনের ধরন ও কারণে ভিন্ন প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শিশুর প্রতি শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি যৌন নির্যাতনের হার মারাত্মকভাবে বেড়েছে। যার সঙ্গে অনলাইন আসক্তি এবং পর্নোগ্রাফির যোগসূত্র রয়েছে।’

‘এছাড়া পরিবার এবং স্কুল-মাদরাসায় এখনো শারীরিক শাস্তিকে শাসনের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়, যা শিশুর বিকাশের পথে বিশাল অন্তরায়’, মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘গত একদশক ধরে অভিভাবকদের প্রেম এবং বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কের নানা টানাপোড়েনে সহিংসতার বলি হতে দেখা গেছে অনেক শিশুকে। আবার শিশুকে সঙ্গে নিয়ে আত্মহত্যা কিংবা নিজেরাই শিশুকে হত্যা করে গুম করার মত ঘটনাগুলো শিশু সুরক্ষার বিষয়ে আমাদের সামাজিক অবস্থার অবক্ষয় তুলে ধরে।’

মাঠ পর্যায়ের কর্মসূচির আলোকে সেভ দ্যা চিলড্রেনের এই পরিচালক বলেন, ‘আমাদের দেশে শিশু নির্যাতন ঘটে যাওয়ার পর কমবেশি যতটা কার্যক্রম দেখা যায়, শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে তার পরিমাণ অনেক কম। শিশুদের ওপর পড়াশোনার চাপসহ নানা মানসিক নির্যাতনের ঘটনাও উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। যার ফলে আত্মহত্যাসহ শিশুদের মাঝে মানসিক বৈকল্যের মতো ঘটনাও বাড়ছে।’

তিনি শিশুদের জন্য একটি পৃথক অধিদফতর গঠনের দাবি জানিয়ে বলেন, ‘জাতীয়ভাবে শিশু সুরক্ষার সমন্বিত কাঠামো তৈরি করে প্রত্যেকের দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এটি করা না গেলে শিশু নির্যাতন বন্ধ হবে না। এজন্য সরকারি, বেসরকারি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে একসঙ্গে দায়িত্ব নিতে হবে।’

সারাবাংলা/জেএ/এমও

ধর্ষণ শিশু অধিকার শিশু নির্যাতন হত্যা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর