মানুষের কারণে অস্তিত্বের সংকটে ১০ লাখ প্রজাতি
৮ মে ২০১৯ ০৯:০৭
প্রকৃতির অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্য যে বন্ধন আবশ্যিক, তা ঝুঁকিতে রয়েছে। একইসঙ্গে ঝুঁকিতে রয়েছে ১০ লাখের বেশি প্রাণী ও গাছপালার প্রজাতির অস্তিত্ব। প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকা অরণ্যবিনাশ, উন্নয়ন, প্লাস্টিকের মাত্রিতিরক্ত ব্যবহারসহ মানুষের নানা কর্মকাণ্ড ধীরে ধীরে বিলুপ্তির মুখে ঠেলে দিচ্ছে এই প্রজাতিগুলোকে। জাতিসংঘের এক বিশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য ওঠে এসেছে।
সোমবার (৬ মে) গ্লোবাল অ্যাসেসম্যান্ট রিপোর্ট অন বায়োডাইভারসিটি অ্যান্ড ইকোসিস্টেম সার্ভিস শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। ৫০টি দেশের ১৪৫ জন বিশেষজ্ঞ নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে গবেষণা সংস্থা ‘ইন্টারগভার্নমেন্টাল সায়েন্স-পলিসি প্লাটফর্ম অন বায়োডাইভার্সিটি এন্ড ইকোসিস্টেম’ (আইপিপিবিইএস)। গত ১৫ বছরের মধ্যে পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য এটাই প্রথম সর্বাঙ্গীণ প্রতিবেদন।
ষোড়শ শতাব্দী থেকেই মানুষের কারণে কমপক্ষে ৬৮০ টি মেরুদণ্ডী প্রাণীর অস্তিস্ত্ব বিলীন হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পিন্টা আইল্যান্ডের কচ্ছপ, ওয়েস্টার্ন জাভান গণ্ডার, সাদা গণ্ডার, কালো গণ্ডারের মতো বৈচিত্র্যময় প্রাণী।
আইপিপিবিইএস’র প্রতিবেদন অনুসারে, মানুষের নানা কর্মকাণ্ডের কারণে ২৫ শতাংশ স্তন্যপায়ী জীব, ৪০ শতাংশ উভচর জীব, প্রায় ৩৩ শতাংশ হাঙ্গর এবং ২৫ শতাংশ গাছ এই শতকের মধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। মানুষের ওপরও এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে।
প্রতিবেদন অনুসারে, ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে সামুদ্রিক প্রাণীরা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমুদ্রের অনেকাংশে এখনো ছোট ছোট প্রাণীদের অস্তিত্ব রয়েছে, তবে তাও দিন দিন কমে আসছে। নীরব হয়ে এসেছে বহু ট্রপিক্যাল বন। সেখান থেকে হারিয়ে গেছে ছোট পোকারা। এমনকি কমে আসছে ঘাসযুক্ত জমিও। ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে মরুভূমিতে। মানুষের কর্মকাণ্ডে পৃথিবীর ৭৫ শতাংশ ভূমিতে অংশে বিপুল পরিবর্তন এসেছে। আর সমুদ্রের ৬৬ শতাংশ সামুদ্রিক অঞ্চলেও এসেছে ভয়াবহ পরিবর্তন। বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে প্রাণহীন মৃত সামুদ্রিক অঞ্চলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪০০তে।
ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট অ্যাঙ্গলিয়ার পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও সংস্থাটির চেয়ারম্যান রবার্ট ওয়াটসন এর মতে, ‘১৫ হাজার বিজ্ঞানী ও সরকারি গবেষণা সংস্থার কয়েক দশকের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণের পর জীববৈচিত্র্য বিলুপ্তি নিয়ে যে চিত্রটি উঠে এসেছে, সেটি রীতিমত ভয়াবহ।’
বাস্তুসংস্থানের উপরই মানুষ এবং অন্যান্য জীবের বেঁচে থাকা নির্ভর করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘জীব বৈচিত্র্য ধ্বংসের হার সাম্প্রতিক সময়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে পৃথিবীব্যাপী অর্থনীতি, বাসস্থান, খাদ্য নিশ্চয়তা, স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা হুমকির মুখে দাঁড়িয়েছে।’
বিশ্লেষণ
পৃথিবীর শুরু থেকে এখন পর্যন্ত অনেক প্রাণী ও গাছপালা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, সাম্প্রতিক সময়ে জীববৈচিত্র্য বিলুপ্তির আশঙ্কা অন্যান্য শতকের থেকে ১০ থেকে ১০০ গুণ পর্যন্ত বেড়েছে।
ইউনিভার্সিটি অব কানেকটিকাটের পরিবেশ এবং বিবর্তনবাদের অধ্যাপক ডেভিড ওয়েগনারের মতে, ‘জীববৈচিত্র্য বিলুপ্তির হার বিবর্তনের হারের থেকেও খুব দ্রুততম সময়ে ঘটছে।’
পৃথিবীর বাস্তুসংস্থানের স্থিতিশীলতার জন্য এই বিষয়টিকে হুমকিস্বরুপ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এটার প্রভাব সরাসরি মানুষের স্বাস্থ্যের উপরও পড়বে বলেও মন্তব্য করেছেন তারা। মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণী ও গাছের মধ্যকার আন্তঃযোগাযোগ পরিবেশ একটি জটিল উপাদান। এটির যেকোনো একটি পর্যায়ে বিঘ্ন ঘটলে সমগ্র জীববৈচিত্রের উপরই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
তবে বিজ্ঞানীদের মতে, এখন পর্যন্ত যেহেতু পৃথিবীর সকল প্রজাতিকে শনাক্ত করা যায়নি, তাই আমরা সঠিক জানিও না মানুষের কারণে ঠিক কতোগুলো প্রজাতিগুলো বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে।
সমস্যার কারণ
প্রতিবেদনে প্রাথমিক বিলুপ্তির কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ক্রমবর্ধমান নগরায়ন। তাছাড়াও কৃষিজমির ব্যবহার, দূষণ, শিকার ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়গুলোও প্রভাব রাখছে। এসব কারণে অনেক প্রজাতিকেই তাদের স্বাভাবিক বাসস্থান থেকে এমন পরিবেশে সরে যেতে হয়, যেটি তাদের বসবাসের উপযোগী নয়।
মানুষের কারণে বায়ুমণ্ডলে ব্যাপক হারে বাড়ছে হচ্ছে গ্রিনহাউজ গ্যাসের মতো ক্ষতিকর উপাদানের। আর এসব উপাদান ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে পৃথিবীর লাখো প্রাণী ও গাছপালার জীবন।
আইপিবিইএস’র চেয়ারম্যান ওয়াটসন বলেন, জলবায়ুর মতো জীব বৈচিত্র্য ধ্বংসও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটির দিকেও আমাদের গুরুত্ব আরোপ করা উচিৎ। এই দু’টি পারস্পরিক সম্পর্কিত, জীববৈচিত্র্যকে এড়িয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের সমাধান কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এর জন্য আমাদের প্রয়োজন উপযুক্ত এবং স্থায়ী কৃষিকাজের ব্যবস্থা, বনায়ন ও প্রাণীদের বসবাস উপযোগী অভয়ারণ্য গড়ে তোলা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনো খুব দেরি হয়ে যায়নি। এখনও দশ থেকে বিশ বছর সময় আছে। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আমাদের সবচেয়ে বেশি যেটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে মানুষের স্বদিচ্ছা।
সারাবাংলা/ওএম/আরএ