Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কাশ্মিরের রক্তাক্ত ও কলুষিত অতীত


১০ আগস্ট ২০১৯ ১৫:২৪

ব্রিটিশ-শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। দ্বিজাতি তত্ত্বের (মুসলিম-হিন্দু) ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট জন্ম হয় পাকিস্তান ও ভারত নামে দুই রাষ্ট্রের। তবে এই অঞ্চলের কিছু কিছু ভূখণ্ডের ব্যাপারে তখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকরা। ওসব এলাকায় ক্ষমতায় যারা ছিলেন তাদেরকেই বলা হয় তাদের নিজেদের ব্যাপারে ভাবতে । বর্তমান সংকটে থাকা জম্মু ও কাশ্মিরের কপালে ঘটেছিল এমনটাই । যার পরিক্রমা ভালো হয়নি।

বিজ্ঞাপন

কাশ্মির কোথায়? কিভাবে সংকট শুরু জম্মু ও কাশ্মিরে?

ভারত-পাকিস্তান-চীনের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় উপত্যকায় ঘেরা কাশ্মির। কাশ্মিরকে বলা হয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। যেটি তকমা পেয়েছে ভূ-স্বর্গ নামে। জম্মু ও কাশ্মিরের মোট আয়তন প্রায় ২ লাখ ২২ হাজার ২৩৬ বর্গ কিলোমিটার। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগের পর জম্মু ও কাশ্মির নিজের সিদ্ধান্তে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। ভূখণ্ডটির শাসকদের একাংশ ভারতের সঙ্গে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা-প্রকাশ করেছিলেন। তবে মুসলিম জনগণের ইচ্ছা ছিল নবগঠিত মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার। তবে প্রজাদের মনোবাসনা বুঝতে পেরে শাসনে থাকা হিন্দু রাজা হরি সিং আপাতত নিজেদের মতোই স্বাধীন থাকার সিদ্ধান্ত নেন।

কিন্তু জম্মু ও কাশ্মির নিয়ে অস্থিরতা শুরু হতে সময় লাগেনি। পাকিস্তান আর্মি মুসলিম জনসমর্থনে ভর দিয়ে বিভিন্ন পশতুন আদিবাসীদের দিয়ে জম্মু ও কাশ্মিরে আক্রমণ ও অস্থিরতা তৈরির পাঁয়তারা করে। অপরদিকে পাকিস্তান সংলগ্ন কাশ্মিরের কিছু এলাকায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরিরা রাজা হরি সিংয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। দেশবিভাগের বছরে অক্টোবরের শুরু থেকে মাস-জুড়ে চলতে থাকে এসব অস্থিরতা।

পরিস্থিতি অনুকূলে নয় বুঝতে পেরে মহারাজা হরি সিং ভারতকে জানান জম্মু ও কাশ্মিরকে তিনি ভারতের হাতে তুলে দিতে চান। তবে এতে সময় লাগবে। তবে ভারতের পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে বলা হয় কাশ্মিরের জনগণের অনিচ্ছায় ভারত এই দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত নয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুও জম্মু ও কাশ্মিরে গণভোটের ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

এদিকে পাকিস্তানপন্থি সশস্ত্র বিদ্রোহীরা কাশ্মিরের বিভিন্ন এলাকায় হামলা চালাতে থাকে। থোরার, পুঞ্চ, সালিগ্রাম, ওয়েন, সেনসা, থোরচি বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এসব হামলা ও দখলের তদারকিতে ছিল পাকিস্তান সেনারা।

বিজ্ঞাপন

পরবর্তীতে মহারাজা হরি সিংয়ের অনুরোধে ভারত কাশ্মিরে অভিযান চালাতে সম্মত হয়। তবে তা অবশ্যই ভারতে অন্তর্ভুক্তির শর্তে। ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে সেসময় বলা হয়েছিল এই অন্তর্ভুক্তি  সীমিত সময়ের জন্য হলেও হতে পারে। ভারতীয় সেনারা পাল্টা আক্রমণ চালালে বিদ্রোহী ও পাকিস্তানি সেনারা থেমে যেতে বাধ্য হয়।

ভারত জম্মু ও কাশ্মির ইস্যু নিয়ে ১৯৪৮ সালে নিরাপত্তা পরিষদে অভিযোগ তোলে। জাতিসংঘের প্রস্তাবনায় কাশ্মিরে গণভোটের কথা জানানো হয়। পাকিস্তানকে বলা হয়, সৈন্য প্রত্যাহার করতে ও ভারতকে বলা হয় সৈন্য সংখ্যা একেবারে কমিয়ে আনতে। কিন্তু পাকিস্তান তা অস্বীকার করে। এবং স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়া শুরু হয় কাশ্মিরের।

এরপর, ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে দুদেশের যুদ্ধবিরতি সীমান্ত রেখা নির্ধারিত হয় লাইন অব কন্ট্রোলে। ১৯৫১ সালে ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয় কাশ্মিরে গণভোট অপ্রয়োজনীয়। ভারতের সংবিধানে কাশ্মিরকে নিজেদের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ১৯৫৭ সালে।

চীনও থেমে থাকেনি। ১৯৬২ সালে ভারতের সঙ্গে সিনও-ভারতীয় যুদ্ধ ও পাকিস্তানের সঙ্গে ১৯৬৩ সালে আলোচনায় কাশ্মিরের একটি অংশ দখল করে দেশটি। এটি পরিচিত আকসাই চীন নামে পরিচিত।

বর্তমান জম্মু ও কাশ্মির ভূখণ্ডের আনুমানিক ১ লাখ ৪০ হাজার ৩৬৭ বর্গ কিলোমিটার ভারতের দখলে। পাকিস্তানের দখলে ৭৮ হাজার ১১৪ বর্গ কিলোমিটার আর চীনের দখলে ৩৭ হাজার ৫৫৫ বর্গ কিলোমিটার। অর্থাৎ ভারতের দখলে কাশ্মিরের ৪৩ ভাগ, পাকিস্তানের দখলে ৩৭ ভাগ আর বাকি ২০ ভাগ দখল করেছে চীন।

ভারতের দখলে থাকা কাশ্মিরের দুটি অংশ হলো জম্মু ও কাশ্মির এবং লা-খাদ। জম্মু ও কাশ্মিরের রাজধানী শ্রীনগর। অপরদিকে পাকিস্তানের দখলে আছে, আজাদ জম্মু-কাশ্মির (আজাদ কাশ্মির নামে বেশি পরিচিত) ও বালতিস্তান। আজাদ কাশ্মিরের রাজধানী মুজাফফরাবাদ।

কাশ্মির নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধ হয়েছে কতবার ? কি চায় চীন?

কাশ্মির নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের বৈরিতায় খুব পিছিয়ে নেই চীনও। তারা কাশ্মির অঞ্চলের ২০ ভাগ দখলে নিলেও লাখাদের সীমান্তবর্তী এলাকায় আরও ১০ ভাগ দাবি করে। এদিকে কাশ্মির দখল নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের বিরোধ হয়েছে ১৯৪৭ সালের পরও অনেকবার, অস্থিতিশীল হয়েছে কাশ্মির। যেমন,

  • ১৯৬৫ সালে ১৭ দিনের জন্য যুদ্ধ হয় ভারত-পাকিস্তানের।
  • ১৯৮০ সালে কাশ্মীরিরা নিজেদের স্বাধীনতা নিয়ে তৎপর হয়। ঘটে কিছু সংঘর্ষ।
  • ১৯৮৪ সালে ভারতীয় আর্মি সিয়াচেন হিমবাহ নিয়ন্ত্রণে নেয়।
  • ১৯৯০ সালে ভারত-শাসিত কাশ্মিরে আন্দোলনে অন্তত ১০০ জনকে হত্যা করে ভারতীয় সেনারা।
  • ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধে উভয় দেশের অনেক সৈন্য হতাহতের ঘটনা ঘটে।
  • ২০০১-২০০৪ সালে দুদেশের সম্পর্কোন্নয়নে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তবে সেসব ফলপ্রসূ হয়নি।
  • ২০১০ সালে আন্দোলনকারীরা আবারও হত্যার শিকার হয় ভারতীয় সেনাদের হাতে।
  • ২০১১ সালে সীমান্তে গোলাগুলিতে ভারতীয় সেনারা পাকিস্তানের তিন সেনাকে হত্যা করে।
  • ২০১৩ সালে ভারত ও পাকিস্তানের নেতারা আবারও বৈঠক করেন বিতর্কিত সীমানা নিয়ে বিরোধ নিরসনে।
  • ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি আবার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কাশ্মিরে সন্ত্রাসবাদ ছড়ানোর অভিযোগ আনেন। এবছরই দুদেশে সীমান্তে গোলাগুলিতে অন্তত ১৮ জনের প্রাণহানি ঘটে।
  • ২০১৫ সালে কাশ্মিরে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের আন্দোলনে বিক্ষোভ হয়।
  • ২০১৬ সালে ৫০ দিনের সংঘর্ষে কাশ্মিরে প্রাণ যায় অন্তত ৫০ জনের। দেওয়া হয়েছিল কারফিউ। পাকিস্তানে সার্জিকাল স্ট্রাইকের কথা জানায় ভারত।
  • ২০১৭ সালে বিদ্রোহীদের চোরাগোপ্তা হামলায় ভারত-শাসিত কাশ্মিরে ১৭ জন হিন্দু পুণ্যার্থীর মৃত্যুর পর আবারও অস্থির হয় কাশ্মির।
  • ২০১৯ সালে কাশ্মিরের বিশেষ রাজ্য মর্যাদা বাতিলের ঘোষণা দেয় মোদি শাসিত বিজেপি সরকার।

ভারত-শাসিত নাকি পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মিরীরা বেশি ভালো আছে?

১৯৪৯ সালে জারি করা নিয়মে, ভারতের সংবিধানে ৩৭০ ধারায় কাশ্মিরকে বিশেষ অঙ্গরাজ্যের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। এতে কাশ্মিরের জনগণ বিশেষ কিছু সুবিধা পেত। যা তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে করা হয়েছিল। কাশ্মীরিদের ছিল নিজেদের সংবিধান ও পতাকা। সেখানে অন্য ভারতীয়রা ভূমি কিনতে পারতেন না। বিয়ের ব্যাপারে ছিল বিধি-নিষেধ। শুধুমাত্র নিরাপত্তা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ ছাড়া বাকি সব সিদ্ধান্ত ছিল কাশ্মিরের নিজস্ব।

তবে মোদি সরকার সম্প্রতি সংবিধানের বিশেষ ওই ধারা বাতিল করেছেন। এছাড়া জম্মু ও কাশ্মিরের বিশেষ রাজ্য মর্যাদা রহিতের পাশাপাশি লাখাদকে করা হয়েছে আলাদা। এতে কাশ্মির নিয়ে নতুন সংকট শুরু হয়েছে। কাশ্মীরিরা হয়েছেন ক্ষুব্ধ।

অপরদিকে পাকিস্তান-শাসিত আজাদ কাশ্মিরেরও রয়েছে পতাকা, সিলমোহর ও আইন পরিষদ। ভারতীয় কাশ্মির অংশের মতো বেশি মাত্রায় অস্থিরতা না হলেও সেখানেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে।

কাশ্মির নিয়ে চলে আসা আন্দোলনে অন্তত ৪২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে বিভিন্ন পরিসংখ্যানে তথ্য উঠে আসে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে একথা স্বীকার করেছেন।

 

সংবাদমাধ্যম বিবিসি ও উইকিপিডিয়া থেকে তথ্যমসূমহ নেওয়া।

কাশ্মির কাশ্মির ট্র্যাজেডি কাশ্মির সংকট পাকিস্তান ভারত

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর