বৃষ্টি-যানজটে সংকটে চট্টগ্রাম বন্দর, বিপর্যস্ত আমদানি-রফতানি
১২ জুলাই ২০১৯ ১০:০৯
চট্টগ্রাম ব্যুরো: টানা বর্ষণ, জলজট ও চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের জন্য যানজটে অবরুদ্ধ সড়কের কারণে সংকটে পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। বৃষ্টির কারণে ও সাগর উত্তাল থাকায় গত ছয়দিন ধরে বন্দরের বহির্নোঙ্গরে বড় জাহাজ থেকে পণ্য খালাস কার্যত বন্ধ আছে।
বন্দরে প্রবেশ করা ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান-লরি যানজটের কারণে স্বাভাবিকভাবে বেরুতে পারছে না, প্রবেশেও ব্যাঘাত ঘটছে। এর ফলে বন্দরের ইয়ার্ড থেকে পণ্য খালাসে স্থবিরতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে কনটেইনার জটের পাশাপাশি জেটিতে জাহাজ জটও তৈরি হয়েছে। সামগ্রিকভাবে বন্দরকেন্দ্রিক আমদানি-রফতানি বাণিজ্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের এ অচলাবস্থার কারণে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে আমদানি-রফতানিকারকেরা। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে বাজারে এর প্রভাব পড়বে বলে মত দিয়েছেন তারা।
তবে চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বৃষ্টির কারণে বহির্নোঙ্গরে বড় জাহাজ থেকে পণ্য খালাস বন্ধের চেয়েও মারাত্মক সংকটে ফেলেছে বন্দরের আশপাশের সড়কে ভয়াবহ যানজট। এই যানজটে একপ্রকার অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দর।
গত ৪ জুলাই থেকে চট্টগ্রামসহ আশপাশের এলাকায় বৃষ্টিপাত শুরু হয়। তবে ৭ জুলাই রাত থেকে সেই বৃষ্টিপাত অঝোর বর্ষণে রূপ নেয়। দুইদিন টানা বর্ষণের পর থেমে থেমে বর্ষণ এখনো অব্যাহত আছে। নগরীর পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ৮ জুলাই ২৫৯ মিলিমিটার, ৯ জুলাই ৬৭ মিলিমিটার, ১০ জুলাই ১৪৬ মিলিমিটার এবং বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) ৯৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি সাগর উত্তাল থাকায় চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে গত ৭ জুলাই থেকে বড় জাহাজের পণ্য খালাস বন্ধ আছে। ১৯০ মিটারের বেশি লম্বা জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে ভিড়তে পারে না। লাইটারেজ জাহাজ পাঠিয়ে পণ্য খালাস করে কর্ণফুলী নদীর ঘাটে অথবা নৌপথে দেশের বিভিন্ন ঘাটে গিয়ে সেই পণ্য খালাস করা হয়।
লাইটারেজ জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের কর্মকর্তারা জানান, বন্দরের বহির্নোঙ্গরে গত পাঁচদিনে কাজ হয়েছে মাত্র ২৫টি জাহাজে। স্বাভাবিক নিয়মে প্রতিদিন বহির্নোঙ্গরে ৪৫ থেকে ৫০টি জাহাজ থেকে একযোগে পণ্য খালাস চলে। এই অবস্থায় বন্দরে ৭৯টি বড় জাহাজ পণ্য খালাসের অপেক্ষায় বসে আছে। বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) সকালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কিছুটা কমলে ২৬টি জাহাজ থেকে খালাস শুরু হয়। কিন্তু বেলা গড়াতেই আবারও বৃষ্টি শুরু হলে বন্ধ হয়ে যায় খালাস।
বহির্নোঙ্গরে ৭ জুলাই জাহাজ ছিল ৬৮টি, কাজ হয়েছে ৫টিতে। ৮ জুলাই ছিল ৬৮টি, কাজ হয়েছে ২টিতে। ৯ জুলাই ছিল ৭৪টি, কাজ হয়েছে ৭টিতে। ১০ জুলাই ছিল ৭৫টি, কাজ হয়েছে ১২টিতে।
ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের সদস্য (অপারেশন) জাহাঙ্গীর আলম দোভাষ সারাবাংলাকে বলেন, ‘লাইটারেজ জাহাজ তো যেতেই পারছে না। গেলেও হ্যাজ খুলতে না পারায় খালাস তো হবে না। শুধু লোহার পাত ছাড়া আর কিছু খালাসের সুযোগ নেই। খালাস হলেও ঘাটে এসে সেগুলো নামানো যাচ্ছে না। আমরা বড় ধরনের ক্ষতির মধ্যে পড়ে গেছি। আমাদের প্রায় ৪০০ জাহাজ গত ছয়দিন ধরে অলস বসে আছে।’
বহির্নোঙ্গরের মতো একই ধরনের জট পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বন্দরের অভ্যন্তরেও। বন্দরকে ঘিরে সড়কে ভয়াবহ যানজটই এই সংকট তৈরি করেছে বলে জানিয়েছেন বন্দরের কর্মকর্তারা।
নগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ৮ জুলাই সকাল থেকে চট্টগ্রাম নগরী থেকে দু’টি সড়ক ধরে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাওয়ার দু’টি সড়কে কার্যত অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে একটি সিমেন্ট ক্রসিং থেকে রুবি সিমেন্টের দিকে, আরেকটি কাটগড়-পতেঙ্গা হয়ে বিমানবন্দর। রুবি সিমেন্টের সামনের সড়কে পানি জমে থাকায় স্বাভাবিক গতিতে গাড়ি চালানো যাচ্ছে না। কাটগড় সড়কটিতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ চলছে। সড়কের এক-তৃতীয়াংশ দখলে নিয়েছে সংশ্লিষ্ট বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স গ্রুপ। প্রায় ৮ কিলোমিটার সড়কের বিভিন্ন অংশে বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। সেসব গর্তের ওপর পানি জমে আছে। সেই সড়ক দিয়েও ছোট যানবাহন চলাচল প্রায় বন্ধ আছে। বড় বড় গাড়িগুলোও স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারছে না।
টানা বৃষ্টির কারণে সেই সড়কগুলোর পানি অপসারণ ও সংস্কার করে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক করার কোনো উদ্যোগও নিতে পারছে না সংশ্লিষ্টরা। এর ফলে গত পাঁচদিন ধরে ভয়াবহ যানজট তৈরি হয়েছে আশপাশের সড়কগুলোতে। চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে যানবাহন প্রবেশের ফটকও যানজটে প্রায় অবরুদ্ধ। গত পাঁচদিন ধরে বিমানবন্দর সড়কের এই যানজট কাস্টমস মোড়, আগ্রাবাদ, চৌমুহনী, টাইগারপাস পেরিয়ে ওয়াসা-জিইসি মোড় পর্যন্ত পৌঁছেছে।
নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক-বন্দর) তারেক আহম্মদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘গাড়ি যদি স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারত, তাহলে যানজট থাকত না। কিন্তু ভাঙাচোরা সড়কে গাড়ি চালানো যাচ্ছে না। যানজটে মানুষের দুর্ভোগ হচ্ছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।’
চট্টগ্রাম বন্দর ট্রাক কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক সুফিউর রহমান টিপু সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার তিনটি গাড়ি বন্দরে ঢোকার কথা ছিল বুধবার সকাল ৮টায়। ইন্ডাস্ট্রিয়াল আইটেম নিয়ে রাত ৯টায় ঢাকার মিরপুরে রওনা দেওয়ার কথা ছিল। আমার গাড়ি তিনটি বন্দরের এনসিটিতে ঢুকতে পেরেছে বুধবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে। বৃহস্পতিবার দুপুর ২টায় খবর নিয়েছি, তখনও গাড়িগুলো বের হতে পারেনি।’
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি আহসানুল হক চৌধুরী বলেন, ‘বন্দরে মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। জাহাজ থেকে যে কনটেইনার দুইদিনে নামানো সম্ভব সেগুলো দ্বিগুণ সময় লাগছে। ইয়ার্ড থেকে কনটেইনার ডেলিভারি দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ সেখানে অনেক গাড়ি। যানজটের কারণে সেগুলো বের হতে পারছে না। এতে কনটেইনার জট তৈরি হচ্ছে। আবার অফডক থেকে রফতানি কনটেইনারগুলোও যানজটের কারণে বন্দরে ঠিকভাবে আসতে পারছে না। এতে কনটেইনার ফেলেই জাহাজকে চলে যেতে হচ্ছে। আমরা দুইদিক থেকেই সমস্যায় পড়েছি। একদিকে জাহাজের ওয়েটিং টাইম ও চার্জ বাড়ছে। আবার কনটেইনার লোড করতে না পেরে জাহাজ চলে যাচ্ছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, চট্টগ্রাম বন্দরে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জাহাজ অবস্থান করছে ৯৭টি। বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ডে কনটেইনার আছে ৪৪ হাজার ৪৪৭টি। বন্দরের ইয়ার্ডে ৪৯ হাজার ১৮ কনটেইনার রাখার ধারণক্ষমতা আছে। সে হিসেবে- জটের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছেছে চট্টগ্রাম বন্দর।
চট্টগ্রাম বন্দরের চীফ পার্সোনাল অফিসার মো.নাসির উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরে কিছুটা প্রভাব পড়েছে। দিনে প্রায় ৫ হাজার ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান বন্দরে ঢোকে আর বের হয়। কিন্তু চলমান সংকটের কারণে সেটা অনেক কমে গেছে। পণ্য খালাস স্বাভাবিক না থাকলে বন্দরে তো প্রভাব পড়বেই।’
সারাবাংলা/আরডি/একে