ঈদের ৩ দিনে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে শুধু পঙ্গুতেই ৩৭৫ জন
৭ জুন ২০১৯ ০৮:০০
ঢাকা: ২৬ বছরের শামীম সাভারের হেমায়েতপুরে দুর্ঘটনার শিকার হন ঈদের দিন, বুধবার (৫ জুন)। নিজের মোটরসাইকেলে নিয়ে রাস্তায় বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরই পেছন থেকে দ্রুত গতির একটি গাড়ি তাকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। এসময় তার ডান পা হাঁটুর নিচ থেকে ভেঙে যায় । দুপুর ২টার দিকে তাকে নিয়ে আসা হয় পঙ্গু হাসপাতালে। শামীমসহ তার পুরো পরিবারের ঈদের দিন কেটেছে পঙ্গু হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুর্নবাসন হাসপাতালের (নিটোর) জরুরি অস্ত্রোপচার কক্ষের সামনের বারান্দায়। ছেলে ডান পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে শুয়ে আছেন, আর মা বাবা উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছেন ছেলের দিকে।
শামীমের মা সাজু বেগম বলেন, প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে গতকালই (বুধবার)। তবে অস্ত্রোপচারের জন্য আগামী মঙ্গলবার (১১ জুন) তারিখ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
সাজু বেগম বলেন, ‘বাইক চালায়ে নাকি মানুষ অনেক ইনকাম করতেছে। তাই পোলাডা আমাদের না জানায়েই ১৫ দিনের মতো হইবো এক লাখ টাকা দিয়ে বাইক কিনছিল। কিন্তু তার খেসারত যে এমনে দিতে হইবো, সেইটা বুঝতে পারলে আমি কি তারে বাইক চালাইতে দিতাম?’
নিটোর রেজিস্ট্রার বুক থেকে জানা যায়, ঈদের আগের দিন মঙ্গলবার (৪ জুন ) থেকে আজ বৃহস্পতিবার (৬ জুন) পর্যন্ত ঈদের এই তিন দিনের ছুটিতে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে আসা রোগীর সংখ্যা মোট ৩৭৫ জন। এর মধ্যে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ১৪০ জন।
জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুর্নবাসন হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. শাখাওয়াত হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, এবারে অন্যান্য বছরের তুলনায় আসা রোগীর সংখ্যা কম। গতকাল ঈদের দিনে রোগী এসেছে ছয় জন। এদের মধ্যে তিন জনকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেকেই কেবল জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিয়ে ফিরে গেছেন বাড়িতে।
হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, নানান ধরনের সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা চলছে ।
ঢাকা থেকে রাজশাহীর গোদাবাড়িতে বাস-ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে গুরুতর আহত হয়ে এই হাসপাতালে ভর্তি আব্দুল কাদেরের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। কাদের জানালেন, দুর্ঘটনার পরপরই তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় রাজশাহীতে। পরে যখন আজ ভোরে জ্ঞান ফেরে তখন দেখেন তিনি পঙ্গু হাসপাতালে। এই দুঘর্টনায় মোট কতজন আহত হয়েছেন, কিছুই বলতে পারেন না তিনি। কেবল শুনেছেন, তার বাসের সুপারভাইজার গুরুতর আহত।
একতা ট্রান্সপোর্ট নামের বাসটি ঢাকা থেকে রাজশাহী চালিয়ে যাচ্ছিলেন চালক আব্দুর কাদের। বলেন, ‘রানিংয়ে ছিলাম, সিংগেল রাস্তা, জোরে চালানোর বিষয় না। কিন্তু সামনে দিয়ে ট্রাক আইসা মাইরা দিছে। বাম পায়ে হাঁটুর ওপরে ভাঙছে।’ এর দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা লাগবে বলেই চিকিৎসকরা তাকে জানিয়েছেন।
সড়ক দুর্ঘটনার শিকার আরেকজন মিজান। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে বলছিলেন, ‘এয়ারপোর্ট থেকে হেঁটে আসছিলাম। তখন কোনো গাড়ি চোখে না পরলেও হঠাৎ একটা মাইক্রোবাস এসে ধাক্কা দিয়ে গেল। কিছুই বুঝলাম না।’
১২ বছরের নিয়ামকে নিয়ে পটুয়াখালীর রাঙাবালি উপজেলা থেকে ঈদের দিন বিকেলে হাসপাতালে এসেছেন উম্মে হানি। আজ সকালে ছেলের অস্ত্রোপচার হয়েছে।
পেশায় শিক্ষক উম্মে হানি বলেন, ঈদের আগের দিন বাইক আর টমটমের সংঘর্ষে ডান পায়ের হাঁটু ভেঙে কয়েক টুকরো হয়েছে নিয়ামের। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তেমন ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু বাচ্চা ছেলেটা কি এতকিছু বোঝে? ছেলেটা ভয় পাচ্ছে, পা যদি কেটে ফেলতে হয়! বলতে বলতেই কেঁদে ফেলেন নিয়ামের মা।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত কয়েকবছর ধরে এই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশই আসে ঈদের ছুটির সময়ে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে। এর মধ্যে সিএনজি ও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। চিকিৎসকরা বলছেন, ঈদের ছুটির সময়ে ফাঁকা রাস্তাই এসব দুর্ঘটনার প্রধান কারণ।
তবে এবারের ঈদে তুলনামুলকভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় আসা রোগীর সংখ্যা অনেক কম বলে জানালেন এই হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. শুভ প্রসাদ দাস। তিনি বলেন, ঈদের দিনে বৃষ্টির কারণে মানুষ ঘর থেকে এবার কম বের হয়েছে । আবার ঢাকার বাইরে দুর্ঘটনাগুলোতে রোগীদের ঢাকায় আনাও সম্ভব হয়নি। তাদের স্থানীয়ভাবেই চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সে কারণে এবার ঈদে এখানে রোগীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম।
সারাবাংলা/জেএ/জেডএফ