বাজেট ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা
১৩ জুন ২০১৯ ১৮:১০
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
গত বছরের ৩০ ডিসেম্বরের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেই আওয়ামী লীগ সরকার, তবে মন্ত্রী পরিষদে নতুন অর্থমন্ত্রী – আ হ ম মুস্তফা কামাল। নতুন অর্থমন্ত্রী তার জীবনের প্রথম বাজেট দিলেন এমন এক সময় যখন দেশের ব্যাংকিং খাত পর্যদুস্ত, অর্থনীতির প্রাণ বলে পরিচিত ব্যক্তি খাত দিশেহারা এবং রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক দূরে। অসুস্থতা নিয়েই সংসদে ‘সমৃদ্ধির সোপানে বাংলাদেশ, সময় এখন আমাদের’ শিরোনামে বাজেট পেশ করলেন আ হ ম মোস্তফা কামাল। যদিও শেষ পর্যন্ত অসুস্থতার কারণে শেষ করতে পারলেন না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাল ধরলেন বটে, তবে তিনি নিজেও বলেছেন এই বাজেট তিনি পাঠ করছেন অর্থমন্ত্রীর পক্ষ থেকেই। সুতরাং বাজেট ২০১৯-২০ এরই মধ্যে সংসদে উপস্থাপিত।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এর মধ্যেই বলেছেন তিনি নিজে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ দেখছেন – বাজেটের আকার বাড়ানো, রাজস্ব আদায় এবং ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। এই তিনটি ক্ষেত্রই তার দশ বছরে তার নিজের ব্যর্থতা ছিল চোখে পড়ার মত। তিনি বাস্তবায়ন করতে না পেরেও প্রতি বছর বাজেটের আকার বিশাল করেছেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড- এনবিআরের সক্ষমতা বিচার না করে বিশাল রাজস্ব লক্ষ্যামাত্রা নির্ধারণ করেছেন, বছর শেষ হওয়ার আগেই লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে এনেছেন, সেটিও আবার অপূর্ণই থেকেছে প্রতি অর্থ বছরে। এবং তার দশ বছরেই বিকাশমান ব্যাংকি খাত রুগ্ন হয়েছে।
নতুন অর্থমন্ত্রী বাজেট ব্যায়ের পরিমাণ পরিমাণ ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেট ছিল ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা, যা সংশোধিত হয়েছে ৪ লাখ ৪২ হাজার ৫৪১ কোটি টাকায়। অর্থাৎ আগামী বাজেটের আকার সংশোধিত বাজেট থেকে ৮০ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকার মতো বেশি। বড় বাজেট, যদিও দেশের জনসংখ্যার পরিমাণ হিসাব করলে বড় নয়, এমন বাজেটও প্রতি বছর শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়না। আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ২০ শতাংশ হবে বলে প্রত্যাশা করা হয়েছে। চলতি রাজস্ব বছরের প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধির ওপর নির্ভর করেই এমনটা ধরা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল তার প্রথম বাজেটে খরচের যে হিসাব ধরেছেন, তা বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১৮.১ শতাংশের সমান।
নতুন বাজেটে ব্যয় মেটাতে লক্ষ্যমাত্রা ১৭.৯২ শতাংশ বাড়িয়ে সরকারি অনুদানসহ আয়ের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এনবিআর বহির্ভূত কর ব্যবস্থা থেকে আসবে ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং বিভিন্ন সেবামূলক থেকে ৩৭ হাজার ৭১০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করে রাখা হয়েছে। রাজস্ব ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা ধরা হচ্ছে। বাজেটের প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা যাচ্ছে সরকারি কর্মচারীদের বেতন ভাতায় এবং এটি সংশোধিত বাজেটের চেয়ে সাড়ে ১৯ শতাংশ বেশি। অর্থ বছরের ৯ মাসে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব সংগ্রহ করতে পেরেছে ১ লাখ, ৪৩ হাজার কোটি টাকা। এর অর্থ হলো বাকী তিন মাসে করতে হবে ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা।
বরাবরের মতো আগামী বাজেটের ঘাটতিও থাকছে জিডিপির ৫ শতাংশ। তবে সেট ঘাটতির পরিমাণ ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে সরকারের ভরসা ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ গ্রহণ এবং যার কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ প্রায় স্তব্ধ হয়ে আছে। আগামী অর্থ বছরে ব্যাংক থেকে সরকার ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ নিতে চায়। এছাড়া, জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৭ হাজার কোটি টাকা।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি এডিপিতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে যা ধরা হয় ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা। সরকারের অর্থায়নে অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা থেকে ঋণ ধরা হয়েছে ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে যা আছে ৭১ হাজার ২২৬ কোটি টাকা। উন্নয়ন বাজেটের মোট আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা।
বাজেট আকার, বাস্তবায়ন আর আয়-ব্যয় নিয়ে আনেক কথাই হবে। কিন্তু সামষ্টিক অর্থনীতির চিত্রই বেশি আলোচিত হবে। অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকে অর্থনীতির প্রত্যাশা ব্যাংকিং খাতে সুশাসন আর সুস্থতা ফিরিয়ে আনা। ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থার কথা সেভাবে উচ্চারিত হয়নি তার বক্তৃতায়। এর মধ্যেই মার্চ পর্যন্ত খেলাপী ঋণ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর আ হ ম মুস্তফা কামাল ঘোষণা করেছিলেন তার সময়ে খেলাপী ঋণ এক টাকাও বাড়বেনা। অথচ আমরা দেখলাম ২০১৯ সালের প্রথম তিন মাসেই খেলাপী ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে।
সরকার সরকারি ব্যাংকিং খাতে গত ১০ বছরে ১৭৫০০ কোটি টাকা যোগান দিয়েছে। এটা পুরোটাই জনগণের টাকা। অদক্ষতা আর দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা ছাড়া আর কি? নতুন অর্থ বছরে আরো ১৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হল এই অদক্ষ সরকারি ব্যাংকগুলোর জন্য।
অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় ঋন খেলাপী সংস্কৃতি বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি আছে এবং আর্থিক খাতের উন্নতির জন্য ব্যাংক কমিশন গঠনের ভাবনা দেখা গেছে।
২০১২ সালের ভ্যাট আইন এবার হতে যাচ্ছে, কিন্তু একাধিক হার রেখে। এই আইনটি করা হয়েছিল আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করে। এটা তখন বাস্তবায়িত হলে এত দিনে একটা আধুনিক ভ্যাট সিস্টেম দাঁড়িয়ে যেত দেশে। ১৫ শতাংশের জায়গায় এমন একটা স্তরভিত্তিক ব্যবস্থা করায়, এটি হয়ে যাবে সেই মান্ধাতা আমলের এক্সাইজ ডিউটির মত।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে কালো টাকা সাদা করার বিরুদ্ধে অবস্থান ছিল। কিন্তু আমরা দেখছি আগামী অর্থ বছরের জন্য অর্থমন্ত্রী আয়কর আইন সংশোধন করে শিল্পে বিনিয়োগের জন্য কালো টাকা সাদা করার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
বড় বড় প্রকল্পসহ সামগ্রিকভাবে অবকাঠামোখাতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে। কিন্তু কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় বেসরকারি বিনিয়োগ আশানুরূপ নয়। দেশে কর্মরত পাঁচ লাখেরও বেশি বিদশি কর্মী বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রতি বছর পাঁচ বিলিয়ন ডলার নিয়ে চলে যায়, আর বিরাট সংখ্যক স্থানীয় কর্মী কর্মহীন থাকে। শ্রমবাজারে প্রতি বছর দুই কোটি মানুষ প্রবেশ করে বড় একটি অংশই বেকার থাকছে। এপ্রিল মাসে বাক্তি খাতে ঋণ প্রবাহ ১২.০৭ শতাংশে নেমে আসে যা গত ৫২ মাসে সর্বনিম্ন। জিডিপিতে ব্যাক্তি খাতের বিনিয়োগ ২২/২৩ শতাংশে হাবুডুব খাচ্ছে বহু বছর ধরে, যা প্রত্যাশিত ৩২/৩৪ শতংশ থেকে অনেক নিচে। ব্যবসায়ী অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বেসরকারি খাতের চাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনার কথা বলেছেন। সময়ই বলবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সত্যিই গতি ফিরে পাবে কবে।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: এডিটর ইন চিফ, সারাবাংলা ও জিটিভি।
সারাবাংলা/এমএম
২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট আ হ ম মুস্তফা কামাল উন্নয়ন ব্যাংকিং খাত