ফুরিয়েছে বাংলা নববর্ষের প্রাণ হালখাতার আবেদন
১৪ এপ্রিল ২০১৯ ০৯:৩৪
রাজশাহী: আজ পহেলা বৈশাখ। বাঙালির উৎসবের দিন, নব-চেতনার দিন। প্রতিবছর এই উৎসবকে ঘিরে সারাদেশে আয়োজনের কোনো কমতি থাকে না। যতই দিন যাচ্ছে বহমান সংস্কৃতিতে এই উৎসবের আয়োজনে যুক্ত হচ্ছে নতুন সব ধারা। তবে ফুরিয়েছে বৈশাখের মূলমন্ত্র হালখাতার আয়োজন আর আবেদন।
একসময় দেশের প্রায় সব জেলায় বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে হালখাতার আয়োজন চোখে পড়তো। এখন আর তেমনটি দেখা যায় না। হালখাতা শহরে তেমনভাবে না হলেও প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেই-এর আয়োজন হতো বেশি। বছর শেষে দোকানের বাকি থাকা টাকা পরিশোধ করতে গেলে মিলত, মতিচুরের লাড়ু, বাতাসা, জিলাপি, দই ও অন্যান্য মিষ্টান্ন। সর্বজনীন সেই উৎসবে হালখাতা ছিল বাংলা নববর্ষের প্রাণ। এছাড়া, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ও ‘হালখাতা’র সামাজিক গুরুত্বও ছিল ব্যাপক।
পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানের মূল আয়োজন থাকতো হালখাতাকে ঘিরেই। দু’দশক আগেও বৈশাখের প্রথম দিনে গ্রামাঞ্চলের হাটবাজারে ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের মালিকরা এই আয়োজন করতো। বিশেষ করে আড়ত ও দোকানগুলোতে হালখাতার জাঁকজমক অনুষ্ঠান দেখা যেত। ব্যবসায়ীরা টালি খাতায় অংক কষে বাকি দিতেন। তার বেশিরভাগই উসুল হতো হালখাতার দিনে।
অনুষ্ঠানের এক সপ্তাহ আগে থেকেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা সাদা অথবা হলুদ রংয়ের কার্ডের মাধ্যমে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি হালখাতার দাওয়াত দিতেন। সেই দাওয়াত-পত্রে বকেয়া অর্থের কথা উল্লেখ থাকতো। আর পহেলা বৈশাখের আগের দিন গভীর রাত পর্যন্ত রঙ বেরঙয়ের কাগজের নকশা দিয়ে সাজানো হতো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে। সকাল থেকেই প্রতিটি মানুষ তাদের পাওনা পরিশোধ করতে দোকানে আসতেন। এই আয়োজন চলতো রাত পর্যন্ত।
আরও পড়ুন: এসেছে বৈশাখ, রমনায় শুরু বন্দনা
ঐতিহাসিকদের মতে, বাংলা নববর্ষের উৎসবের অন্যতম আয়োজন ছিল রাজ-পুণ্যাহ ও হালখাতা। ১৯৫০ সালে জমিদার প্রথা বন্ধ হয়ে গেলে পুণ্যাহ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়। পুণ্যাহ ছাড়া পয়লা বৈশাখের আরেকটি অনুষ্ঠান অল্পকিছু পরে চালু হয়েছিল, সেটি হালখাতা। গ্রামের কৃষকেরা সাধারণত তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনের কেনাকাটা করতেন বাকিতে। ফসল ঘরে উঠলে তারা ফসল দিয়েই ঋণ শোধ করতেন। মুদি দোকানিরা লম্বা খাতায় ক্রেতাদের নাম লিখে রাখতেন। বছরের শুরুতে পুণ্যাহর অনুসরণে নিজ নিজ দোকানে আমন্ত্রণ জানাতেন তাদের। ক্রেতারা পুরনো বকেয়া শোধ করে কিছু আগাম হিসেবেও কিছু শস্য দিতেন। এদিন বেচাকেনা তেমন হতো না।
বর্তমান সময়ে পহেলা বৈশাখে হালখাতা না হলেও ইংরেজি মাস হিসেবে জুন অথবা ডিসেম্বরে অনেকে হালখাতার আয়োজন করে থাকেন। এছাড়াও বোরো বা রোপা আমন ধান কাটা মাড়াই হলে ব্যবসায়ীরা হালখাতা করেন কোথাও কোথাও। তবে অনেক হিন্দু ব্যবসায়ীরা এখনও আগের ধারাবাহিকতায় চৈত্র সংক্রান্তি থেকে শুরু করে পহেলা বৈশাখের পরের দিন পর্যন্ত হালখাতার আয়োজন করলেও সংখ্যাটা অনেক কম।
রাজশাহীর প্রেমতলির মুদিদোকান ব্যবসায়ী নরেন্দ্রনাথ বলেন, হালখাতা আর সেইভাবে হয় না। বছরে তিন থেকে চারটি ফসল উৎপাদন হয়। ফলে বছরের যেকোনো সময় এই আয়োজন করলেই হয়। তবে একটা সময় ছিল পহেলা বৈশাখের দিন ধুমধাম করে সবধরনের ব্যবসায়ীরা হালখাতা করতেন। সময় ধারাবাহিকতায় সেই প্রচলন উঠে গেছে বললেই চলে।
রাজশাহীর কাপড় ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান জানান, বেশ কয়েক বছর আগে হালখাতা করেছিলেন। কিন্তু যেটুকু বকেয়া আদায়ের প্রত্যাশা করা হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত হয়নি। তাই আর হালখাতার আয়োজন করেন না।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইফুদ্দিন চৌধুরী জানান, সময়ের ধারাবাহিকতায় মানুষের রুচির এবং চাহিদার পরিবর্তন হয়েছে। আধুনিকতার ছোঁয়া এই পরিবর্তন এনেছে। ক্রেডিট কার্ড, ক্যাশ পেমেন্ট, অনলাইনের মাধ্যমে অনেকে এখন পণ্য কিনে থাকেন।
তিনি বলেন, তাছাড়াও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো আগের মত দীর্ঘদিন ধরে বকেয়া রাখতে চান না। বড় অংকের বকেয়া হবার আগেই আদায়ের চেষ্টা করেন। ক্রেতারা এখন যেকোনো সময় বকেয়া পরিশোধ করে থাকেন।
এসব কারণে হালখাতা অনুষ্ঠানের তেমন আয়োজন এখন আর নেই বলে জানান এই শিক্ষাবিদ।
সারাবাংলা/এনএইচ