অকার্যকর মশার ওষুধ নিয়ে ডিএসসিসিতে ধোঁয়াশা
২৫ জুলাই ২০১৯ ১০:০৪
ঢাকা: প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। সেইসঙ্গে বাড়ছে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার হারও। শিশু থেকে বৃদ্ধ, কেউ রেহাই পাচ্ছে না এডিস মশাবাহিত এই রোগ থেকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বছর এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ৬ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। সেইসঙ্গে মৃত্যু ঘটেছে এখন পর্যন্ত ৫ জনের।
ডেঙ্গু নিয়ে সরকারি তথ্যে গড়মিল!
ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি রাজধানী ঢাকায়। তাই এর জন্য নগরবাসী দায়ী করছেন মশা নিধনে নিয়োজিত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ও উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়রসহ সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে ডিএনসিসি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেও ডিএসসিসি এখনও ধোঁয়াশায় রয়ে গেছে।
সম্প্রতি ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়লে জনমনে মশা মারার ওষুধ নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। শুরু থেকে নগরবাসীদের কেউ কেউ বলছেন, ঠিকমত ওষুধ ছিটানো হচ্ছে না। যে কারণে নিয়ন্ত্রণ আসছে না মশার উপদ্রবে। আবার কেউ কেউ বলছেন, ঠিকমত ওষুধ ছিটালেও মরছে না মশা। তাদের অভিযোগ মশার ওষুধের কার্যকারিতা নেই। এমন অভিযোগ বছরভর থাকলেও দুই সিটির কেউ আমলে নেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নগরবাসীর অভিযোগ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয় কিনা সেটি দেখতে ডেঙ্গু মশা নিধনে ব্যবহৃত ওষুধ নিয়ে স্বপ্রণোদিত হয় গবেষণা শুরু করেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)। তাদের সঙ্গে যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডিজেস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)-এর গবেষকরা। আর এ গবেষণায় আইসিডিডিআরবি এবং সিডিসির ৩ জনসহ ৬ জন গবেষক ৬ মাসের মত সময় নিয়ে গবেষণা শেষে তারা দেখতে পান মশা মারতে যে ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে সেটির মূল উপাদানটি অকার্যকর। আর এ বিষয়টি তারা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্টদের অবহিত করেন।
গবেষণার প্রতিবেদনটি পাওয়ার পর ডিএনসিসি বিষয়টি আমলে নিয়ে তাদের ব্যবহৃত দ্য লিমিট অ্যাগ্রো প্রডাক্ট লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানের ‘লিমিট লিকুইড ইনসেকটিসাইড’ নামের ওষুধটি পরীক্ষার জন্য আইইডিসিআরে পাঠায়। সেখানে তিন ধাপে প্রতিষ্ঠানটির ওষুধ অকার্যকর বলে প্রমাণ হয়। যেকারণে প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভূক্ত করেছে ডিএনসিসি। সেইসঙ্গে বর্তমানে মশা নিধনে ডিএনসিসি নকন লিমিটেডের ‘নকন মসকিউটো ইনসেকটিসাইড’ নামের ওষুধটি ব্যবহার করছে।
কিন্তু গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী মশার ওষুধ অকার্যকর বলার পর ডিএনসিসি বিষয়টি আমলে নিলেও ডিএসসিসি এখনও ধোঁয়াশায় রয়ে গেছে। সরকার অনুমোদিত আইইডিসিআরের স্বীকৃতি ছাড়া সংস্থাটি কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না বলে মত দিচ্ছেন। আর ওই প্রতিষ্ঠানটি পরীক্ষার ফল ঘোষণার আগ পর্যন্ত অকার্যকর ওষুধ দিয়ে মশা মারার যে কাজ করবে ডিএসসিসি সেটি সময় নষ্ট এবং নগরবাসীকে আরও বেশি ভোগান্তিতে ফেলা বলে মনে করেন গবেষককরা।
গবেষণাটিতে যুক্তথাকা আইসিডিডিআরবি’র একজন গবেষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘গবেষণাটিতে আমরা যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছি সেটি আন্তর্জাতিক পদ্ধতি। আর আমাদের গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান সিডিসির গবেষকরাও ছিলেন। তারপরও গবেষণাটি আমলে নিচ্ছে না ডিএসসিসি। তারা সরকার অনুমোদিত সংস্থার স্বীকৃতির জন্য অপেক্ষা করছে। আর সে সংস্থাও বিষয়টি পরীক্ষা করবেন বলে জানিয়েছে। কিন্তু পরীক্ষা তো এক দুদিনে শেষ হবে না। আমরা যেটিকে বলেছি অকার্যকর ওষুধ, সেটি যদি আইইডিসিআরেও প্রমাণ হয় তাহলে যে সময়টা নষ্ট করা হচ্ছে তার দায় কে নেবে।
এ গবেষক আরও বলেন, ‘মশা মারার জন্য পারমেথ্রিন, টেট্রামেথ্রিন এবং অ্যালাথ্রিন নামের ওষুধগুলো ব্যবহার করা হয়। উপাদানগুলোর মধ্যে পারমেথ্রিন মশাকে মেরে ফেলে, টেট্রামেথিন মশাকে দুর্বল করে দেয় এবং অ্যালাথ্রিন মশাকে ওষুধের প্রতি আকৃষ্ট করতে কাজ করে। কিন্তু বর্তমানে মশা এগুলো প্রতিরোধী হয়ে উঠছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। ’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গবেষণার সমন্বয়ক ও আইসিডিডিআরবির সহযোগী বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ শফিউল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘যেহেতু আমরা বৈজ্ঞানিক গবেষণা করেছি সেহেতু আমাদের চেষ্টা ছিল স্টান্ডার্ড মানের কোনো উপাদান নিয়ে পরীক্ষা করতে। সে হিসেবে আমরা মশা মারার তিনটি উপাদানের সবগুলো না নিয়ে শুধু মশাকে মেরে ফেলে ‘পারমেথ্রিন’ উপাদানটি নিয়েই গবেষণা করেছি। আর এতে যখন দেখা গেলো মশা প্রতিরোধী তখন বাকি সহযোগী দুই উপাদান নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন পড়ে না। সেগুলোর তো কার্যক্ষমতা আরও কম।’
তিনি আর বলেন, ‘ডিএসসিসি বলছে তাদের ব্যবহৃত ওষুধ নিয়ে তো আমরা গবেষণা করিনি। সুতরাং তাদের ওষুধ পরীক্ষা করা ছাড়া অকার্যকর বলা যাবে না। কিন্তু আমরা বাজারে যেটা সেরা ওষুধ সেটা নিয়েই গবেষণা করেছি। যেটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা হয়। ’
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘বাজারে প্যারাসিটামলের একাধিক নামে ওষুধ আছে। নাপা, প্যারাপাইরলসহ একাধিক ওষুধ। কিন্তু কেউ যদি প্যারাসিটামল নিয়েই গবেষণা করতে চাই তাহলে যেটি ভালো মানের সেটি নিয়েই গবেষণা করবে- এটাই স্বাভাবিক। আর আমরাও তাই করেছি। এক্ষেত্রে আমরা ডিএসসিসির ওষুধের নমুনা সংগ্রহ করিনি ঠিক। কিন্তু ওষুধের মান তো একই।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন সারাবাংলা বলেন, ‘আমরা তাদের রিপোর্ট ভুল বলিনি। কিন্তু স্বীকার করলেও আমাদের সরকার মনোনীত একটি প্রতিষ্ঠান আছে আইইডিসিআর। তাদের নির্দেশনা ছাড়া আমরা তো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। যদি ধরে নিই আমাদের ওষুধের কোনো কার্যকারিতা নেই। তবুও সেটি পরীক্ষা করে বলতে হবে। আর তা পরীক্ষা করবে আইইডিসিআর।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু এর অকার্যকরিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সেহেতু বিষয়টি দ্রুত নিরসনের জন্য আমরা আইইডিসিআরকে আমাদের ব্যবহৃত ওষুধ পরীক্ষার জন্য বলেছি। তারা পরীক্ষা করে এক সপ্তাহের মধ্যে আমাদেরকে ফলাফল জানাবে। আর এই কয়েকদিন আপাতত এ ওষুধই চলবে। প্রয়োজনে মশক নিধন কর্মীরা ওষুধ ধীর গতিতে ছিটাবে।’
আরও পড়ুন:
একদিনে হাসপাতালে ৫৬০ ডেঙ্গু রোগী, শুধু ঢামেকেই ১৪৫