Saturday 07 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ট্রাম্পের পরাজিত ইরান কৌশল


২৯ জুন ২০১৯ ১২:৩৬ | আপডেট: ২৯ জুন ২০১৯ ১৩:৪৭
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানে আসলে কী চাইছেন? তিনি কি ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে হওয়া চুক্তিটির চেয়েও ভালো কিছু করতে চান? যে চুক্তি থেকে তার দেশকে তিনি সরিয়ে এনেছিলেন। অথবা কি তিনি ও তার উপদেষ্টারা মনে করছেন যদি তারা ব্যাপক পরিমাণে চাহিদার চাপ ইরানের উপর ঠেসে দেন তবে দেশটির শাসকরা তাদের বাধ্যগত হবে, হয়ত এমনকি ক্ষমতাচ্যুত হবে। অথবা কি ট্রাম্প ও তার উপদেষ্টারা ইরানে সরকার পরিবর্তনের জন্য সামরিক শক্তি ব্যবহারের পট তৈরি করছেন?

সম্ভবত তারা ইরানে কী করতে যাচ্ছেন তাদের নিজেদেরই কোনো ধারণা নেই। কেননা উপরের সম্ভাবনাগুলোর কোনটাই আসলে ইরানে হতে যাচ্ছে না।

বিজ্ঞাপন

ইরানের সঙ্গে জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) থেকে আমেরিকার বের হয়ে যাওয়াকে ট্রাম্পের নির্বাচনকালীন প্রচারণার একটি প্রতিশ্রুতি পালন হিসেবে দেখা যায়। কিন্ত সমস্যা হলো এর ফলে ভবিষ্যতে কী হতে যাচ্ছে এ সম্পর্কে তিনি নিজে বা তার উপদেষ্টাদের কেউই জানতেন না।

নির্বাচনের আগে নীতিমালা প্রণয়নের প্রতিশ্রুতিতে ট্রাম্পের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল তার পাড় সমর্থকদের ভোট নিশ্চিত করা। নির্বাচনের আগে ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চলতি যুদ্ধগুলোর বিরুদ্ধেও বলেছিলেন। এটা নিশ্চিত যে, মার্কিন ভোটাররা কোনোভাবেই চান না তাদের দেশ আরেকটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ুক। আর এই মুহূর্তে ইরানে একটি সামরিক অভিযানের মানে হবে আরও বেশি ক্ষতি। এবং আফগানিস্তান ও ইরাকের চেয়েও এখানে জয়ের সম্ভাবনা কম।

এক্ষেত্রে ট্রাম্প সম্ভবত যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে চাইবেন। তবে একইসঙ্গে ইরান সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে চাইবেন। সমস্যা হল, পারসিয়ান উপসাগরের এই অঞ্চলের রাজনৈতিক পরিবেশে এই দুই বিকল্পের মধ্যে বিভেদরেখা স্পষ্ট নয়। কেননা অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত চাপ প্রায়ই সামরিক সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি করে।

তবে কট্টরপন্থী উপদেষ্টা জন বোল্টনের মত কঠোর কিছু না বলে, ট্রাম্প বরং দাবি করেছেন, ইরানে সহিংস পন্থায় শাসক পরিবর্তন করার কোনো নীতি তারা গ্রহণ করেননি। কিন্ত তবুও তার কাজ দেখে মনে হচ্ছে তিনি নব্য রক্ষণশীল। উল্লেখ্য, জন বোল্টন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লুউ বুশকে ইরাক যুদ্ধের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন।

তবে সেই সময়ের চেয়ে এখনকার পরিস্থিতি আরও কঠিন, কেননা ২০০৩ সালের পর থেকে আস্তে আস্তে কৌশলগত জায়গা সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে। এখন ইরানের কৌশলগত অবস্থান ওই সময়ের তুলনায় আরও শক্তিশালী। কারণ ইরাক যুদ্ধের পর ইরানের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী দেশটির পতন হয় এবং আঞ্চলিক আধিপত্যের আসন থেকে ছিটকে পড়ে। ফলে ইরান আরও শক্তিশালী হয়েছে। এছাড়া, ইরানে যদি সামরিক অভিযান চালানো হয় তবে দেশটি একা হয়ে পড়বে তা ভাবার কারণ নেই, কেননা রাশিয়া ও চীনের কাছ থেকে তারা ব্যাপক সহায়তা পাবে।

১৯৭৯ সালে ইরানের শাহের পতনের পর ইরান সম্পর্কে পশ্চিমের নীতি সবসময়ই বিভ্রমের ওপর ভিত্তি করে গ্রহণ করা হয়েছে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব দীর্ঘদিন ধরে ইরানের নীতি ও আচরণ পরিবর্তন করার জন্য অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ওপর ভরসা করে এসেছে। কিন্ত এই কৌশল অত্র অঞ্চলে আমেরিকার অনেকগুলো ভুল নীতির একটি যা কিনা ইরানকে আরও শক্তিশালী করেছে। দেশটির সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি এখন ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশ ইরাক, সিরিয়া, লেবাননে সুদূর ইসরাইলের উত্তর সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে আছে। যদিও ইরান নানা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ভারে ন্যুব্জ, তবুও দেশটির অর্থব্যবস্থা ভেঙে পড়েনি। এবং নিরাপত্তায়ও কোনো ফাটল ধরেনি।

সম্প্রতি জেসিপিওএ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার ও ইরানের উপর পুনরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় ইরান জানিয়েছে এমনটি হলে তারা আবারও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শুরু করবে। ইরানের এই শাসকগোষ্ঠী পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করার অর্থ হলো এই অঞ্চলে অবিলম্বে যুদ্ধ অথবা পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা। এবং তা ইউরোপের নিরাপত্তের জন্য হুমকি।

ঠিক এই ধরনের ফলাফল প্রতিহত করতে ইউরোপীয়রা ২০০০ সালে ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক আলোচনা শুরু করেছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা পর্যন্ত  তা চলে এসেছিল। এখন ট্রাম্পের বিপরীত নীতির কারণে ওবামার সময়কার ব্যাপক অগ্রগতিগুলো পুরোপুরি ভেস্তে যাচ্ছে। এটা নিশ্চিত যে ইউরোপ একা ইরানের পারমাণবিক বিকাশ রোধে যথেষ্ট শক্তিশালী নয়।

মনে রাখা প্রয়োজন, পারমাণবিক বিকাশ প্রতিরোধের লক্ষ্য ছাড়াও জেসিপিওএ’র উদ্দেশ্য ছিল ইরানকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা। ইউরোপীয়দের মতো ওবামা প্রশাসন স্বীকৃতি দেয় যে, বিচ্ছিন্নকরণের কৌশল ইরানে কোনো কাজে আসেনি। এবং এই ইরানকে শায়েস্তা করতে ওই অঞ্চলে আরেকটি যুদ্ধও বিকল্প নয়। কিন্তু ওবামা প্রশাসনের এই নীতির বিপরীতে গিয়ে ট্রাম্প দৃশ্যত একমাত্র কার্যকর পথটাই বন্ধ করে দিলেন।

দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে ইরানের একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সত্তা রয়েছে। এখন প্রশ্ন হল এই প্রাচীন, গর্বিত সভ্যতাটি এই অঞ্চল ও সারা পৃথিবী জুড়ে ভবিষ্যতে কী ভূমিকা পালন করতে চায়। এই প্রশ্নের একটি সন্তোষজনক উত্তর পাওয়ার আগে পুরো মধ্যপ্রাচ্যই অস্থির থাকবে এবং যুদ্ধের আশঙ্কা শুধু বাড়তেই থাকবে।

উল্লেখ্য, ওবামা প্রশাসন যখন থেকে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সম্পৃক্ততা আংশিক প্রত্যাহার করা শুরু করল তখন ইরান, সৌদি আরব এবং ইসরাইল আঞ্চলিক আধিপত্যের লড়াইয়ে ব্যস্ত। এবং যেহেতু জেসিপিওএ ইরানের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের জন্য করা হয়েছিল, তাই এটি এই দীর্ঘস্থায়ী প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে উত্তেজনা কমাতে পারেনি। ইতিমধ্যে, ইরান এই অঞ্চলে তার অবস্থান আরও দৃঢ় করেছে। সিরিয়া যুদ্ধসহ কয়েকটি আঞ্চলিক দ্বন্ধের মাধ্যমে তারা তাদের উপস্থিতি বাড়িয়েছে। সৌদি ও ইসরাইলের উদ্বেগপূর্ণ ও অনিশ্চিত সম্পর্ক ইতোমধ্যেই বিরাজ করছে, এর ওপর যদি ইরান পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক হয় তবে এই অঞ্চল বড়সড় যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে যাবে।

পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন থেকে ইরানকে বিরত রাখতে এবং দেশটিকে গঠনমূলক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূমিকায় দেখতে চাইলে উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন। তবে এটা নিশ্চিত যে, এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা এই অঞ্চল থেকেই আসতে হবে। গত শতাব্দীর অভিজ্ঞতা তাই বলে।

জেসিপিওএ থেকে কোনো উপযুক্ত কারণ ছাড়াই নিজেদের প্রত্যাহার করার মাধ্যমে ট্রাম্প ইরান নিয়ে এক কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় ঢুকে পড়েছেন। শীঘ্রই তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তিনি লজ্জিত হয়েই ক্ষান্ত দেবেন নাকি সামরিক সংঘর্ষে জড়াবেন। যাই করুন তিনি তার অনুগত ভক্তদের হারাবেন এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো বিশ্বকে আরও বেশি বিপজ্জনক করে তুলবেন।

লেখক: জোশকা ফিশার, সাবেক জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ভাইস চ্যান্সেলর।

প্রজেক্ট সিন্ডিকেট হতে অনূদিত

ইরান ডোনাল্ড ট্রাম্প

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর