সব পুড়ে ছাই, আশ্রয় স্কুলঘরে
১৭ আগস্ট ২০১৯ ১৪:২০
ঢাকা: পেন্টাগন জিন্স নামের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন এরশাদ হোসেন (২৬)। থাকতেন মিরপুর ৭ নম্বর সেকশনে রূপনগর চলন্তিকা ঝিলপার বস্তির একটি রুমে। স্ত্রী রিনা বেগম (২৬), ছেলে শিবলী (১১) ও মেয়ে এলিনাকে (২) নিয়ে ওই রুমেই তার সংসার। ঈদ করতে গিয়েছিলেন গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরের পার্বতীপুর। শুক্রবার (১৬ আগস্ট) রাতে পরিবার নিয়ে যখন ফিরলেন, ততক্ষণে ২৫শ টাকা ভাড়ার সেই রুমে পেতে বসা সংসার আগুনে পুড়ে ছাই। মেয়ের খেলনা, ছেলের বই-খাতা-স্কুলের পোশাক, নিজেদের যা কিছু সঞ্চয়— সবই ছিল ওই রুমেই। এরশাদ বুঝতে পারছেন না, স্কুল খুললে ছেলেকে কিভাবে পাঠাবেন স্কুলে। ছোট হলেও শূন্য থেকে যে সংসার গড়ে তুলেছিলেন তিলে তিলে, নতুন করে সেই সংসার গড়ে তুলতে পারবেন কি— এমন শঙ্কাই ঘুরপাক খাচ্ছে মনের ভেতরে।
আরও পড়ুন- বস্তির পুড়ে যাওয়া মালামাল যাচ্ছে ভাঙ্গারির দোকানে
শনিবার (১৭ আগস্ট) সকালে কথা হয় এরশাদের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু বিদ্যানিকেতনের তিন তলায় ঠাঁই হয়েছে তার পরিবারের। তবে কতদিন এখানে থাকতে হবে, জানেন না এরশাদ। এরশাদের পরিবারের মতো অন্তত আরও ২০টি পরিবার আশ্রয় পেয়েছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এরশাদের মতো তাদের সবার কপালেই দুশ্চিন্তার ভাঁজ।
আগুনে পুড়ে গেছে ঝিলপাড় বস্তির প্রায় সবকিছুই
শুক্রবার সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে আগুন লাগে মিরপুর ৭ নম্বর সেকশনের চলন্তিকা মোড়ের ঝিলপাড় বস্তিতে। মুহূর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো বস্তিতে। প্রায় ঘণ্টা চারেক পর রাত ১১টায় যখন আগুন নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা দেয় ফায়ার সার্ভিস, ততক্ষণে বস্তির প্রায় তিন হাজার ঝুপড়ি ঘরের কোনোটিই অক্ষত নেই। আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই হয়েছে নিম্ন আয়ের মানুষদের এই বসতি।
শুক্রবার রাতেই বস্তিবাসীদের জন্য আশপাশের পাঁচটি স্কুল খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম। আগুনে পুড়ে নিঃস্ব হওয়া পরিবারগুলোর স্থান হয় সেসব স্কুলেই। তবে সেখানে ‘অসহায়’ অবস্থায় রাত কাটিয়েছেন বলে জানালেন বস্তিবাসীরা।
পুড়ে যাওয়া ঘরেও কি কিছু আছে অবশিষ্ট?
এরশাদ বলেন, মশা কামড়, গরম আর খালি মেঝেতে আর থাকতে পারছি না। সরকারের পক্ষ থেকে খাবার দিয়েছে, খেয়েছি। কিন্তু পানি তো দিচ্ছে না। আর এখানে এই অবস্থায় থাকবই বা কতদিন! কাল (রোববার) ছেলের স্কুল খুলবে। ওর বই-খাতা-শার্ট-প্যান্ট-জুতা তো সব আগুনে পুড়ে গেছে। ও স্কুলে যাবে কিভাবে?
ওই স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন রিনা বেগম। এসেছেন ভোলা থেকে। ২ আগস্ট মায়ের মরদেহ নিয়ে গ্রামে গিয়েছিলেন। মাকে দাফন করে ঈদ পার করে সকালে ফিরে দেখেন যা রেখে গিয়েছিলেন, তার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। যাওয়ার আগে রুমে তালা দিয়ে গিয়েছিলেন। এখন বোঝার উপায় নেই, তার সেই রুমটি কোথায়।
রিনা জানালেন, তিনি গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন বাসায় বাসায়। স্বামী আনোয়ার পোশাক শ্রমিক। দু’জনের মাথা গোঁজার ঠাঁই হবে কোথায়, সেটা ভেবেই কূল পাচ্ছেন না।
ছাই আর কয়লার স্তূপ, তবু চলে সন্ধান
বাবুর্চির কাজ করেন নান্নু মিয়া। তার পাঁচ মেয়ে। দুই মেয়ে কলেজে পড়ে, এক মেয়ের সামনে এসএসসি পরীক্ষা। বাকি দুই মেয়ের এক মেয়ে নবম শ্রেণিতে ও আরেক মেয়ে ক্লাস সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তাদের সবার বই-খাতা, স্কুল-কলেজের পোশাক ছিল বস্তির ওই রুমেই। সবাইকে নিয়ে কোথায় থাকবেন আর মেয়েদের লেখাপড়া কিভাবে চালিয়ে নিয়ে যাবেন— সেটা ভাবার মতো শক্তিটুকু পাচ্ছেন না বলে জানান তিনি।
নান্নু মিয়ার সংকট অবশ্য এখানেই শেষ নয়। তার এক মামার মোবাইলের দোকান আছে, সেই দোকানের এক লাখ টাকা রাখতে দিয়েছিলেন নান্নু মিয়ার কাছে। আগুনের মুখে ছাই হয়েছে সেই টাকাও। নান্নু মিয়া বলেন, মামাকে এখন কী জবাব দেবো? আমার যা গেছে, তা তো গেছেই। কিন্তু মামাকে এখন মুখ দেখাব কী করে!
বঙ্গবন্ধু বিদ্যানিকেতনের একেকটি রুমে আশ্রয় হয়েছে বস্তিবাসীর
নান্নু মিয়াসহ বেশ কয়েকজন বলছেন, ঈদের ছুটির মধ্যে আচমকা এই আগুন কিভাবে লেগেছে, সে বিষয়ে সঠিক তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তাদের অনেকেই ২০-৩০ বছর হলো রয়েছেন এই বস্তিতে। এর মধ্যে কখনো এই বস্তিতে আগুন লাগেনি। তাই এই আগুন নিছক কোনো দুর্ঘটনা নাকি এর পেছনেও ‘অন্য কিছু’ আছে, তা জানতে চান তারা।
বঙ্গবন্ধু বিদ্যানিকেতনে আশ্রয় পাওয়া বস্তিবাসীর অভিযোগ, স্কুলের রুমগুলোতে ফ্যান থাকলেও বিদ্যুৎ না থাকায় তা ঘুরছে না। ফলে তীব্র গরমের এই সময়ে গাদাগাদি করে থাকতে বিশেষ করে শিশুদের প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে খাবার নিয়েও। মেয়র ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিন বেলাই খাবার দেওয়া হবে স্কুলে আশ্রয় নেওয়া পরিবারগুলোকে। সেই ঘোষণা অনুযায়ী রাতে খিচুড়ি দেওয়া হলেও সবার ভাগ্যে তা জোটেনি। আর সকালের খাবার পৌঁছাতে পৌঁছাতেই বেজেছে দুপুর ১২টা!
কোনোমতে মাথা গুঁজে রাতটা পার করেছেন এই স্কুলঘরেই
যদিও এ অভিযোগ অস্বীকার করছেন মেয়রের পক্ষ থেকে তদারকের দায়িত্বে থাকা ওসমান গণি। তিনি বলেন, পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার রান্না করা হচ্ছে, সবার মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে। সবাই খাবার পাচ্ছে, কেউ বাদ পড়ছে না।
বঙ্গবন্ধু বিদ্যানিকেতন থেকে সামনে এগিয়ে গেলেই ঝিলপাড় বস্তি। এখন অবশ্য শুধুই ধ্বংসস্তূপ। পুড়ে যাওয়া টিন ছড়িয়ে রয়েছে গোটা এলাকায়। একেকটা রুমের ভেতরে থাকা হাড়ি-পাতিল, চৌকি-চেয়ার, পোশাক-খেলনা— কোনোকিছুকেই আলাদা করে চেনা যায় না। তবু কেউ কেউ টিন উঁচিয়ে দেখেন— নিচে কিছু কি আছে? সেই ধ্বংসস্তূপই হাতড়ে বেড়াচ্ছেন কেউ কেউ— প্রিয়জনের কোনো চিহ্নের কি দেখা মেলে তাতে?