বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস: গণমাধ্যমের স্বাধীনতা গণমানুষের অধিকার
৩ মে ২০১৯ ০৯:৫৭
‘সমাজের আয়না’, ‘জাতির বিবেক’, ‘চতুর্থ স্তম্ভ’, ‘ওয়াচডগ’ প্রভৃতি নানা অভিধা গণমাধ্যম, সংবাদপত্র, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এ অভিধাগুলোর বাস্তবরূপ কতটা দৃশ্যমান, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এক্ষেত্রে সমাজ-বাস্তবতা, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, সমাজে বিরাজমান বিভিন্ন অনুষঙ্গের দায়কেও উপেক্ষা করা যাবে না। তবে, গণমাধ্যমের উৎপত্তি ও বিকাশের উদ্দেশ্যের দিকে যদি দৃষ্টি নিবদ্ধ করি, তাহলে বলতে হয়, গণমানুষের সার্বিক কল্যাণের জন্যই গণমাধ্যমের সৃষ্টি।
অর্থাৎ গণমাধ্যম হবে গণমানুষের সারথিস্বরূপ। অসহায় মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, যন্ত্রণা, হতাশা, দুর্দশা, অসাম্য প্রভৃতি বিষয় তুলে ধরে সমাধানের পথ ত্বরান্বিত করবে গণমাধ্যম। আবার দুর্নীতি, অপরাধ, অনাচার, অবিচার তথা সমাজের নেতিবাচক দিকগুলোর বিরুদ্ধেও হবে সোচ্চার। আর এ সোচ্চার হওয়ার মাধ্যমে প্রকারান্তরে মানুষকে সংশোধনের পথ বাতলে দিয়ে একটি সুন্দর, নৈতিক ও মানবিক পৃথিবী গড়ে তোলাই হবে গণমাধ্যমের লক্ষ্য। একমাত্র স্বাধীন গণমাধ্যমই এ লক্ষ্য পূরণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
এত গেলো সমাজে গণমাধ্যমের ভূমিকার কথা। কিন্তু গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সঙ্গে গণমানুষের অধিকারের সম্পর্ক খুঁজতে গেলে তাকাতে হবে সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের দিকে। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এ ঘোষণা প্রদান করা হয়। এ ঘোষণাপত্রের ১৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেকেরই মতামত পোষণ ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতায় অধিকার রয়েছে। অবাধে মতামত পোষণ এবং রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্বিশেষে যেকোনো মাধ্যমে ভাব ও তথ্য জ্ঞাপন, গ্রহণ ও সন্ধানের স্বাধীনতাও এ অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।’
এক্ষেত্রে গণমাধ্যম নির্বাক মানুষের সবাক বন্ধু। গণমাধ্যম ‘ভয়েসহীন’দের ‘ভয়েস’ আর ‘পারওয়ারলেস’দের ‘পাওয়ার’। অন্যদিকে অপরাধী, অন্যায়কারী ও দুষ্টুজনের জন্য মূর্তিমান আতঙ্কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া একটি সংশোধনকারী মাধ্যমও। তাই, স্বাধীন গণমাধ্যম মানেই আপামর জনসাধারণের পক্ষে তাদের কথাগুলো বলার একটি বড় ক্ষেত্র। সে কারণেই আমরা বলছি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কেবল সাংবাদিকদের স্বাধীনতা নয়, বরং এ স্বাধীনতা আপামর জনসাধারণের অধিকার প্রতিষ্ঠার করারই প্রক্রিয়া। স্বাধীনতাহীন গণমাধ্যম মানে অধিকারহীন মানুষ।
উপরিউক্ত কথাগুলোকে বাস্তবতার নিরিখে ‘কেতাবি’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু, এটাই বাস্তবতা যে, গণমাধ্যমের এ স্বাধীন বৈশিষ্ট্য অর্জনের বৈশ্বিক পর্যায়ে চলছে নিয়ত সংগ্রাম। এ সংগ্রাম দিনদিন তীব্র হচ্ছে। আর এ সংগ্রামের হাত ধরেই পালন করতে হচ্ছে আজও বিশ্বে পালিত হচ্ছে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। তাই, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেই প্রতীয়ামান হবে, বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আজ চরম হুমকির মুখে। এক দিবস আসতে না আসতেই বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ণের পরিসংখ্যান বাড়তে থাকে।
ব্রাসেলসভিত্তিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্টস (আইএফজে)-এর তথ্যমতে, ২০১৮ সালে সারা বিশ্বে মোট ৯৪ জন সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী হত্যার শিকার হয়েছেন। তবে, ফ্রান্সের প্যারিসভিত্তিক সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার-এর তথ্য অনুযায়ী, এ সংখ্যা ৮০ জন। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস ও ইউনেস্কোর এক যৌথ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৯৯০ দশকের পর থেকে প্রায় ১৩০০ সাংবাদিক নিহত হয়েছেন (দি টেলিগ্রাফ, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৮)। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ৩৪৮ জন সাংবাদিককে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বিভিন্ন গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি হয়েছেন ৬০ জন (ডয়চে ভেলে, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৮)। ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির রকমফের সারা বিশ্বে বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করে ২০১৮ সালে এতটাই নিত্য নতুন হয়ে উঠেছে যে, অনেকেই সাংবাদিকদের ওপর এমন নিপীড়ণকে অভিহিত করছেন ‘নিউ নরমাল’ হিসেবে। ডয়চে ভেলে ও দি টেলিগ্রাফের পৃথক দুটি প্রতিবেদনে ২০১৮ সালকে সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বছর বলে অভিহিত করা হয়েছে।
গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ দাবিদার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমের চরম বিষোদগার করেছেন। গণমাধ্যম নিয়ে টুইটারে আক্রমণাত্মক মন্তব্য করেছেন। রোহিঙ্গা নির্যাতন নিয়ে প্রতিবেদন করায় মিয়ানমারের দুই সাংবাদিককে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে বেশি নির্মম ও জঘন্যতম ঘটনা ছিল, সৌদি দূতাবাসের ভেতরে সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ড। এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ উঠেছে। সারাবিশ্বে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার রেশ না কাটতেই গ্রেফতার হলেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। ফলে সারাবিশ্বে মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে বিরাজমান উৎকণ্ঠাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া আফগানিস্তান, সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে অনেক সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন। এসব ঘটনা বৈশ্বেক প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমের নাজুক পরিস্থিতি তুলে ধরে।
আমরা মনে করি, গণমাধ্যমের এ বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা শিক্ষার উদ্দেশ্যকেও ব্যাহত করতে পারে। সাংবাদিকতায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উদ্দেশ্য, যাতে একজন শিক্ষার্থী দক্ষতা বৃদ্ধি ও নীতি নৈতিকতা শিখে সুসাংবাদিকতার মাধ্যমে একটি নৈতিক ও মানবিক পৃথিবী গড়ে তুলতে পারে। একমাত্র সুসাংবাদিকতার মাধ্যমেই ভুয়া খবর, হলুদ সাংবাদিকতা প্রভৃতি ধ্বংসাত্মক প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করা যেতে পারে। আর সুসাংবাদিকতার জন্য স্বাধীনতার বিকল্প নেই। কিন্তু গণমাধ্যমের পরিস্থিতি ভবিষ্যতে সাংবাদিকতার মতো মহান পেশাকে বেছে নিতে যে কেউ অনীহা প্রকাশ করতে পারে। ফলে, শিক্ষার উদ্দেশ্য বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হবে পুরো বিশ্ব।
তাই, ‘বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস’-এ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পরিস্থিতির বিষয়টি ব্যাস্টিক মানদণ্ডে দেখার চেয়ে বেশি সামষ্টিক তথা বৈশ্বিকভাবেই পর্যবেক্ষণ করে আশু সমাধান বের করতে হবে। আর তা করতে হবে বিশ্বনেতা ও সংস্থাগুলোকেই। সম্প্রতি অ্যাসোসিয়েশন অব ইউনাইটেড নেশন্স করেসপন্ডেন্টস-এর ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোরিও গুতেরেস তার বক্তব্যে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় সকল সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। আমরাও তার সুরেই বলতে চাই, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ছাড়া কোনো সমাজই সম্পূর্ণ নয়। গণমাধ্যম লক্ষ্যবস্তু হলে, পুরো সমাজকেই চড়ামূল্য দিতে হয়। কোনো সন্দেহ নেই যে, গণমাধ্যম শান্তি, ন্যায় বিচার, টেকসই উন্নয়ন ও মানবাধিকারের এক অবিচ্ছেদ্য সহায়ক অংশীদার।
লেখকবৃন্দ: কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক।