Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ধানের রাজ্যে দামের নৈরাজ্য


১৪ মে ২০১৯ ০৮:০১

ঢাকা: বীজ ১২৫ টাকা + রোপন ২০০ টাকা + নিড়ানো ১০০ টাকা + পানি ৩৫০ টাকা + সার ও কীটনাশক ৩৫০ টাকা + ধান কাটা ৫০০ টাকা= মোট ১৬২৫ টাকা। এক কাঠা (৬.৭৫ শতাংশ) জমিতে ধানের জীবন চক্রে খরচের হিসাবটি মোটা দাগে এমনই। এই জমিতে সর্বোচ্চ ফলন জমি ও অঞ্চলভেদে দুই থেকে তিন মণ। এ বছরের বাজার দরে ৫০০ টাকা করে বিকোচ্ছে ধান। যার সর্বোচ্চ ফলনেও কৃষকের হাতে আসে ১৫০০ টাকা। ফলে ধানে এখন লোকসানের হিসাব স্পষ্ট।

দেশের বিভিন্ন এলাকায় খবর নিয়ে জানা যাচ্ছে, এ বছর ধানের ফলন কিছুটা কম। সবশেষ ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে অনেক এলাকার ধান কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা সরকারিভাবেই মেনে নেওয়া হয়েছে। এসবের কারণে গৃহস্থরা ধানচাষে লোকসানের মুখে পড়েছেন। কোথাও কোথাও সে লোকসানের মাত্রা এতই বেশি যে ধান কেটে বাড়িতে না এনে ক্ষেতে পুড়িয়ে দিতেও দ্বিধা করছেন না কৃষক। অনেকেই স্রেফ নিজের বাৎসরিক খোরাকের ধান কেটে নিয়ে বাকিটা মাঠেই ফেলে রাখছেন। যা অন্যরা কেটে নিয়ে যাচ্ছে। সবমিলিয়ে ধানের রাজ্যে দামের ক্ষেত্রে এক চরম নৈরাজ্য বিরাজ করছে বলেই মত সংশ্লিষ্টদের।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, বোরো মৌসুমে ধান কাটতে প্রতিবছরের মতো এবারও সারাদেশে শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। দেশের কোনো কোনো স্থানে শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ১ হাজার টাকায় উঠেছে। তবে অধিকাংশ স্থানেই কৃষকের দৈনিক মজুরি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একজন শ্রমিক দিনে সর্বোচ্চ দেড় কাঠা (পৌনে ৭ শতাংশ) জমির ধান কাটতে পারেন। সমপরিমাণ জমি থেকে ধানের উৎপাদন গড়ে তিন মণ। বাজার দরে বর্তমানে তিন মণ ধানের দাম  ১৫০০ টাকা। অর্থাৎ উৎপাদন মূল্যের অর্ধেক চলে যাচ্ছে দিনমজুর দিয়ে ধান কাটানোর পেছনে। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ধান কাটা ছাড়াও আরও রয়েছে বীজতলা তৈরি, জমি তৈরি (চাষ), সেচ, রোপন, কীটনাশক প্রয়োগ ও নিড়ানোর কাজ। সব মিলিয়ে ধান উৎপাদনে খরচ উঠছে না কৃষকের। বরং কাঠা প্রতি কৃষকের ক্ষতি ৬৫০ টাকা কিংবা তারও বেশি।

বিজ্ঞাপন

ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার কৃষক মো. মোস্তফা। সারাবাংলাকে বলছিলেন, ‘ধানের ফলন ভালোই হয়েছে। তবে এতে আমাদের কোনো লাভ নাই।’ কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘ধানের দাম খুবই কম। মাত্র ৫০০ টাকা মনে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে। তাতে কাঠাপ্রতি (পৌনে ৭ শতাংশ) লস হচ্ছে ৬২৫ টাকা।’

ধান চাষের প্রথম থেকে চূড়ান্ত ধাপের খরচের ব্যাখ্যা দিয়ে এই কৃষক জানান, পৌনে ৭ শতাংশের এক কাঠা জমিতে ধান চাষে খরচ হয়েছে ১৬২৫ টাকা (ধান কাটায় ৫০০ টাকা, সেচে ৩৫০ টাকা, সার ও কীটনাশকে ৩৫০ টাকা, বীজে ১২৫ টাকা, রোপনে ২০০ টাকা ও নিড়ানোতে ১০০ টাকা)। অথচ উৎপাদিত ধানের দাম ১ হাজার টাকা। ফলে কাঠাপ্রতি কৃষকের ক্ষতি ৬২৫ টাকা। অঞ্চলটিতে বর্তমানে কৃষি শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ৭৫০ টাকা বলেও জানান মোস্তাফা।

প্রায় একই রকম তথ্য দিলেন কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার হরশী গ্রামের কৃষক হিমেল কবির। সারাবাংলাকে হিমেল বলেন, এলাকায় কৃষি শ্রমিক নেই। শ্রমিকের মজুরি অত্যন্ত বেশি, দৈনিক হাজার টাকা। তারা হিসেবে এক কাঠা (এই অঞ্চলে ১০ শতাংশে এক কাঠার হিসাব) জমিতে ধান চাষে সাড়ে তিন হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। এর মধ্যে বীজে যাচ্ছে ৩০০ টাকা, চাষে ৩০০ টাকা, বপনে ৫০০ টাকা, সারে ৫০০টাকা, কীটনাশকে ২০০ টাকা, সেচে ৫০০ টাকা ও ধান কাটায় ১ হাজার ২০০টাকা।

এই এক কাঠা জমিতে উৎপাদিত ধানের দাম সর্বোচ্চ দাম ৩ হাজার টাকা (কাঠায় ৫ মণ উৎপাদন ধরে)। এতে কৃষকের লোকসান প্রতিকাঠায় ৫০০ টাকা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, চলতি বছর সারাদেশে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৮ লাখ ৪২ হাজার হেক্টর। আর আবাদ হয়েছে ৪৯ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর জমিতে। এই জমিতে এবার বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১ কোটি ৯৬ লাখ মেট্রিক টন।

অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সোমবার (১৩ মে) পর্যন্ত সারাদেশে ৫৩ শতাংশ জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে। এদিকে, হাওরের ৭ জেলায় আবাদ হওয়া ৪৫ লাখ ৭ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে ধান কাটা শেষ হয়েছে ৪৪ লাখ ৮ হাজার হেক্টরের। অর্থাৎ হাওরের ৯৮ শতাংশ জমির ধানই কাটা শেষ হয়েছে। ৭ জেলায় ধানের উৎপাদন ১৬ লাখ ৯৫ হাজার মেট্রিক টন। আর হেক্টর প্রতি ধানের উৎপাদন ৩ দশমিক ৭৮ টন।

ধানের দর এবং তার উৎপাদন খরচের মধ্যে সামঞ্জস্যহীনতায় দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই কৃষককে লোকসান গুনতে হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মীর নুরুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, এখন পর্যন্ত দেশের ৫০ শতাংশ জমির বোরো ধান কাটা শেষ হয়েছে। এখনো কাটা চলছে। ফলে চূড়ান্ত উৎপাদন সম্পর্কে এখনই বলা যাবে না। তবে উৎপাদন ভালো হয়েছে।

কৃষক ধানের দাম না পাওয়া বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা চাই ধানের উৎপাদন বাড়ুক। একইসঙ্গে উৎপাদন খরচ কম হোক। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, শ্রমিক খরচই সবচেয়ে বেশি। ধান পেকে গেল তখন কৃষকের আর কোনো উপায় থাকে না। মজুর দিয়ে ধান কেটে আনতে হয়। ফলে মোট হিসাবে লোকসান হয়।

কৃষিতে যান্ত্রিকীরণের প্রসার ঘটানোর চেষ্টা চললেও তাতে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না— এমনটি জানিয়ে এই কৃষিবিদ বলেন, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পকে আবারও বাড়ানো হয়েছে। কৃষি বিষয়ক ছোট ছোট যন্ত্রেরও ব্যবহার বাড়ছে। এতে ধীরে ধীরে কৃষিতে উৎপাদন খরচ কমে যাবে।

এখন ছোট ছোট কম্বাইন্ড হারভেস্টার ও রিপার পাওয়া যাচ্ছে বলে জানান মীর নুরুল আলম। তিনি বলেন, যন্ত্রের ওপর নির্ভরতা বাড়লেই কৃষক এই সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে পারবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক সারাবাংলাকে বলেন, কৃষক যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে বিষয়ে অমাদের আলোচনা চলছে। ধান ওঠার পর আমরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবো।

সার ও বীজে যেন আরও বেশি প্রণোদনা দেওয়া যায়, সে বিষয়ে সরকার ভাবছে জানিয়ে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ভবিষ্যতে ভতুর্কি আরও বাড়ানো হতে পারে।

এক প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী বলেন, ‘সরকারিভাবে ১২ লাখ টনের বেশি ধান কেনা যাবে না। কারণ গুদামে যায়গা নেই।’

ভবিষ্যতে আরও বেশি প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে জানান কৃষি মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব নাসিরুজ্জামানও। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ধানের উৎপাদন বেশি হলে কৃষক বঞ্চিত হয়। তখন আমাদের কিছু করার থাকে না। কিন্তু আমরা চিন্তা করছি ভবিষ্যতে কৃষকদের কিভাবে আরও বেশি প্রণোদনা দেওয়া যায়।’

করণীয় বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. এম আসাদুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, প্রতিবছরই কৃষক ধানের দাম পাচ্ছে না। শুধু ধান নয়, অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। এ পরিস্থিতিতে ধান কেনার ক্ষেত্রে সরকারকে আরও বেশি নজরদারি করতে হবে। মিল মালিকদের কাছ থেকে না কিনে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনতে হবে। আর ধান মজুত রাখার জন্য জেলা-উপজেলাগুলোয় শস্য গুদাম করা যেতে পারে, পরবর্তী সময়ে কৃষকরা যেন সঠিক দামে ওই ধান বিক্রি করতে পারেন।

সারাবাংলা/ইএইচটি/এমএম

ধান ধানের দাম নৈরাজ্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর