শ্রমবাজারের ১০ সিন্ডিকেটকে ফের সুযোগ দিতে চায় সরকার
৩০ জুন ২০১৯ ০৬:০৬
ঢাকা: সরকারিভাবে (জি টু জি পদ্ধতি) কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের ১০ প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি করায় মালয়েশিয়ার শ্রম বাজারে কর্মী নিয়োগ গত সেপ্টেম্বর থেকে স্থগিত রয়েছে। উচ্চ আদালত গত বছরের অক্টোবরে এই ১০ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিস্তারিত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিলেও প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এখনও তা দাখিল করতে পারেনি। বরং ওই ১০ প্রতিষ্ঠানকে আবারও জনশক্তি রফতানিতে সুযোগ দিতে চাইছে মন্ত্রণালয়। সারাবাংলার অনুসন্ধানে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগে ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির একচেটিয়া অনিয়ম তদন্তে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে ছয় মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে অনিয়ম, তদন্তে কমিটি গঠনের নির্দেশ
ওই ১০ প্রতিষ্ঠান হলো- ইউনিক ইস্টার্ন প্রাইভেট লিমিটেড, প্যাসেজ অ্যাসোসিয়েটস, সানজারি ইন্টারন্যাশনাল, আল ইসলাম ওভারসিজ, ক্যারিয়ার ওভারসিজ, রাব্বী ইন্টারন্যাশনাল, ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল, আমিন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস, প্রান্তিক ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজম ও এইচএসএমটি হিউম্যান রিসোর্স।
হাইকোর্টের ওই আদেশের ৩ মাস পর ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির একচেটিয়াত্ব ও অনিয়ম তদন্তে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। কমিটি গঠন হলেও এই কমিটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উচ্চ আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি। সর্বশেষ গত ২৭ জুন উচ্চ আদালত আরেকটি আদেশে আগামী ১৮ জুলাইয়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেন।
আরও পড়ুন: ‘প্রতিটি উপজেলা থেকে বছরে একহাজার কর্মী বিদেশে পাঠানো হবে’
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা গত বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে জানান, উচ্চ আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল বিষয়ে আগামী ৩ জুলাই বৈঠক ডেকেছে মন্ত্রণালয়।
ওই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রকৃত অর্থে ওই ১০ রিক্রুটিং প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়ের অনীহা রয়েছে। অদৃশ্য কারণে ওইসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কাজ করতে উৎসাহবোধ করে।’
আরও পড়ুন: প্রবাসীদের জন্য শ্রম কল্যাণ সম্মেলন
অন্য একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘জ্বালানি খাতের বিদেশি প্রতিষ্ঠান নাইকো যেভাবে মন্ত্রণালয়ের পিয়ন থেকে শুরু করে সচিব পর্যন্ত অবৈধভাবে অর্থ এবং অন্য উপঢৌকন দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেছিল। ওই ১০ প্রতিষ্ঠানও ঠিক তেমনি করে এই মন্ত্রণালয়ের বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিজেদের পক্ষে টানতে সমর্থ হয়েছে। যে কারণে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে চায় না মন্ত্রণালয়।’
আরও পড়ুন: মালয়েশিয়া সিন্ডিকেটকে শোকজ করা হবে: প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী
বিষয়টি জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব রৌনক জাহান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটা খুবই আলোচিত বিষয়। আদালতে এটি নিয়ে মামলা চলছে। আমরা এটি নিয়ে কাজ করছি। পেছনের বিষয় নিয়ে আমরা আর কথা বলতে চাই না।’
উচ্চ আদালতে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন কেন দাখিল করা হচ্ছে না, জানতে চাইলে সচিব রৌনক জাহান বলেন, ‘এটার মেয়াদ আছে, সময়মতো প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।’
ওই ১০ প্রতিষ্ঠানের কোনো চাপ আছে কিনা জানতে চাইলে সচিব বলেন, ‘এই বিষয়ে আমরা কোনো চাপে নেই।’
সচিব রৌনক জাহান সারাবাংলাকে আরও বলেন, ‘ওই ১০ প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমাদের আলাপ হয়েছে। তারা বলেছেন যে, অতীতে যা কিছুই হয়েছে আমরা (১০ প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা) এখন ইতিবাচক কন্ট্রিবিউট করতে চাই। আমরা সত্যিকারের মাইগ্রেশন বিষয়ে সুশাসন শক্তিশালি করতে সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চাই।’
আরও পড়ুন: জিটুজি প্লাস: মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে প্রায় লাখ বাংলাদেশি
‘ওই ১০ প্রতিষ্ঠানকে আবারও শ্রমশক্তি রফতানিতে সুযোগ দিতে চায় সরকার’, এমন তথ্য জানিয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব রৌনক জাহান বলেন, ‘মানুষতো সুযোগ পেলে পরিবর্তন হয়। তাই আমরা বায়রাকে আবার সুযোগ দিতে চাই। যারা ইনঅ্যাকটিভ তাদের চিহ্নিত করে আমরা বাদ দিতে চাই।’
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, দীর্ঘ ৭ বছর বন্ধ থাকার পর বিগত ২০১৬ সালে সরকারিভাবে (জি টু জি) বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া কর্মী নিয়োগ চালু হয়। তখন বাংলাদেশের ১০ প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে দুই দেশের সরকারের সঙ্গে যোগসাজস করে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের একচেটিয়া সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। সরকারিভাবে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগে খরচ হওয়ার কথা সর্বোচ্চ ৩৭ হাজার টাকা। অথচ ওই ১০ সিন্ডিকেট প্রত্যেকের কাছ থেকে কমপক্ষে ৪ লাখ টাকা করে নেয়। এতে করে কমবেশি ২ লাখ কর্মী মালয়েশিয়ায় পাঠাতে ওই সিন্ডিকেট আনুমানিক সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে হাতিয়ে নেয়।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ওই ১০ সিন্ডিকেটের দুর্নীতির কারণে শেষ পর্যন্ত মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার এখনও বাংলাদেশিদের জন্য স্থগিত আছে। যার প্রভাব পড়েছে রেমিটেন্স খাতে।
সারাবাংলা/জেআইএল/একে