বন্যা কমতে শুরু করেছে, এ পর্যন্ত মৃত্যু ১১৪ জনের
২৭ জুলাই ২০১৯ ১৫:৩৯
ঢাকা: যমুনা ও কুশিয়ারা ছাড়া দেশের অন্য নদীগুলোর পানি কমতে শুরু করেছে। তবে, উত্তরাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের ডুবে যাওয়া জেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতি আরও ২৪ ঘন্টা স্থিতাবস্থায় থাকবে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
এদিকে বন্যায় এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলায় ১১৪ জন মারা গেছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কন্ট্রোল রুম। ২৩ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন জেলায় মৃতের সংখ্যা ৮৭ থাকলেও গত চারদিনে আরও ২৭ জন মানুষ বন্যার কারণে মারা গেছে। পানিতে ডুবে, ডায়রিয়া, সাপের কামড়, বজ্রপাত, বিদ্যুতায়িতসহ পানিবাহিত অন্যান্য রোগে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান সারাবাংলাকে জানান, ‘বন্যাকবলিত জেলাগুলো থেকে ধীরে ধীরে পানি সরে যেতে শুরু করেছে। ফলে দেশের উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি দেখা যাচ্ছে। তবে বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া জেলাগুলো আরও একদিন একইরকম অবস্থায় থাকতে পারে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানাচ্ছে, শনিবার সকাল নয়টা পর্যন্ত সুরমা নদী কানাইঘাটে বিপৎসীমার ৩৬ সেন্টিমিটার, সিলেটে ১ সেমি, সুনামগঞ্জে ২০ সেমি, শ্যাওলায় ১৫ সেমি। এছাড়াও ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় তিতাস নদী বিপৎসীমার ২৬ সেন্টিমিটার, সোমেশ্বরী নদী কমলাকান্দায় ১ সেমি, ধরলা নদী কুড়িগ্রামে ৪৬ সেমি, ঘাঘট নদী গাইবান্ধায় ২৭ সেমি, ব্রহ্মপুত্র নদী চিলমারিতে ৩২ সেমি, যমুনা নদী ফুলছড়িতে ৫৩ সেমি, বাহাদুরাবাদে ৫৫ সেমি, সারিয়াকান্দিতে ২৫ সেমি, সাজুপুরে ২৫ সেমি, সিরাজগঞ্জে ১৩ সেমি, আত্রাই নদী বাঘাবাড়িতে ২৫ সেমি, ধলেশ্বরী নদী ৪৪ সেমি, পদ্মা নদী গোয়ালন্দ পয়েন্টে ৭ সেমি উপর দিয়ে বইছে।
আরিফুজ্জামান জানান, যমুনা ছাড়া বাকি নদীগুলোর পানি কমছে। কুশিয়ারা ছাড়া দেশের সব নদীর পানি কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হতে পারে, মধ্যাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
এদিকে, আবহাওয়া অফিস জানাচ্ছে আগামী ২৪ ঘন্টায় সারাদেশে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, বৃষ্টিপাত হলেও আজকালের মধ্যে পানি বাড়ার সম্ভাবনা কম। তবে উজান থেকে ঢল নামলে এই সপ্তাহে আবারও পানি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এবারের বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার পাশাপাশি মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছাবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে, বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকটও তীব্র হবে। বাড়বে পানিবাহিত রোগ।
নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চল তলিয়ে যাওয়ার পর কুড়িগ্রাম জেলায় এবার নদী ভাঙন প্রকট আকার ধারণ করেছে। সারাবাংলার স্থানীয় সংবাদদাতা জানাচ্ছেন, এই জেলায় যে এলাকাগুলো প্লাবিত হয়নি সেগুলো ভাঙনের কবলে পড়েছে। এ কারণে অনেক গ্রাম ব্রহ্মপুত্রের পেটে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া গত তিনদিনে এই জেলায় প্রায় ৩০০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
দ্বিতীয় দফায় বন্যার কারণে কুড়িগ্রামের সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। খাদ্য সংকটের পাশাপাশি ছড়িয়ে পড়েছে পানিবাহিত রোগ। রাস্তাঘাট ও তৃণভূমি ডুবে যাওয়ায় গবাদি পশুর খাদ্যও পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। রেল লাইনের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় কুড়িগ্রাম-চিলমারী রুটে ট্রেন চলাচলও বন্ধ রয়েছে।
তবে এই জেলায় বন্যার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিশুরা। কারণ জেলাটিতে গত এক সপ্তাহে পানিতে ডুবে ১৭ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও চারজন মারা গেছেন বজ্রপাত, সাপের কামড়সহ অন্যান্য পানিবাহিত রোগে। কুড়িগ্রামে বন্যা কবলিত প্রায় সাড়ে ৯ লাখ মানুষের জন্য এ পর্যন্ত সরকারিভাবে ১ হাজার মেট্রিক টন চাল, ১০ হাজার ৫শ প্যাকেট শুকনো খাবার ও ২০ লাখ টাকা এবং শিশু ও গবাদি পশুর খাদ্যের জন্য ৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
জামালপুরে যমুনার পানি বাড়লেও বন্যা পরিস্থিতি আগের মতই অপরিবর্তিত রয়েছে। এই জেলার ২৫ হাজার ৯শ হেক্টর ফসলি জমি এবং ৪ লাখ ৫০ হাজার গবাদি পশু বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়াও তিন লাখ পরিবারের প্রায় ১৩ লাখ মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এই জেলায়। ৫০ হাজার ঘরবাড়িও বন্যায় নষ্ট হয়েছে। জামালপুরে বন্যার পানি প্রবেশ করায় সাত উপজেলায় মোট ২৯৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৬১টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২৯টি মাদরাসা এবং ৫টি কলেজ পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এই জেলার সাত উপজেলায় ৫৮টি ইউনিয়নের মানুষ এখনো পানিবন্দী। এর মধ্যে ৪০টি ইউনিয়নের দেড়শর মতো গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ বন্যার কারণে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতো মানুষকে সহায়তা করার জন্য ১০৫ টন চাল ও দেড় লাখ টাকা দিয়েছে জেলা প্রশাসন।
বন্যা কবলিত জেলাগুলোর মধ্যে জামালপুর ও গাইবান্ধায় পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বেশি বলে জানা গেছে। জেলা দুটোর দুর্গত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে ডায়রিয়া, আমাশয়সহ বিভিন্ন রকমের চর্মরোগও। এদেরকে সেবা দেওয়ার জন্য ৫৭টি মেডিকেল টিম কাজ করছে দুর্গত এলাকায়। এছাড়াও, বগুড়া জেলার গাবতলী, শেরপুর, ধুনট ও সোনাতলার ২৯টি ইউনিয়নের ২ লাখ ৩৫ হাজার মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টাঙ্গাইলে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। পানি কমলেও শরীয়তপুরে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে।
দেশের ২৮ জেলা এখনো বানের জলে তলিয়ে রয়েছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে। এর মধ্যে ১১ জেলার বন্যা পরিস্থিতি এখনও ভয়াবহ। কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, জামালপুর, সিলেট, রাজবাড়ী, টাঙ্গাইল, নাটোর, বগুড়া ও মৌলভীবাজার জেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সড়ক যোগাযোগ ও অবকাঠামোর। এই এগারোটি জেলায় বেশিরভাগ রাস্তা ও ব্রিজ কালভার্ট ভেঙে পড়েছে।
সুনামগঞ্জ জেলার ৬৭টি ইউনিয়নে দেড় লাখেরও বেশি মানুষ এখনো পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। জেলার ৬৭টি ইউনিয়নের সাত হাজারের বেশি ঘরবাড়ি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়াও, এই জেলায় বন্যার কারণে এক সপ্তাহে প্রায় সাতজন মানুষ মারা গেছে। পুরো জেলায় এক হাজার ১১৮ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি সাড়ে পাঁচশর মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে।
এছাড়াও, বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে দেড় হাজারের মতো মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এদের সেবা দেওয়ার জন্য ২ হাজার ৪৩০টি মেডিকেল টিম কাজ করছে।