ঢাকা: প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্য ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর করজারভেশন অব ন্যাচার (আইইউসিএন) গত ৭ জুন এক প্রতিবেদনে সুন্দরবনকে ঝুঁকিতে থাকা বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করেছে। একাধিক কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর নড়েচড়ে বসেছে সরকার, শুরু হয়েছে দৌড়-ঝাঁপ, যেন সুন্দরবনকে ঝুঁকিতে থাকা বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না করা হয়।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটি বরাবর পাঠানো আইইউসিএনের ওই প্রতিবেদনে সুপারিশ করে বলা হয়েছে, ‘পৃথিবীর বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাস্থল বাংলাদেশের সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ ১৫০টি শিল্পস্থাপনা হচ্ছে, যা সুন্দরবনের টিকে থাকার জন্য হুমকি। তাই সুন্দরবনকে ঝুঁকিতে থাকা বিশ্ব ঐতিহ্যের (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ইন ডেঞ্জার) তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হোক।’
আরও পড়ুন- সুন্দরবনকে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকাভুক্তির প্রস্তাবে উদ্বেগ টিআইবির
ওই সুপারিশের পর সুন্দরবনকে কালো তালিকা থেকে বাঁচাতে সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টা শুরু হয়েছে। এর মধ্যে আইইউসিএনের কর্মকর্তাদের বোঝাতে ঢাকা থেকে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল গত ২৩ জুন গিয়েছেন ফ্রান্সের প্যারিসে।
ঢাকা থেকে যাওয়া ওই প্রতিনিধি দলে রয়েছেন বিদ্যুৎ সচিব ড. আহমদ কায়কাউস, পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক (বর্তমানে রাজউক চেয়ারম্যান) ড. সুলতান আহমেদ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (জাতিসংঘ) নাহিদা সোবহান। তাদের সঙ্গে প্যারিসে যোগ দেন ফ্রান্সে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কাজী ইমতিয়াজ হোসেন।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানাচ্ছে, ঢাকার উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলটি আইইউসিএন কর্মকর্তাদের সঙ্গে গত ২৪ ও ২৫ জুন বৈঠক করেছে। বৈঠকে ঢাকার পক্ষ থেকে আইইউসিএনকে বার্তা দেওয়া হয়, তাদের প্রতিবেদন সঠিক নয়। বাংলাদেশ সরকার এমন কিছু করছে না, যাতে সুন্দরবনের পরিবেশের ক্ষতি হয়। কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং অন্য স্থাপনা সুন্দরবনের বাইরে যথাযথ দূরত্ব বজায় রেখেই নির্মাণ করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশের প্যারিস দূতাবাসে যোগাযোগ করা হলে বিষয়টি ‘স্পর্শকাতর’ উল্লেখ করে কেউই মন্তব্য করতে রাজি হননি।
‘আইইউসিএন অ্যাডভাইসেস ইন ডেঞ্জার স্ট্যাটাস ফর থ্রি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ শীর্ষক গত ৭ জুন প্রকাশিত আইইউসিএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির কাছে আইইউসিএন সুপারিশ করছে যে সুন্দরবনসহ বিশ্বের তিনটি প্রাকৃতিক স্থানকে ঝুঁকিপূর্ণ বৈশ্বিক প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ইন ডেঞ্জার) তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হোক।
আইইউসিএনের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আগামী ৩০ জুন থেকে ১০ জুলাই আজারবাইজানে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির বার্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ওই বৈঠকে আইইউসিএনের এই প্রতিবেদন আমলে নিয়ে সুন্দরবনকে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হোক।
‘বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনই সুন্দরবনকে ঝুঁকিতে ফেলছে’— এমন উল্লেখ করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়াও সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে অনেক কল-কারখানা স্থাপন করা হচ্ছে, যা বিশ্বের বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগারগের আবাস্থলের জন্য হুমকির কারণ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সুন্দরবন থেকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সরিয়ে অন্য কোথাও স্থাপনের জন্য আইইউসিএন থেকে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার বলা হয়েছে। ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করলে সুন্দরবনের ওপর কী প্রভাব পড়বে, সে বিষয়ে কোনো যাচাই-বাছাই করা হয়নি। দুইটি বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রা নদীর পাড়ে স্থাপন করা হচ্ছে। এই নদীটি সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এ ছাড়াও সুন্দরবন ঘেঁষে ১৫০টি শিল্প স্থাপনা গড়া হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে জাহাজ চলাচল এবং নদী খননের কাজ সুন্দরবনের পরিবেশকে (হাইড্রোলজিক্যাল ও ইকোলজিক্যাল) হুমকিতে ফেলেছে।
সারাবাংলা/জেআইএল/টিআর