৫২ জেলায় হবে পানি পরীক্ষাগার, খরচ ১৭৮ কোটি টাকা
৭ আগস্ট ২০১৯ ১১:০৩
ঢাকা: বর্তমানে দেশে পানির গুণগত মান পরীক্ষার জন্য রয়েছে ১২টি পানি পরীক্ষাগার। সারাদেশের সব জেলার পানি পরীক্ষার জন্য এই পরীক্ষাগারগুলো যথেষ্ট নয়। অন্যদিকে, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রতিটি জেলার বিভিন্ন উৎসের পানির গুণগত মান পরীক্ষা করাটাও জরুরি। এ পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের জন্য নিরাপদ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে পানির গুণগত মান পরীক্ষায় বাকি ৫২টি জেলাতেও পানি পরীক্ষাগার স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আর এর জন্য ১৭৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা খরচে ‘পানির গুণগতমান পরীক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ’ নামের একটি প্রকল্প হাতে নিচ্ছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নতুন পরীক্ষাগার স্থাপনের মাধ্যমে পানি পরীক্ষা কার্যক্রম শক্তিশালী ও গতিশীল হবে এবং রক্ষণাবেক্ষণ কাজের সক্ষমতাও বাড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, প্রকল্পটি প্রস্তাব পাওয়ার পর চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় দেওয়া সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পুনর্গঠন করা হয়েছে। এখন প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপন করা হবে। অনুমোদন পেলে চলতি বছর থেকে ২০২২ সালের জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্র জানায়, সব কাজে নিরাপদ পানি ব্যবহার করা জনস্বাস্থ্য রক্ষার অন্যতম উপায়। রাসায়নিক দ্রব্য ও জীবাণুর উপস্থিতির কারণে দূষিত পানি পান করা ও গৃহস্থালী কাজে ব্যবহার করার ফলে জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ে। সার্বিকভাবে আমাদের দেশে পানি সরবরাহ ব্যবস্থার আওতা বাড়ার হার সন্তোষজনক হলেও সরবরাহ করা পানির বিশুদ্ধতা সম্পর্কে প্রায়ই ব্যবহারকারীরা অনিশ্চিয়তায় ভোগেন।
এদিকে, বর্তমানে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া ও নলকূপের পানিতে মাত্রারিক্ত আর্সেনিকের উপস্থিতি বাংলাদেশের বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ ব্যবস্থার জন্য বিরাট হুমকি বলেও মনে করছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এ কারণেই পানির মান পরীক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের পানির গুণগত মান পরীক্ষার জন্য যেসব পরীক্ষাগার রয়েছে, তার মধ্যে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের পরীক্ষাগারগুলো অন্যতম। অধিদফতর আশির দশকে প্রথম পানি পরীক্ষাগার স্থাপন করে। বর্তমানে এই অধিদফতরের অধীন ১১টি আঞ্চলিক পানি পরীক্ষাগার এবং ঢাকায় একটি কেন্দ্রীয় পানি পরীক্ষাগারসহ মোট ১২টি পরীক্ষাগার রয়েছে। কোনো স্থানের ভূ-গর্ভস্থ পানির মান সম্পর্কে তথ্য অনুসন্ধান করা ও পানির উৎসগুলোর গুণগত মান নিশ্চিত হওয়ার জন্য এসব পরীক্ষাগারে পানি পরীক্ষা করা হয়।
বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকা থেকেও পানির নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা করার মাধ্যমে সেই পানির গুণগত মান সম্পর্কে জানা যায়, যা বাংলাদেশের পানি সরবরাহ ব্যবস্থাকে আরও মানসম্পন্ন করতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বর্তমানে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের অধীন পরিচালিত এসব পরীক্ষাগার বিভিন্ন দেশি-বিদেশি যন্ত্রপাতি দিয়ে পানির বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষার সুবিধা রয়েছে। এসব অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি অত্যন্ত ব্যয়বহুল, এমনকি এদের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার কাজেও প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প থেকে কিছু কিছু তহবিল সংগ্রহ করে ১২টি পরীক্ষাগারে পানি পরীক্ষার রাসায়নিক দ্রব্য সংগ্রহ কাজ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। তহবিল ও লজিস্টিক সাপোর্টের অভাবে পানি পরিবীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের নতুন কাজ হাতে নেওয়া সম্ভব হয় না। এছাড়া প্রয়োজনবোধে নতুন নতুন প্যারামিটার পরীক্ষা করে পানির গুণগতমান যাচাই করা প্রয়োজন হতে পারে।
এছাড়া, ঢাকাসহ সারাদেশে ব্যাপক শিল্পায়নের ফলে ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানি জৈব রাসায়নিক দ্রব্য দ্বারা দূষিত হওয়া ছাড়াও এখন নতুন করে ‘ভোলাটাইল অরগ্যানিক কম্পাউন্ডে’র উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যও জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমানে ময়মনসিংহ, রাজশাহী, কুমিল্লা, খুলনা, ঝিনাইদহ, রংপুর, বগুড়া, সিলেট, টঙ্গী, বরিশাল, নোয়াখালী ও ঢাকাসহ মোট ১২টি পানি পরীক্ষাগার রয়েছে। সব পানি পরীক্ষাগার থেকে অনেক জেলার দূরত্ব বেশি হওয়ায় পানি পরীক্ষার জন্য নিয়মিত নমুনা সংগ্রহ ও পরিবহনে জটিলতা দেখা দেয়। ফলে অনেক পানি পরীক্ষার সঠিক ফল পাওয়া যায় না। অধিদফতরে চলমান বিভিন্ন প্রকল্পে স্থাপিত নতুন উৎসের পানি পরীক্ষার জন্য এই ১২টি পানি পরীক্ষাগারের কার্যক্রম ক্রমে বাড়ছে। তাই অনুষ্ঠিত প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) সভার সুপারিশ অনুযায়ী দেশের অবশিষ্ট ৫২টি জেলায় অধিদফতরের বিদ্যমান জেলা অফিসগুলোতে প্রয়োজনীয় কক্ষের ব্যবস্থা করে নতুন ৫২টি পানি পরীক্ষাগার স্থাপনের জন্য এই প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে।
আটটি বিভাগের ৫২টি জেলার মধ্যে ঢাকা বিভাগের জেলাগুলো হলো— নরসিংদী, শরিয়তপুর, নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুর। চট্টগ্রাম বিভাগের জেলার মধ্যে রয়েছে— ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও খাগড়াছড়ি। রাজশাহী বিভাগের জেলাগুলো হলো— সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নাটোর, জয়পুরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ।
এছাড়া, খুলনা বিভাগে যশোর, সাতক্ষীরা, মেহেরপুর, নড়াইল, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মাগুরা ও বাগেরহাট; ময়মনসিংহ বিভাগের শেরপুর, জামালপুর ও নেত্রকোণা; বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ভোলা ও বরগুনা; সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ এবং রংপুর বিভাগের পঞ্চগড়, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা, ঠাকুরগাঁও ও কুড়িগ্রাম জেলা রয়েছে এই প্রকল্পের আওতায়।
এ বিষয়ে প্রকল্পটির দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য শামীমা নার্গিস পরিকল্পনা কমিশনের মতামত দিতে গিয়ে বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সারাদেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য পানি পরীক্ষাগার নেই— এমন ৫২টি জেলা সদরে ৫২টি নতুন পানি পরীক্ষাগার স্থাপন করা হবে। পানি পরীক্ষার সুবিধা তৈরির মাধ্যমে জনসাধারণ নিরাপদ পানি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবে এবং পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ হতে মুক্ত থাকতে পারবে। এতে জনগণের নাগরিক সুবিধা বাড়বে।
৫২ জেলা গুণগত মান পরীক্ষা জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা পানি পরীক্ষাগার