শনাক্তের বাইরে যক্ষ্মা রোগীর ৮০ শতাংশ!
২৪ মার্চ ২০১৯ ১৬:৩০
ঢাকা: বর্তমানে যক্ষ্মারোগীর হার প্রতি এক লাখে ৮৬ জন। ২০১৭ সালে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় ২ লাখ ৪৪ হাজর ২০১ জন রোগী শনাক্ত করে চিকিৎসার আওতায় আনা হয়। চিকিৎসায় সফলতার হার শতকরা ৯৫ ভাগ। বাকি ৩৩ শতাংশ রোগী এখনো শনাক্তের বাইরে।
বিশেষজ্ঞ মতামত, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) বলছে, প্রতিবছর যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে বছরে ৬৬ হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এখনো এ ধরনের রোগীদের আনুমানিক ৮০ শতাংশই শনাক্তের বাইরে থাকছেন। আর সব ধরনের যক্ষ্মায় চিকিৎসার বাইরে থাকছেন ৩৩ শতাংশ রোগী।
জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির (এনটিপি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে এনটিপির মাধ্যমে দেশে ২ লাখ ৬৭ হাজার ২৭৬ জন যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি সরকারিভাবে তাদের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ১৫ বছরের কম বয়সী শিশু যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়েছে ১১ হাজার ৩৫২ জন। বর্তমানে দেশে ২০০টি জিন এক্সপার্টের মাধ্যমে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম চলছে। অতিরিক্ত আরও ৭৬টি জিন এক্সপার্ট মেশিন আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে যক্ষ্মা চিকিৎসার ক্ষেত্রে সাফল্য এলেও ডায়াগনসিস সংক্রান্ত জটিলতার কারণে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা বা এমডিআর টিবি নিয়ন্ত্রণ এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। আর এই রোগ শনাক্তকরণের আধুনিক যন্ত্র (জিন এক্সপার্ট) রয়েছে মাত্র ১৯৩টি। যেখানে প্রতিটি উপজেলায় একটি করে এই মেশিন দরকার। বছরে প্রতি লাখে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছে ২২১ জন, মারা যাচ্ছে ৪০ জন। তাই যক্ষ্মা চিকিৎসায় সচেতনতার পাশাপাশি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন জরুরি।
তাদের সুপারিশ- শিশুদের যক্ষ্মা শনাক্তকরণে জটিলতা, নগরে যক্ষ্মার প্রকোপ বৃদ্ধি, আধুনিক ডায়াগনসিসের ক্ষেত্রে জিন এক্সপার্ট মেশিনের স্বল্পতা, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে জনবল সংকট, বেসরকারি পর্যায়ে কম সম্পৃক্ততা, শনাক্তকরণকে বাধ্যতামূলক না করা, এই বিষয়গুলো নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
দেশে যক্ষ্মা রোগের যুগপোযোগী ওষুধ উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা কার্যক্রম আরও জোরদার করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেন, যক্ষ্মা ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ। নিয়মিতভাবে নির্দিষ্ট মেয়াদে নির্দিষ্ট মাত্রার ওষুধ সেবনে মানুষের শরীরে থাকা যক্ষ্মার জীবাণু ধ্বংস হয়।
জাহিদ মালেক বলেন, সরকারের প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম পরিচালনার ফলে যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হার কমেছে। কিন্তু রোগ শনাক্তকরণের ক্ষেত্রটি এখনো যথেষ্ট উন্নত হয়নি। তাই এই রোগ থেকে রক্ষার জন্য জনগণকে আরও সচেতন করতে হবে।
যক্ষ্মা প্রতিরোধে সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, সারাদেশে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা কিংবা কমিউনিটি ক্লিনিক, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, গার্মেন্টস কর্মীদের চিকিৎসা কেন্দ্র, জেলখানায় যক্ষ্মার চিকিৎসা ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্তদের জন্য ৯টি বিশেষ চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যক্ষ্মার প্রকোপ এবং ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মার (এমডিআর টিবি) প্রকোপ বেশি এমন দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম রয়েছে বলে জানিয়েছেন যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির চিকিৎসা কর্মকর্তা নাজিস আরেফিন সাকি। তিনি বলেন, যক্ষ্মা এখনো জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে।
তিনি জানান, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে ৬৬ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে যক্ষ্মায় আর নতুন করে যক্ষ্মার জীবাণুতে আক্রান্ত হয়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার মানুষ।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির জ্যেষ্ঠ সেক্টর স্পেশালিস্ট ডা. মো আবুল খায়ের বাশার বলেন, এমডিআর রোগী শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হচ্ছে, যে সংখ্যক জিন এক্সপার্ট মেশিন থাকা প্রয়োজন, তা নেই। তাছাড়া সচেতনতার অভাব ও চিকিৎসা ব্যয় বেশি বলে অনেকের পক্ষে নিয়মিত ওষুধ খাওয়া সম্ভব হয় না।
জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. সামিউল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ১৯৯৩ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে যক্ষ্মা নির্ণয় ও নিরাময়ের ক্ষেত্রে যে সাফল্য অর্জন করেছে, তা জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিরই সাফল্য। এই কর্মসূচির মাধ্যমে রোগ নির্ণয়ের হার প্রতি এক লাখ জনসংখ্যায় ৭৭ জন এবং আরোগ্যের হার শতকরা ৯৫ ভাগ। এতো সফলতার পরেও বিশ্বে যক্ষ্মার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ৩০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেসপারেটরি মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ও হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. বশীর আহমদ সারাবাংলাকে বলেন, এই হাসপাতালের মোট আসন সংখ্যার মধ্যে ৩৯০টি আসন যক্ষা রোগীদের জন্য নির্ধারিত। আর এই নির্ধারিত বেড সব সময় পূর্ণ থাকে। কখনো কখনো বেডের অভাবে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ এবং বর্হিবিভাগ থেকে রোগীদের ফেরত দিতেও বাধ্য হতে হয়।
ডা. বশীর আহমদ বলেন, বর্তমানে গ্রামের চেয়ে শহরে যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এখন মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে আসছে। শহরে জনসংখ্যা বেশি থাকার কারণে এখানে যক্ষ্মার ঝুঁকি এবং রোগীর সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে। ঘনবসতি যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা বাড়ার অন্যতম কারণ। যক্ষ্মা ছড়ায় বাতাসের মাধ্যমে, হাঁচি-কাশির মাধ্যমে। যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগী যখন কোথাও তার জীবাণুযুক্ত কফ ফেলছেন, সেই কফের জীবাণু বাতাসের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে, আর সেই বাতাস অক্সিজেনের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে সুস্থ মানুষের শরীরে। যার কারণে শহরে যক্ষ্মার হার এখন অত্যন্ত বেশি।
সারাবাংলা/এটি