Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিতে দেশের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি


১৩ জুলাই ২০১৯ ১০:৪৮

গোয়াইনঘাট, সিলেট

ঢাকা: উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিতে দেশের বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ভারী বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত এলাকা থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। যদিও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে তিস্তার পানি। তবে ভারী বর্ষণ না হলে বন্যার শঙ্কা দ্রুতই কেটে যাবে।

শনিবার (১৩ জুলাই) পানি উন্নয়ন বোর্ডের কন্ট্রোল রুমে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা জানান, উজানের ঢল সামাল দিতে তিস্তা ব্যারেজের প্রায় অর্ধশত স্লুইজ গেইট খুলে রাখা হয়েছে। তবে ওই এলাকার বাঁধগুলো এখনো ঝুঁকিতে রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সর্বক্ষণ তদারকি ও ঝুঁকি কমাতে তৎপর রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কন্ট্রোলরুম বলছে, দেশের প্লাবিত হওয়া লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, বগুড়া, নেত্রকোনা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নীলফামারীর বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। এসব এলাকার পানি নামতে শুরু করেছে।

ভারী বর্ষণ না হলে দ্রুত পানি নেমে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন কর্মকর্তারা। অতি বর্ষণে দেশের যে কয়েকটি অঞ্চলে বন্যার আশঙ্কা করা হয়েছিল, তা আপাতত কেটে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তারা।

তারা আরও জানান, যেকোনো সংকট মোকবিলায় সরকারের ব্যাপক প্রস্তুতি রয়েছে। বন্যা কবলিত এলাকার সাইক্লোন সেন্টার, উঁচু ভবনের স্কুল ও কলেজ প্রস্তুত রাখা হয়েছে এবং অতি কবলিত এলাকার মানুষদের আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে আনা হয়েছে। যেসব জায়গায় দ্রুত ত্রাণ প্রয়োজন, সেসব জায়গায় ত্রাণ প্রস্তুত রাখা রয়েছে। জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে তা বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়া শুক্র ও শনিবার সরকারি ছুটি থাকলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এদিকে সারাদেশের বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের লক্ষ্যে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে (সচিবালয়ের ৬নম্বর ভবনের ৫ম তলা) কন্ট্রোল রুম চালু হয়েছে। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ৪২৫ নম্বর রুমের কন্ট্রোল রুমের ফোন নম্বর হচ্ছে ০২৯৫৭০০২৮।

পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের শুক্রবার (১২ জুলাই) সন্ধ্যায় এক বার্তায় জানান, এই কন্ট্রোল রুমে সারাদেশে বন্যা সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হবে। বন্যা সংক্রান্ত তথ্য দেওয়ার জন্য জনগণকে কন্ট্রোল রুমের নম্বরে ফোন করার জন্য অনুরোধ করা হলো।

এ ছাড়াও মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পানি উন্নয়ন বোর্ডের ‘বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র’ এর টোল ফ্রি ১০৯০ নাম্বারে ফোন করার পর ৫ চাপলে বন্যার পূর্বাভাস সংক্রান্ত তথ্য জানা যাবে।

শনিবার (১৩ জুলাই) লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, বগুড়া, বান্দরবান, রাঙামাটি, সিলেটসহ দেশের বেশকয়েকটি জেলায় বন্যা পরিস্থির অবনতি হয়েছে। এসব জেলার নিচু এলাকার জনবসতি পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন আমাদের জেলা প্রতিনিধিরা।

লালমনিরহাট

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর অবিরাম বৃষ্টির কারণে তিস্তা নদীর পানি এখন বিপদসীমার ৪৮ এবং ধরলার পানি ৪১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে লালমনিরহাট সদরসহ ৫টি উপজেলার ২০টি ইউনিয়নের প্রায় ৫০ হাজার পরিবার পানিবন্ধি হয়ে পড়েছে। পানির প্রবল স্রোতে বাতীবান্ধা তালের মোড় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে দুটি গ্রাম।

সরেজমিনে দেখা গেছে, জেলার পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম, হাতীবান্ধা উপজেলার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, সির্ন্দুণা, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ও সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, গোকুন্ডা ও রাজপুর গ্রামের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ বন্যার কবলে পড়েছে। এসব এলাকার ঘরবাড়িতে পানি ওঠায় রান্নাবান্নাসহ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। দেখা দিয়েছে খাবারসহ সুপেয় পানির অভাব।

লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক মো. আবু জাফর জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যাকবলিতদের মাঝে এরই মধ্যে ১১০ মেট্রিকটন চাল ও নগদ আড়াই লাখ টাকা এবং শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। তবে এটা প্রয়োজনের তুলনায় কম। বন্যা ও নদীর ভাঙন ঠেকাতে ইতোমধ্যে ৪০ হাজার কোটি টাকার একটি প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরণ করা হয়েছে।

গাইবান্ধা

কয়েকদিনের টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও সদর উপজেলার ব্রহ্মপুত্র বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের বাইরে ১৮ ইউনিয়নের ১৬৫টি চর প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লক্ষাধিক মানুষ। পানির প্রবল স্রোতে নদ-নদীর তীরে দেখা দিয়েছে ভাঙন।

পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, গত ২৪ ঘন্টায় গাইবান্ধার ফুলছড়ি পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপদসীমার ৩১ সেন্টিমিটার ও ঘাঘট নদীর পানি ৫০ সেন্টিমিটার বেড়ে গাইবান্ধা শহর পয়েন্টে ৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এছাড়া তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি এভাবে বাড়তে থাকলে এসব চরের মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্র বা নিরাপদ উঁচুস্থানে সরিয়ে নিতে হবে।

বগুড়া

পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিতে বগুড়ায় সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীর পানি বাড়ছে। তবে পানি এখনও বিপদসীমার এক মিটার নিচে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের নিচু এলাকা ডুবে গেছে। পানির নিচে তলিয়ে গেছে আউশ ধান, আমন বীজতলা ও সবজির খেত। তবে ক্ষতির পরিমাণ জানাতে পারেনি কৃষি বিভাগ।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী কর্মকর্তা হাসান মাহমুদ জানান, যমুনার পানি সারিয়াকান্দি ও ধুনট পয়েন্টে বিপদ সীমার ৩৮ সে. মি. নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সারিয়াকান্দির গোদখালী ও ধুনটের কয়াগাড়ী বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের কাছ দিয়ে যমুনার পানি প্রবাহিত হলেও বাঁধ ভাঙ্গনের কোনো সম্ভাবনা নেই।

জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহমেদ জানান, বন্যার পুর্বপ্রস্তুতি হিসেবে সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগকে নিয়ে সভা করে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ত্রাণ সামগ্রী স্বল্প আকারে হলেও প্রস্তত রয়েছে। সার্বক্ষণিকভাবে বন্যার খোঁজ রাখা হচ্ছে।

বান্দরবান

আটদিনের অবিরাম বৃষ্টিতে বান্দরবানে বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে নিম্নাঞ্চলের প্রায় দশ হাজারেরও বেশি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অবিরাম বর্ষণ অব্যাহত থাকায় উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে।

বৃষ্টির কারণে বান্দরবান-কেরানীহাট সড়কের বাজালিয়ার বড়দুয়ারা এলাকার রাস্তা তলিয়ে যাওয়ায় ও বান্দরবান-রাঙামাটি সড়কের কয়েকটি স্থানে সড়ক ধসে গিয়ে জেলার সাথে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ ৫ম দিনের মতো বন্ধ রয়েছে।

অবিরাম বর্ষণ অব্যাহত থাকায় নদীর পানি প্রবেশ করে শহরের আর্মিপাড়া, ইসলামপুর, অফিসার্স ক্লাব, বনানী স মিল এলাকা, শেরেবাংলা নগর, বাস স্টেশন, সাঙ্গু নদীর তীরবর্তী এলাকাসহ কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে।

এছাড়া জেলার লামা, আলীকদম ও থানচি, রুমা উপজেলায় নিম্মাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বিভিন্ন উপজেলায় ছোট ছোট পাহাড় ধস ও সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় জেলার সাথে সব উপজেলারও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।

এদিকে বন্যা ও পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে বসবাসকারী ১২০০টি পরিবারকে জেলার ১৩১টি আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে।

রাঙামাটি

ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে রাঙামাটির দুর্গম বাঘাইছড়ি উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে গৃহবন্দি হয়ে পড়েছে কয়েক হাজার মানুষ। শুক্রবার (১২ জুলাই) দুপুর থেকে বাঘাইছড়িতে মুষলধারে বৃষ্টিপাতের কারণে ও পাহাড়ি ঢলে পানির উচ্চতা আরও বেড়েছে।

উপজেলার ২৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া মানুষ এখনও আশ্রয়কেন্দ্রেই অবস্থান করছেন। শুক্রবার সকালে বাঘাইছড়ির প্লাবিত এলাকা পরিদর্শনে যান রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমা। এসময় তিনি এলাকাবাসী খোঁজখবর নেন এবং প্লাবিত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে নগদ টাকা বিতরণ করেন।

বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আহসান হাবিব জিতু জানান, যদি আরও বৃষ্টিপাত হয় তাহলে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী আমরা ৩২৭ পরিবারের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেছি। খাবার পানির সংকট মোকাবিলায় প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রে পর্যাপ্ত পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও খাবার স্যালাইন বিতরণ করা হয়েছে।

সিলেট

সিলেটে প্রবল বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে গোয়াইনঘাট উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে আবারও বন্যা দেখা দিয়েছে। পাহাড়ি ঢলের পানিতে নিম্নাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

বন্যায় উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এছাড়া দুটি পাথরকোয়ারিও বন্ধ রয়েছে। অনেকের বসতঘরে পানি ওঠায় গবাদি পশু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন। পাশাপাশি অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্যার পানিতে প্লাবিত হওয়ায় পাঠদান বন্ধ রয়েছে।

সারাবাংলা/পিটিএম

পাহাড়ি ঢল বন্যা বৃষ্টি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর