প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেই কিন্তু বিনামূল্যে মিলছে ডেঙ্গুর চিকিৎসা
১৫ জুলাই ২০১৯ ১৩:৩৭
ঢাকা: রাজধানীতে ক্রমেই বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। সেই সঙ্গে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের সংখ্যাও। স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার তথ্য অনুযায়ী গত ২৪ ঘণ্টায় শুধু রাজধানীতে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৫২ জন রোগী।
কিন্তু বছর জুড়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশার ঔষুধ ছিটালেও কার্যত তেমন কোনো ফল পাননি নগরবাসী। উল্টো ক্রমেই ভয়াবহ হচ্ছে এ রোগের প্রকোপ। ঘটছে মৃত্যুও। এ অবস্থায় সমালোচনার মুখে পড়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) আজ থেকে ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিম নামানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই টিম ডেঙ্গু আক্রান্তদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেবে।
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিষেধক নয়, প্রতিরোধেই কার্যকর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে এমন কার্যক্রম জনগণের সঙ্গে আরেকটা উপহাস হবে। তারা বলছেন, ‘একটা দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান যখন মশা বা তার রোগ প্রতিরোধের কাজে কোটি টাকা খরচ করেও ব্যর্থ হয়, তখন সেটি যেমন দুঃখজন। তেমনি প্রতিষেধক নিয়ে যখন মাঠে নেমে আরও অর্থ খরচ করা হবে কিন্তু স্থায়ী সমাধান মিলবে না তাও দুঃখজনক।’
এদিকে নগরবাসী বলছেন, যারা আক্রান্ত হয়েছে তাদেরকে ওষুধ দেওয়া হবে এটা নিশ্চয় ভালো উদ্যোগ। কিন্তু যারা এখনও সুস্থ আছে তারা যে এ রোগে আক্রান্ত হবে না সেটি নিশ্চিত করবে কে?
ডিএসসিসির স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে জানা যায়, ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য বিনামূল্য ওষুধ সরবরাহ এবং পরামর্শ দিতে ১৫ জুলাই থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত পক্ষকালীন স্বাস্থ্য সেবা চলবে।
ডিএসসিসির ৫টি অঞ্চলের ৫৭টি ওয়ার্ডের ৪৭৬টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ৬৮টি ভ্রাম্যমাণ টিম চিকিৎসা সেবা ও বিনামূল্য ওষুধ বিতরণ করবেন। আর প্রতিটি টিমে দু’জন অ্যাসিসস্টেন্ট মেডিকেল অফিসার, দুজন হ্যাল্পিং হ্যান্ড (চিকিৎসকদের সহায়তাকারী) এবং একজন ওয়ার্ড সচিবসহ মোট ৫ জন সদস্য থাকবেন। কোথাও কোথাও একজন ওয়ার্ড সচিব দু’টি টিমেও সমন্বয় করে কাজ করবে বলেও জানা গেছে।
পরীবাগের বাসিন্দা ফারজানা মির বলেন, ‘পাশের ফ্লাটে একই পরিবারের দুজন ডেঙ্গু আক্রান্ত। এ এলাকায় মশার ওষুধ না ছিটিয়ে, প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিশ্চিত না করে কর্তপক্ষ কি করে প্রতিষেধক নিয়ে মাঠে নেমেছেন?’
সেগুনবাগিচার বাসিন্দা মীর বরকত বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বছরব্যাপী মশার ওষুধ ছিটানোর কথা থাকলেও কালভদ্রে দেখা মিলে এই কার্যক্রমের। তাও আবার শুনছি মশার ওষুধের কার্যকারিতাও নেই।’ এখন নতুন করে যে কার্যক্রম শুরু করবে বিনামূল্যে ঔষুধ দেয়ার জন্য সেটিও যে তেমন হবে না তা নিশ্চিত করবে কে, প্রশ্ন মীর বরকতের।
ধোলাইপাড় এলাকার বাসিন্দা শেখ মিজান বলেন, ‘আমরা তো বিনামূল্যে চিকিৎসা চাই না। আমরা তো রোগ যেন না হয় সেটা চাই। এখন যদি বলে রোগ হলেই ওষুধ দিবে তাহলে কি ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হয় না? মশা না মেরে যদি মশার কামড়ে রোগ হয় সে রোগের ওষুধ দেয়ায় কি সিটি করপোরেশনের কাজ?’
ডেঙ্গু রোগীদেরকে বিনামূল্য চিকিৎসা দিতে ডিএসসিসির ঔষুধ নিয়ে মাঠে নামার বিষয়ে খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা ফারুক আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগীদের বিনামূল্য ওষুধ দিতে মাঠে নামবে ভালো কথা। কিন্তু আমরা যারা সুস্থ আছি এখনও তারা যে সামনের দিনগুলোতে এ রোগ থেকে সুস্থ থাকতে পারবো তা নিশ্চিত করবে কে?’
নগর বিশেষজ্ঞ ইকবাল হাবীব সারাবাংলাকে বলেন, ‘শুধু ওষুধের গল্প বলে, ফগার মেশিনের ধোঁয়া ছিটিয়ে এ অকাল অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ যেমন নেই, তেমনি এটা এক ধরণের প্রতারণাও বটে। আপনি প্রতিষেধক দিবেন কিন্তু প্রতিরোধ করবেন না এটি আরও একটি দুর্ভাগ্য জনগণের জন্য। মনে রাখা দরকার অবশ্যই কেউ অসুস্থ হলে সাহায্য করবেন, ব্যবস্থা নিবেন। কিন্তু এটা আশ্বস্তও করতে হবে- আর যেনো আমার সন্তান, মা-বাবা কিংবা আমার পরিবার অসুস্থ না হয়। সেটা আগে নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’
নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনাবিদ ও জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘রোগের প্রতিষেধক নিয়ে ডিএসসিসি যে উদ্যোগ নিয়েছে তার জন্য ধন্যবাদ জানাই কিন্তু যে জন্য এ রোগের প্রকোপ সেটি আগে প্রতিরোধ নিশ্চিত করাটাই হবে কার্যকর কিংবা স্থায়ী সমাধান। কিন্তু তা না করে অসুখ হলেও ওষুধ দিব কিন্তু প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে না- তাহলে উদ্যোগটি ব্যর্থ হবে। এজন্য অবশ্যই প্রতিষেধকের পাশাপাশি প্রতিরোধের বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।’
এ বিষয় জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. শরীফ আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘যেহেতু মশার ওষুধ ছিটানোর পরও রোগ প্রতিরোধে কার্যকর ফল মিলছে না। তাই ডিএসসিসি সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রতিরোধের পাশাপাশি প্রতিষেধকও ভুক্তভোগী নাগরিক কিংবা রোগীর নাগালে পৌঁছে দিবে বিনামূল্যে। এজন্য চাহিদাপত্র দিয়ে আমরা বিপুল সংখ্যাক চিকিৎসক নিয়ে ১৫ জুলাই থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত স্বাস্থ্য সচেতনসহ ডেঙ্গু রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করতে ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিম পরিচালনা করবো। আশা করছি এর মধ্য দিয়ে দুটি কাজ হবে, একটি হলো রোগী ওষুধ পাবে এবং অন্যটি হলো এ রোগের প্রতিকারে জনসচেতনাতা বৃদ্ধির কার্যক্রম আরও ব্যাপকতা লাভ করবে। কারণ জনসচেতনার অভাবই এ রোগের বড় কারণ।’
ডিএসসিসির মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ডিএসসিসি এলাকার সর্বত্রই মশার ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছি। কিন্তু নগরবাসীর একটা অভিযোগ মশার ওষুধ কাজ করছে না আশানুরূপভাবে। তাই বিষয়টি আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছি। কারণ আমরা সরকারিভাবেই এসব ওষুধ তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করি। তাই তারা বিষয়টি অবগত হয়েছেন এবং তারা ওষুধগুলো ল্যাবে পরীক্ষার জন্য নিয়েছেন। তারা আমাদের জানিয়েছেন যদি ওষুধগুলো মানহীন হয় তাহলে নতুন ওষুধ দিবে। কিন্তু তা পেতেও কিছুটা সময় লাগবে। তাই এ সময়ে যাতে রোগটি ব্যাপকতা বিস্তার করতে না পারে সেজন্য আমরা নিজ উদ্যোগে নগরবাসীকে চিকিৎসা সেবা দিবো। তাই যদি কোনো নগরবাসী ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হন তাহলে নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগাযোগ করলে বিনামূল্য চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ বিতরণ করবে ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিম।’
গত ১৪ দিনে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছে ২ হাজার ১৬৪ জন। যা গত পুরো মাসে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের দেড় গুণ। জানুয়ারি মাসে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৭৫৯ জন। আর এরই মধ্যে চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।
আরও পড়ুন:
শিক্ষক অনশন, ডেঙ্গু জ্বরে একজনের মৃত্যু
আপেল কলা নিয়ে ডেঙ্গু রোগীর বাসায় মেয়র
সারাবাংলা/এসএইচ/এমও/জেডএফ