Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এসেছে রেলট্র্যাক, কোচ আসবে আগামী বছর, ট্রেন চলবে ’২১-এ


৮ জুন ২০১৯ ১০:২৬

ঢাকা: উত্তরা দিয়াবাড়ি। রাজধানীর কোলাহল ছেড়ে সুনশান নীরবতার মধ্যে খুঁটির ওপর গার্ডার বসিয়ে অবকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১২ কিলোমিটারের মধ্যে প্রস্তুত ৫ কিলোমিটার। সেই ৫ কিলোমিটারে খুব শিগগিরই যুক্ত হবে লাইন। এদিকে রেলট্র্যাক এসে গেছে চট্টগ্রাম বন্দরে। আর কোচ নির্মাণ চলছে জাপানের কারখানায়। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২০ সালে ঢাকার একাংশে ট্রায়াল রানের মধ্যদিয়ে দৃশ্যমান হবে স্বপ্নের মেট্রোরেল। তবে মেট্রোরেল পুরোপুরি চালু হবে ২০২১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তীতে। মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) এসব তথ্য জানিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

ডিএমটিসিএল সূত্রে জানা যায়, উত্তরা থেকে মিরপুর, আগারগাঁও, ফার্মগেট, শাহবাগ ও টিএসসিসি হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত যাতায়াত করবে বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেল। মাত্র ৩৭ মিনিটে উত্তরা থেকে মতিঝিল পৌঁছানো যাবে এই রেলে। ২৪ সেট মেট্রোট্রেন উভয়দিক থেকে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। চলার পথে ১৬টি স্টেশন থেকে যাত্রী ওঠানামা করবে। মাত্র সাড়ে তিন মিনিট অন্তর অন্তর ট্রেন পাবেন যাত্রীরা। চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে তিনতলার ওপর থেকে ট্রেনে উঠবেন যাত্রীরা। কোচে যত আসন থাকবে তার দ্বিগুণ যাত্রী যাতে দাঁড়িয়ে যেতে পারেন সেই ব্যবস্থা থাকবে মেট্রোটেনে। পাশাপাশি নারীদের জন্য থাকবে সংরক্ষিত কোচ। তবে তারা চাইলে অন্য কোচেও উঠতে পারবেন।

বিজ্ঞাপন

ডিএমটিসিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এন সিদ্দিক সারাবাংলাকে জানান, ২০২০ সালের ১৫ জুন বাংলাদেশে প্রথম মেট্রোট্রেন কোচ এসে পৌঁছবে। এরপর প্রতি মাসে দু-তিনটা বা চারটা করে কোচ আসতে থাকবে। তবে কোচগুলো আরও আগে নিয়ে আসা যায় কি না সেই চেষ্টা চলছে।

যদিও এর আগে ডিএমটিসিএল-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল- এ বছরের ডিসেম্বরে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু করা হবে। কিন্তু নতুন ঘোষণায় রেল চালু প্রায় এক বছর পিছিয়ে গেল।

এ বিষয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এন সিদ্দিক বলেন, মেট্রোরেলের প্রথম ‘ট্রায়াল রান’ হবে ২০২০ সালে। ট্রায়াল রান সফল হলেই মূল অপারেশন শুরু হবে। মূল অপারেশন হবে ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে।

এদিকে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, জনগণকে বুঝতে হবে মেট্রোরেলের একটি রুট চালু হলেই যে সব যানজট কমে যাবে তা নয়। আমাদের মাস্টারপ্লানে ২০৩০ সালের মধ্যে ৬টি মেট্রোরেল চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।

কেমন হবে মেট্রোরেল

বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেল যা ‘এমআরটি লাইন ৬’ প্রকল্প নামে ডাকা হয়। এটি হবে এলিভেটেড বা উড়ালপথে। যাত্রীরা প্রতিটি স্টেশনে চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করবেন। প্রতি সেট মেট্রোরেলে প্রাথমিকভাবে ৬টি করে কোচ থাকবে। প্রতি ৪ মিনিট পর পর ১ হাজার ৮০০ যাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করবে একেটি মেট্রোরেল। ঘণ্টায় চলাচল করবে প্রায় ৬০ হাজার যাত্রী। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সময় লাগবে ৪০ মিনিটের কম। এভাবে ট্রেনগুলো প্রতিদিন ৫ লাখ যাত্রী পরিবহন করতে সক্ষম হবে।

মেট্রোট্রেনের কোচগুলো দেখতে কেমন হবে তা প্রকাশ করেছে ডিএমটিসিএল। ডিএমটিসিএল-এর প্রকাশ করা ছবিতে দেখা গেছে, কোচের সামনে উত্তরা-মতিঝিল লেখা রয়েছে। কোচের গায়ে লাল সবুজ রঙের মিশেল দেওয়া। ভেতরে মুখোমুখি আসন। তবে মাঝখানে যথেষ্ট ফাঁকা জায়গা রয়েছে। এছাড়া সিটগুলোতে বাসের মত হাতল দেওয়া আছে। ইতোমধ্যে ডিএমটিসিএল-এর প্রতিনিধি দল জাপানের কারখানা ঘুরে দেখে এসেছেন কোচের নির্মাণ কাজ।
উল্লেখ্য, প্রতিটি কাজের শুরু ও শেষের আগে পরিদর্শনের জন্য দু’বার করে বাংলাদেশ থেকে জাপানে যাচ্ছেন ডিএমটিসিএল-এর বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি দল।

১৬টি স্টেশন

প্রকল্পের তথ্যানুযায়ী, উত্তরার দিয়াবাড়িতে হবে মেট্রোরেলের প্রথম স্টেশন। প্রথম স্টেশনের নাম হবে উত্তরা নর্থ; এর পর উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সচিবালয় ও মতিঝিল পর্যন্ত এই ১৬টি স্টেশন থাকবে। শুরু থেকে শেষ স্টেশন পর্যন্ত যেতে সময় ৪০ মিনিটের কম সময় নেবে একেকটি ট্রেন। স্টেশনে প্রতি ৪ মিনিট পর পর পাওয়া যাবে ট্রেন। চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে রাস্তা থেকে স্টেশনে প্রবেশ করা যাবে। এরপর ‘প্রিপেইড কার্ড’ দিয়ে ট্রেনের ভাড়া পরিশোধ করতে পারবেন যাত্রীরা। আবার টিকিট কেটেও ভ্রমণের সুযোগ থাকবে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রেনের দরজাগুলো খুলে যাবে। এরপর যাত্রীরা ট্রেনের ভেতরে প্রবেশ করবেন।

ডিএমটিসিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, মেট্রোরেলের অবকাঠামো নির্মাণের পর রেললাইন বসানো হবে। এরপর বসবে বিদ্যুৎলাইন। বিদ্যুৎলাইনের পর ট্রেনের কোচ আসা সাপেক্ষে বাকি কাজটা হবে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল প্রকল্পের নিচের বেরিয়ার তুলে নেওয়া হবে। এরপর নিচে আর কোনো কাজ থাকবে না। তখন রাস্তা আগের মত বড় হয়ে যাবে।

এদিকে উত্তরা থেকে মিরপুর পর্যন্ত বিমানবন্দরের পেছনে মেট্রোরেলের ঠিক নিচ দিয়ে নতুন একটি সড়কপথ বের হবে। এই সড়কপথটি মেট্রোরেল প্রকল্পের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে। এখন স্থানীয়রা সড়কপথটি রাখার জন্য দাবি জানাচ্ছেন। তবে এটি সরকারি সিদ্বান্তের ওপর নির্ভর করছে বলে জানান এম এন সিদ্দিক।

মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ জানায়, ভায়াডাক্টের ওপর যে রেললাইন বসবে সেগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে চলে এসেছে। এরপর ভায়াডাক্কের ওপর বসানোর জন্য ১৩২ কেবির বৈদ্যুতিক লাইনও এসে পৌঁছেছে চট্টগ্রাম বন্দরে। এছাড়া আরও ৩৩ কেবি বৈদ্যুতিক লাইন দুবাই থেকে জাহাজে তোলা হয়েছে; যা খুব দ্রুতই চলে আসবে।

সর্বশেষ অগ্রগতি

উত্তরায় মেট্রোরেলের ডিপো এলাকার ভূমি উন্নয়ন শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে। নির্ধারিত সময়ের ৯ মাস আগেই ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি ভূমি উন্নয়ন শেষ হয়েছে। মেট্রোরেলের ৮টি প্যাকেজের এটি ছিল প্রথম প্যাকেজ; যার অগ্রগতি ১০০ ভাগ।
প্যাকেজ-২ এ ছিল ডিপো এলাকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে এর কাজ শুরু হয়েছিল। সংশোধিত পরিকল্পনা অনুযায়ী এটি আগামী মাসে শেষ হবে।

প্যাকেজ ৩ ও ৪-এর মধ্যে ছিল উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত লাইন ও স্টেশন নির্মাণ। এই প্যাকেজের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে। ইতোমধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার অংশে পরিষেবা স্থানান্তর, চেকবোরিং, টেস্ট পাইল, মূল পাইল ও আই গার্ডার নির্মাণ কাজ অনেকাংশেই শেষ হয়েছে। মোট ৭৬৬টি পাইল ক্যাপের মধ্যে ৬১৭টি পাইল ক্যাপ নির্মাণ করা হয়েছে। ৩৯৩টি পিয়ার হেডের মধ্যে শেষ হয়েছে ৩৩৩টি এবং ৫ হাজার ১৪৯ প্রিকাস্ট সেগমেন্ট কাস্টিংয়ের মধ্যে শেষ হয়েছে ২ হাজার ৮৪২টির নির্মাণ কাজ। সার্বিক অগ্রগতি ৪২ দশমিক ৫০ শতাংশ।

প্যাকেজ-৫ এর অধীনে আগারগাঁও থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত ভায়াডাক্ট ও ৩টি স্টেশন নির্মাণ কাজ রয়েছে। এ প্যাকেজের কাজ ২০১৮ সালের আগস্টে শুরু হয়েছে। বর্তমানে এ অংশে পরিষেবা স্থানান্তর, চেকবোরিং ও টেস্টপাইল শেষ হয়েছে। মূল পাইল নির্মাণের জন্য ২১০টি ট্রায়াল ট্রেঞ্চের মধ্যে ১২৬টি ট্রায়াল ট্রেঞ্চ সম্পন্ন হয়েছে। ৪৫২টি স্থায়ী বোরড পাইলের মধ্যে ১৫০টি স্থায়ী বোরড পাইল সম্পন্ন হয়েছে। জাপানের অ্যাডভান্সড নিউ টেকনোলজি ব্যবহার করে ১০৪টি স্ক্রু পাইল ফাউন্ডেশনের মধ্যে ২১টি পাইল ফাউন্ডেশন সম্পন্ন করা হয়েছে। এতে অগ্রগতি ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ।

প্যাকেজ ৬ এর অধীনে রয়েছে কারওয়ান বাজার থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ৪ দশমিক ৯২ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট ও ৪টি স্টেশন নির্মাণ; যা ২০১৮ সালের আগস্টে শুরু হয়। বর্তমানে এ অংশে পরিষেবা স্থানান্তর, চেকবোরিং ও টেস্ট পাইল কাজ শেষ হয়েছে। মূল পাইল নির্মাণের জন্য ২৯৮টি ট্রায়াল ট্রেঞ্চের মধ্যে ১৬৯টি ট্রায়াল ট্রেঞ্চ সম্পন্ন হয়েছে। ৬৫২টি স্থায়ী বোরড পাইলের মধ্যে ২৩৯টি স্থায়ী বোরড পাইল নির্মাণ শেষ হয়েছে। এখানে জাপানের অ্যাডভান্সড টেকনোলজি ব্যবহার করে ১৩৮টি স্ক্রু পাইল ফাউন্ডেশনের মধ্যে ৫৮টি স্ক্রু পাইল ফাউন্ডেশন সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া মোট ১৫১টি পাইল ক্যাপের মধ্যে ২টি পাইল ক্যাপ সম্পন্ন হয়েছে। অগ্রগতি ১০ দশমিক ২২ শতাংশ।

প্যাকেজ-৭ এর মধ্যে রয়েছে মেট্রোরেলের ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল সিস্টেম। এসব সরবরাহ ও নির্মাণ কাজের আওতায় ডিফেনটিভি ডিজাইন শেষ হয়েছে। হাই বোল্টেজ ফিডার ক্যাবল স্থাপনের জন্য টেস্ট পিট খনন সম্পন্ন হয়েছে। উত্তরা রিসিভিং সাব স্টেশন ও টঙ্গী গ্রিড সাব স্টেশনের বোল্টেজ ফিডার ২০২০ সালের মার্চের মধ্যে চালু হবে। এই প্যাকেজের আওতায় রেলপাত ও ১৩২ কেভি ক্যাবল চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছার পর খালাস করা হয়েছে। রেললাইন বসানোর কাজ চলতি বছরের অক্টোবরে শুরু হবে। আরও ৩৩ কেভি ক্যাবল নিয়ে জাহাজ গত ২৩ মে দুবাই থেকে চট্টগ্রামের পথে রওনা হয়েছে। আগামী ১২ জুন জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছবে। ভায়াডাক্টের ওপর বৈদ্যুতিক স্থাপনার নির্মাণ কাজ আগামী অক্টোবর মাসে শুরু হবে। এই প্যাকেজে অগ্রগতি ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ।

সর্বশেষ প্যাকেজ ৮ এর অধীনে রয়েছে রোলিং স্টক (রেল কোচ) ও ডিপো যন্ত্রপাতি। যার কাজ শুরু হয়েছে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে। কোচ ও ডিপো যন্ত্রপাতির ডিজাইন গত বছরের মে মাসে শেষ হয়। বগি নির্মাণের কাজ চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি জাপানে শুরু হয়েছে। এছাড়া যাত্রীবাহী কোচ (কার বডি) নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে ১৬ এপ্রিল। ২০২০ সালের ১৫ জুন প্রথম মেট্রো ট্রেন বাংলাদেশে পৌঁছার নির্ধারিত সময়। দেশে আসার পর ইন্ট্রিগ্রেটেড টেস্ট ও ট্রায়াল রান শুরু হবে। বর্তমানে প্যাকেজের অগ্রগতি ১৩ দশমিক ২৫ ভাগ।

উল্লেখ্য, মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ২২ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)-র প্রকল্প ঋণ ১৬ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন পাঁচ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা।

সারাবাংলা/এসএ/প্রমা

ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) মেট্রোরেল

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর