তীব্র পানি সংকটে ৬০ কোটি ভারতীয়
১৭ মে ২০১৯ ০৮:২৫
অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভারতে নিরাপদ পানির হাহাকার এখন সবচেয়ে বেশি। প্রায় ৬০ কোটি মানুষ বর্তমানে দেশটিতে পানি ঘাটতির অসুবিধা পোহাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় দক্ষিণ দিল্লির ভাসন্ত কুঞ্জ’র বস্তির কথা। সেখানে প্রতি ১০ দিন পর শত শত নারী-পুরুষের দেখা মিলে খালি পানির ড্রাম হাতে। তারা অপেক্ষা করে সরকারি ওয়াটার ট্যাংকারের অপেক্ষায়।
বস্তির জন্য পানি বণ্টনের সমন্বয়ের দায়িত্ব স্থানীয় ফাতিমা বিবির (৩০)। তিনি বলেন, গত ১০ দিন আগে তারা পানি সংগ্রহ করেছিলেন। অনেকের পরিবারেরই পানি ফুরিয়ে গেছে। এখন তারা নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন।
‘এভাবে বেঁচে থাকা খুব কষ্টের। রান্নাকরা, খাওয়া, পরিষ্কার করা সবকিছুর জন্য পানির প্রয়োজন হয়,’ বলেন ফাতিমা।
ছোট একটি কুঁড়ে ঘরে ফাতিমা তার স্বামী ও ৪ সন্তান নিয়ে থাকেন। ১০ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়েছিল। প্রায় ২০ বছর আগে জীবন জীবিকার তাগিদে স্বামীর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ থেকে দিল্লিতে আসেন তারা। এখনও জীবনযুদ্ধ করে যাচ্ছেন তারা।
ফাতিমা জানান, এই এলাকার পানি বণ্টনের দায়িত্ব তার। যখন পানির ট্যাংকার বস্তিতে পৌঁছায়, শুরু হয় সবার ব্যস্ততা ও চিৎকার চেঁচামেচি। সবাই পাইপ ও ড্রাম হাতে লাইন ধরে দাঁড়ায়। বিনামূল্যে প্রতিটি ঘরে ছয় শ লিটার করে পানি দেয় দিল্লির সিটি করপোরেশন।
১০ দিন পরপর পানির ট্যাংকার আসার কথা থাকলেও নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। তাই কখনো কখনো সারাদিনই তাদের পানির ট্যাংকারের অপেক্ষায় থাকতে হয়। তারা কোথাও কাজেও যেতে পারেন না। যদি পানি না নেওয়া হয় তারা বেশ বিপদে পড়ে যাবেন।
ফাতেমা বিবি বলেন, অর্ধেক বালতি পানি দিয়ে আমরা প্রতিদিন গোসল করি। বেশিরভাগ সময় শরীর ধৌত করা হয় না। আবার সবজি পরিষ্কার করার পর সেই পানি দিয়ে কাপড়ও পরিষ্কার করি। একই পানি বারবার ব্যবহার করি। এমনকি ময়লা পানিও পুনরায় ব্যবহার করা হয়।
তারপরও যদি পরের বার পানির ট্যাংকার আসার আগেই কারও পানি ফুরিয়ে যায় তাহলে প্রতিবেশীরা তাদের সাহায্য করেন। পানি ফুরিয়ে গেলে সংসারে স্বামীর কটু কথা শুনতে হয় গৃহিণীদের।
ভারতের প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান ‘নীতি অয়াং’ পানি সমস্যা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাদের প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, ভারতে প্রায় ৬০ কোটি বাসিন্দা তীব্র পানি সংকটে ভুগছে। এছাড়া, প্রতিবছর প্রায় ২ লাখ ভারতীয়র মৃত্যু হচ্ছে পানি সংকট অথবা দূষিত পানি পানের কারণে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভারতের প্রায় ২১টি বড় শহরে ২০২০ সাল নাগাদ ভূগর্ভস্থ পানি ফুরিয়ে যাবে। ভারতে বাড়তে থাকা পানি সংকটে ওসব শহর ভুগবে সবচেয়ে বেশি।
এনজিও ‘ফোর্স’ এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট জয়তি শর্মা বলেন, আমাদের জনসংখ্যার তুলনায় পানি অনেক কম। এটা কতটা ভয়াবহ তা অনেকেই ভাবছে না যা ভয়াবহ।
শর্মা আরও জানান, ভারত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভুগছে। পানি একসময় বৈশ্বিক হতাশায় পরিণত হবে।
একথা সত্য যে, ভারতে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর বেশি নির্ভর করা হয়। যুগের পর যুগ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে তাও ফুরিয়ে আসছে। ভারতের নগরায়ণ বাড়ছে খুব দ্রুত। এজন্য শহরগুলোতে পানির চাহিদাও বাড়ছে বেশি। তবে পানির বিকল্প উৎস নেই।
রিপোর্টে বলা হয়, দিল্লি, ব্যাঙ্গোলর ও হায়দ্রাবাদের মতো বড় বড় শহরের অন্তত ১০ কোটি লোক খুব শিগগিরিই ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারে সক্ষম হবেন না। এছাড়া, কৃষি ভিত্তিক দেশ হওয়ায় ভারতের ৮০ ভাগ পানিই ব্যবহার করা হচ্ছে চাষাবাদে। এক্ষেত্রেও ফুরাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানি। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। মৌসুমী বৃষ্টিপাতের নিশ্চয়তা নেই। খরাও হচ্ছে বেশি। শীতকালের সময় কমছে, বাড়ছে গ্রীষ্ম। সবমিলিয়ে পানি সরবরাহ হয়েছে আরও অনিশ্চিত।
কৃষকের আত্মত্যা ভারতে বড় ধরনের সমস্যা। ঠিকভাবে ফলন না হওয়ায় অনেক কৃষক আত্মহত্যা করছেন। ১৯৯৫ সাল থেকে প্রায় ২ লাখ কৃষক ভারতে আত্মহত্যা করেছেন। পানির অভাবে কৃষি ফলন বাধাগ্রস্ত হলে কৃষকের আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়বে।
এদিকে, ব্যাঙ্গালুর ও হায়াদ্রাবাদে পানি সংকটকে মুনাফা তৈরির পথ হিসেবে নিয়ে এক শ্রেণির ক্ষমতাসীনরা। তারা সেখানে সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। নিয়ন্ত্রণ করছে কারা পানি বা কি দামে পাবে। পানি যেন হয়ে গেছে পণ্য।
বিশেষজ্ঞরা জানান, ভারতে পানি সংকট সমাধান ও উপায় উদ্ভাবনে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিনিয়োগ প্রয়োজন। সমন্বিত পদক্ষেপ না হলে এই সমস্যা ভয়াবহ রূপ নিবে।
অপরদিকে ভাসন্ত কুঞ্জ বস্তির ফাতিমা বিবির মতো অনেকে নিজেরাই নিজেদের ব্যবস্থা নিচ্ছেন। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য ফাতিমা বিবি বাড়ির পাশেই ওয়াটার ট্যাংক বানিয়েছেন। এক্ষেত্রে সাহায্য নিয়েছে প্রতিবেশীদের। ভারতের বেড়ে চলা পানি সমস্যা সমাধানে এটি একেবারে প্রাথমিক হলেও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
সিএনএন থেকে
সারাবাংলা/এনএইচ