Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্বাধীনতা পুরস্কারে নব উদ্যমে বিনা বিজ্ঞানীরা


২১ মার্চ ২০১৯ ০৮:০১

ঢাকা: কৃষি গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কারণে প্রতিষ্ঠান হিসেবে চলতি বছর স্বাধীনতা পুরস্কার পাচ্ছে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)। প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক ড. হোসনেয়ারা বেগম বলছেন, এতে প্রতিষ্ঠানটির বিজ্ঞানীদের মধ্যে নতুন উদ্যম তৈরি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির সর্বত্রই এখন বইছে আনন্দের উচ্ছ্বাস। এই পুরস্কার পাওয়ায় এখানকার বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যতে গবেষণা কাজে এমনভাবে উদ্বুদ্ধ হবে যেন কৃষি সম্পৃক্ত সব ধরনের পুরস্কারই প্রতিষ্ঠানটি অর্জন করতে পারে।

বিজ্ঞাপন

বিনা স্বাধীনতা পদক পাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা হয় ড. হোসনেয়ারা বেগমের সঙ্গে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘পুরস্কারপ্রাপ্তিতে বিজ্ঞানীদের মধ্যে আরও বেশি উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে মধ্যে কাজ করার মনোভাব দেখা গেছে। জলবায়ুর ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলায় নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনে বিনা একনিষ্ঠভাবে কাজ করে চলছে। এ পুরস্কারপ্রাপ্তিতে স্বল্পকালীন ও উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনে বিনার বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যতে আরও বেশি মনোনিবেশ করবেন।’

বিজ্ঞাপন

‘কৃষি ক্ষেত্রে টেকসই উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার করে আসছে বিনা। এর মাধ্যমে বিভিন্ন ফসলের উন্নত গুণসম্পন্ন জাত উদ্ভাবন, কীট ও রোগবালাই ব্যবস্থাপনা এবং কৃষিতাত্ত্বিক, মৃত্তিকা উদ্ভিদ ও পানি সম্পর্কিত গবেষণা করে দেশের জনসংখ্যার খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা মোকাবিলায় বিনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলছে। ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমরা যে ভালো অবদান রেখে চলছি, তা এরই মধ্যে প্রমাণিত। আগে যেখানে একটি ফসল হতো, সেখানে দু’টি; যেখানে দু’টি ফসল হতো, সেখানে তিনটি; যেখানে তিনটি ফসল হতো, সেখানে চারটি ফসল প্রবর্তন করেছি। অর্থাৎ স্বল্পকালীন জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে আমরা শষ্য বিন্যাসের প্রবর্তন করেছি। এর ফলে সামগ্রিকভাবে দেশে বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন বেড়েছে,’— বলেন বিনা মহাপরিচালক হোসনেয়ারা।

বিনার বিভিন্ন উদ্ভাবন তুলে ধরে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা ১৭টি ফসলের একশ চারটি জাত উদ্ভাবন করেছি। আমাদের উদ্ভাবিত বিভিন্ন প্রযুক্তিও বেশ জনপ্রিয়। নাইট্রোজেন সারের বিকল্প হিসেবে আটটি শিম জাতীয় ফসলের আটটি জীবাণু সার উদ্ভাবন করেছি। বিনা উদ্ভাবিত জীবাণু সার ব্যবহারের ফলে ডাল ও তেলজাতীয় ফসলের ফলন বেড়েছে। এতে কেমিক্যাল কম লাগে, যে কারণে মাটির স্বাস্থ্যও ভালো থাকে। একইসঙ্গে রক্ষা পায় মাটির উর্বরতা।’

প্রতিষ্ঠানটির উদ্ভাবিত আমন মৌসুমের চাষ উপযোগী ‘বিনা ধান-৭’ উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা দূরীকরণে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে বলে দাবি বিনা মহাপরিচালকের। এর ব্যাখ্যা দিয়ে বিনা মহাপরিচালক সারাবাংলাকে বলেন, একসময় উত্তরাঞ্চলে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে কোনো কাজ থাকত না। তখন শ্রমিকের কাজ নেই, ঘরে খাবার নেই। অভাবের হার প্রকট। আমরা সেই প্রেক্ষাপটকে কাজে লাগিয়ে নতুন জাত বিনা-৭ উদ্ভাবন করি। এই ধান ১১০ দিনে কাটা যায় এবং এর ফসল ওঠে অক্টোবরেই। ফলে এই জাতটি ওই অঞ্চলে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এতে ওই অক্টোবর-নভেম্বর মাসে আমাদের এই জাতের ধান চাষের ফলে তারা কাজ পেল, ঘরে খাবার পেল এবং তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন তৈরি হলো। সেই সঙ্গে কেটে যায় মঙ্গার সেই প্রভাবও।

এদিকে, বিনা উদ্ভাবিত বেশকিছু ধানের জাত আউশ ও আমন— উভয় মৌসুমেই আবাদ করা যায়। এমন একটি জাত ‘ইরাটম ২৪’ সম্পর্কে বিনার ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এটি মধ্যম স্বল্প জীবনকালের জাত। এর জীবনকাল বোরো মৌসুমে ১৪০ থেকে ১৫০ দিন। আর আউশ মৌসুমে ১২৫ থেকে ১৩০ দিন। বোরোতে প্রতি হেক্টরে এর গড় ফলন ৬.৫ টন, আউশে ৩.৫ টন। এছাড়া বিনা ধান-১৪ উচ্চ তাপমাত্রা সহিষ্ণু বোরো ধানের জাত। হেক্টর প্রতি এর ফলন প্রায় ৭ টন। আবার বিনা ধান-১৯ খরা সহিষ্ণু নেরিকো-১০ জাত থেকে উদ্ভাবিত। এই জাতটিও আউশ ও আমন মৌসুমের চাষ উপযোগী। এর জীবনকাল মাত্র ৯০ থেকে ১০০ দিন। এটি বপন ও রোপণ— দু’ভাবেই চাষ করা যায়। তবে রোপণেই এর ফলন ভালো হয়। জাতটি বৃষ্টি-নির্ভর হিসেবেও চাষযোগ্য। খুব বেশি খরা হলে এক থেকে দু’বার সেচ দিলেই চলে। আউশ মৌসুমে এর গড় ফলন ৩ থেকে ৫ টন। আর আমন মৌসুমে ৫ থেকে সাড়ে ৫ টন। এর চাল সরু এবং খেতে সুস্বাদু। নানা গুণসম্পন্ন ধানের এমন আরও বেশকিছু জাত রয়েছে বিনার।

গমের মধ্যে বিনা উদ্ভাবিত জাতটির নাম বিনা গম-১। এর জীবনকাল ১০৫ থেকে ১১০ দিন। লবণাক্ত মাটিতে হেক্টরে এর ফলন ২.২ টন থেকে ৩.৫ টন, অলবণাক্ত মাটিতে ৩.২ থেকে ৪.২ টন। ডাল ফসলের মধ্যে মসুরের জাত রয়েছে ছয়টি, ছোলার পাঁচটি ও মুগ চারটি। একইভাবে বিনার বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন তৈলবীজ, মসলা, সবজি ফসল ও ফলের নতুন নতুন জাত। বিনা সরিষা-৯ সম্পর্কে মহাপরিচালক বলেন, ‘জাতটি অল্টারনারিয়া ব্লাইট রোগ প্রতিরোধী। আর এটিই সরিষার অন্যতম রোগ। এ জাতীয় সরিষার গড় ফলন ১.৫ থেকে ২ টন।’

আরও কয়েকটি ফসলের জাতের পরিচিতি তুলে ধরে ড. হোসনেয়ারা বেগম বলেন, বিনা মরিচ-১-এর হেক্টর প্রতি গড় ফলন ৩৫ টন। মরিচের দৈর্ঘ্য ৫ থেকে ৬ ইঞ্চি। মরিচটি ক্যাপসিকাম হিসেবেও ব্যবহারযোগ্য। বিনা রসুন-৯-এর ফলন হেক্টরে ১২ থেকে ১৪ টন, যেখানে প্রচলিত অন্যান্য জাতের ফলন ৬ থেকে ৭ টন। অর্থাৎ বিনা উদ্ভাবিত এ রসুনে ফলন প্রায় দ্বিগুণ। এছাড়া বিনা চীনা বাদাম-৪ বেশ জনপ্রিয়। শহরে ফেরিওয়ালারা যে বাদাম বিক্রি করেন, তার অধিকংশ এ জাতীয়। বিনা মুগ-৮ মাত্র ৬৪-৬৭ দিনে কেটে নেওয়া যায়। এই সময়ের মধ্যে ৮০ শতাংশ ডালই পোক্ত হয়ে যায়। হেক্টরে এর ফলন ২ টন। বিনা মুগ-৭ খেতেও অত্যন্ত সুস্বাদু বলে জানিয়েছেন তিনি।

এর বাইরেও বিনা লেবু-১ নামের একটি জাত থেকে সারাবছর লেবু পাওয়া যায়। প্রায় বীজশূন্য লেবুর জাত এটি। হেক্টরে এর গড় ফলন ২৪ থেকে ৩৫ টন। আর সবজি জাতীয় ফসলের মধ্যে রয়েছে টমেটোর একাধিক জাত, যার মধ্যে কোনো কোনোটি মাঠ পর্যায়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

প্রসঙ্গত, কৃষি গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে চলতি বছর স্বাধীনতা পুরস্কার পাচ্ছে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য প্রতিবছরের মতো ১২ ব্যক্তিও পাচ্ছেন এই পুরস্কার। আগামী ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) মনোনীত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কার তুলে দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটি দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ১৯৭৭ সাল থেকে প্রতিবছর এ পুরস্কার দিয়ে আসছে সরকার।

** কেন হঠাৎ গরম?

সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর

বিনা স্বাধীনতা পদক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর