প্রভাব কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে, জাপায় ‘গৃহবিবাদ’ তুঙ্গে!
২৩ মার্চ ২০১৯ ২২:২১
ঢাকা: জাতীয় পার্টির (জাপা) সাংগঠনিক কার্যক্রম প্রায় তলানিতে পড়ে গেলেও দলটিতে ঘটনার ঘনঘটা থেমে নেই। দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একের পর সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। সাংগঠনিক কার্যক্রমে গতি আনতে বিএনপির বেকায়দায় পড়া নেতাদেরও দলে টানার উদ্যোগ নিচ্ছেন। পরিবর্তন আনছেন নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে। সৃষ্টি করতে পারে কার্যকরী সভাপতির পদও। এরই অংশ হিসেবে সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার অভিযোগ এনে শুক্রবার (২২ মার্চ) দলের কো-চেয়ারম্যানের পদ থেকে ছোট ভাই গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে সরিয়ে দিয়েছেন। পরদিন সংসদে বিরোধী দলীয় উপনেতার পদ থেকেও তাকে অব্যাহতি দিয়ে তার স্ত্রী রওশন এরশাদকে স্থলাভিষিক্ত করেছেন।
দলের ভেতর এমন পরিবর্তনকে একপক্ষ ইতিবাচক মনে করলেও অন্যপক্ষ দেখছে গৃহবিবাদ হিসেবে। এরমধ্যে প্রথম পক্ষের ভাষ্য, দলকে চাঙ্গা করতেই এই পরিবর্তন জরুরি। আর দ্বিতীয় পক্ষের মতে, দলের ভেতরে শুরু হয়েছে গৃহবিবাদ। সেই গৃহবিবাদ এখন তুঙ্গে। এই টর্নেডো কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে গিয়েও প্রচণ্ড আঘাত হানতে পারে।
এদিকে, দলের একটি সূত্র জানায়, প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে জাপার ভরাডুবির পর বৃহত্তর রংপুর ও বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীদের অনেকেই দলত্যাগের চিন্তা-ভাবনা করছেন। বিষয়টি জেনে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন দলটির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।
জিএম কাদেরকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে দলটির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা বলেন, ‘জিএম কাদের পার্টি অফিসসহ বিভিন্ন জায়গায় দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কর্মকাণ্ডের বিরূপ সমালোচনা করেছেন। চেয়ারম্যানের কানে এসব কথা গেছে। ফলে দলে শৃঙ্খলা ফেরাতে জিএম কাদেরকে দলের কো-চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধী দলীয় উপনেতার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়াটা ছিল স্বাভাবিক।’
দলটির এই নেতা আরও বলেন, ‘ইতোপূর্বে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন বৈঠকে জিএম কাদের তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেছেন। এছাড়া, দলের সিনিয়র নেতাদের একত্রিত করে আজ পর্যন্ত তিনি কোনো বৈঠক পর্যন্ত করতে পারেননি। এমনকী তার সঙ্গে সিনিয়র নেতাদের কোনো সমন্বয়ও নেই।’
আরও পড়ুন: এবার উপনেতার পদ থেকেও জিএম কাদেরকে অব্যাহতি
জাপার একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, একই অবস্থা দলের মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গাঁর। জিএম কাদের ও রাঙ্গাঁ—কেউই দলকে সুসংগঠিত করতে পারেননি। ফলে দলের মহাসচিব পদে পরিবর্তন আসবে। পরিবর্তন আসবে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদেও। এসব পদে তরুণদের প্রাধান্য থাকবে বলেও তিনি দাবি করেন। এছাড়া দলে কার্যকরী সভাপতির পদ সৃষ্টি করে সেখানে নতুন নেতৃত্ব নিয়ে আসতে পারেন এরশাদ।
সূত্রটি জানায়, চলমান উপজেলা নির্বাচনে দায়িত্বশীল নেতা হিসেবে জিএম কাদের কিংবা মশিউর রহমান রাঙ্গাঁ—কেউ-ই দায়িত্বপালনে সাফল্যের পরিচয় দিতে পারেননি।
দায়িত্বশীল এই সূত্রটি জানায়, দলের ফান্ডে বর্তমানে ২০ কোটি টাকা রয়েছে। অথচ উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলের চেয়ারম্যানের শুভেচ্ছা সংবলিত কোনো পোস্টার-ব্যানারও করেননি জিএম কাদের কিংবা রাঙ্গাঁ।
হঠাৎ করে দলের ওপর দিয়ে ‘বয়ে যাওয়া ঝড়’ নিয়ে এরশাদের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন রাঙ্গাঁ। তবে, এসব বিষয় নিয়ে ‘নাক না গলা’তে এরশাদ তাকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন বলেও দায়িত্বশীল সূত্রটি জানায়। সূত্রমতে, জিএম কাদের ও রাঙ্গাঁ বিষয়টি নিয়ে এরশাদের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেও তিনি সাক্ষাৎ দেননি।
এরশাদের সম্প্রতিক সিদ্ধান্ত বিষয়ে জানতে চাইলে জিএম কাদের বলেন, ‘দলের ব্যাপারে এরশাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এই বিষয়ে আমার কিছুই বলার নেই।’
একই অভিমত মশিউর রহমান রাঙ্গাঁরও। তিনিও এরশাদের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এদিকে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘জিএম কাদের ও রাঙ্গাঁর কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নেই। তাদের ব্যাপারে দলের চেয়ারম্যান যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা সময়োচিত ও যথার্থ। দলকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে এরশাদের কাছে এর চেয়ে ভালো কোনো পথ ছিল না।’
আরও পড়ুন: ব্যর্থতার অভিযোগে ছোট ভাইকে অব্যাহতি দিলেন এরশাদ
ফিরোজ রশীদ আরও বলেন, ‘চলমান উপজেলা নির্বাচনে দায়িত্বপালনের ক্ষেত্রে জিএম কাদের ও রাঙ্গা—দুজনই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। তাদেই কেউ-ই নির্বাচনি পোস্টার পর্যন্ত ছাপাতে পারেননি। এই দুই নেতা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া দূরের কথা, তৃণমূল বা কেন্দ্রীয়—কোনো পর্যায়ের কোনো নেতার সঙ্গে একটি বৈঠকপর্যন্ত করতে পারেননি।
এদিকে, এরশাদের এসব সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন কয়েকজন সিনিয়র নেতা। তারা নাম না প্রকাশ করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘দলে জিএম কাদেরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাকে কো-চেয়ারম্যানের পদ ও সংসদে বিরোধী দলীয় উপনেতার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ায় দলের ভেতরে গৃহবিবাদ শুরু হবে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে ছড়িয়ে পড়বে এই টর্নেডো।’
এই নেতাদের সঙ্গে সম্পূর্ণ ভিন্নমত পোষণ করেছেন দলটির যুগ্ম মহাসচিব গোলাম মোহাম্মদ রাজু। তিনি বলেন, ‘দলের চেয়ারম্যান যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা দলীয় স্বার্থেই নিয়েছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘এরশাদ অসুস্থ অবস্থায়ও দলের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও তদারকি করেন। বিভিন্ন বৈঠকেও উপস্থিত থাকার চেষ্টা করেন।’
তবে, একজন শীর্ষ নেতা জানান, জিএম কাদেরের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতাদের কোনো সমন্বয় নেই। এসব ব্যর্থতার জন্যই তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। দলের জন্য বিষয়টি ভালো হয়েছে বলেও এই নেতা দাবি করেন।
এর আগে, জাপার যুগ্ম-মহাসচিব গোলাম মোহাম্মদ রাজু জানিয়েছিলেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভরাডুবির অনেক কারণ রয়েছে। একদিকে যেমন যোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি, অন্যদিকে যারা প্রার্থী হয়েছেন তাদের জন্যও তৃণমূল নেতাকর্মীরা তৎপর হননি ভোটের মাঠে।
দলের কয়েকজন প্রেসিডিয়াম সদস্য জানান, বৃহত্তর রংপুর ও বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীদের অনেকেই দলত্যাগের চিন্তা-ভাবনা করছেন। বিষয়টি জেনে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন দলটির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। দল টিকিয়ে রাখতে কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল নেতাকর্মীদের দলত্যাগ না করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
সারাবাংলা/এএইচএইচ/এমএনএইচ