বরগুনা জিলা স্কুল ঘিরে মাদকের আখড়া, নয়ন বন্ডদের উত্থান যেখানে
১৭ আগস্ট ২০১৯ ১৯:৫৫
বরগুনা: চাঞ্চল্যকর রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের পর দেশব্যাপী আলোচিত ইস্যুতে পরিণত হয় বরগুনা জিলা স্কুলের কিশোর গ্যাং ও মাদকের আখড়ার বিষয়টি। বের হয়ে আসে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া ফেসবুকভিত্তিক নয়ন বন্ডের গড়া ‘০০৭ গ্রুপ’ ও নেপথ্যে মাদকের ভয়াল সাম্রাজ্যের খবর। রিফাত হত্যা মামলার আসামি ও জড়িত সন্দেহে গ্রেফতারদের দুই-তৃতীয়াংশই বরগুনা জিলা স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র। যাদের বেপরোয়া জীবনযাপন ও অনিয়ন্ত্রিত চলাফেরার উত্থান এখান থেকেই।
রিফাত শরীফ হত্যায় সরাসরি অংশ নেয় নয়ন বন্ডের প্রতিষ্ঠিত ০০৭ গ্রুপের সদস্যরা। নিহত রিফাত শরীফ ও ঘাতক নয়ন বন্ডসহ কিলিং মিশনের মাস্টারমাইন্ড রিফাত ফরাজী, রিশান ফরাজী ও হত্যায় অংশ নেওয়া অনেকেই এ স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেছেন। গ্রেফতার ১৪ জনের ১০ জন ও পলাতক চারজনের দুইজন বরগুনা জিলা স্কুল থেকে সদ্য পাশ করা ছাত্র।
রিফাত হত্যায় জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার আরিয়ান শ্রাবণ এ বছর এই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। এছাড়াও গ্রেফতার রাতুল সিকদারও বরগুনা জিলা স্কুলে দশম শ্রেণিতে অধ্যায়নরত। বরগুনা সবচেয়ে পুরাতন বিদ্যাপিঠ হিসেবে পরিচিত জিলা স্কুলের ছাত্রদের কেন তবে এই নৈতিক অবক্ষয়? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সরেজমিন অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য।
এই স্কুলের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী ও অভিভাবক জানান, মূলত স্কুল ও ক্লাসে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে নৈতিক অবক্ষয় শুরু হয়। বিদ্যালয়ের কেবিনেট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যায় কিশোরেরা। এই গ্রুপিং এ বাহুবল প্রদর্শন করতে হয়। আর তখনই বড় ভাইদের শরণাপন্ন হন কেবিনেট নির্বাচনে অংশ নেওয়া কিশোরদের গ্রুপ লিডার। এখান থেকেই মূলত বড় ভাইদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে এসব কিশোররা। আর বড় ভাইয়েরাও সুযোগটা বুঝে নেন ঠিকঠাক। নিজেদের অনুসারী তৈরিতে সহায়তা করেন ওইসব কিশোরদের। এরা নিজেদের মধ্যে তুচ্ছ বিষয়াদি নিয়েও অনেক সময় বাকবিতণ্ডা এমনকি মারামারিতে লিপ্ত হয়।
বরগুনা জিলা স্কুলের দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিদ্যালয়ের একাংশ ছাত্র যারা নেতৃত্বে আসতে চায়, তাদের প্রায় সবাই কোনো না কোনো বড় ভাইদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। তাদের বিভিন্ন প্রয়োজনে বড় ভাইয়েরা তখন এগিয়ে আসেন।’
ওই বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী জানান, ‘এই বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত কিছু শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বড় ভাইদের যোগাযোগ রয়েছে। এই বড় ভাইদের হাত ধরেই ছাত্রদের অনেকে মাদকে আসক্ত হয়ে যায়।’ তবে ‘বড় ভাই’ কারা? এ ব্যাপারে কিছু বলতে চাননি এই শিক্ষার্থী।
শুক্রবার (১৬ আগস্ট) দুপুরে বরগুনা জিলা স্কুলের প্রধান ফটকের সামনে কথা হয় একজন ঝালমুড়ি বিক্রেতা আবদুর রহমানের সঙ্গে। তিনি গত ১০ বছর ধরে এখানে ঝালমুড়ি বিক্রি করছেন।
আবদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন ‘এখানের ছাত্ররা বেপরোয়া, তুচ্ছ বিষয় নিয়ে একে অপরের সাথে ঝগড়া বাধায়। গ্রুপে বিভক্ত হয়ে একে অপরকে আক্রমণ করে প্রায়ই। তখন শহর থেকে বড় ভাইরা এসে উভয়পক্ষকে ডেকে মিটমাট করে দেয়।’
সরেজমিনে দেখা যায়, বিদ্যলয়ে পেছনে দিকে ছাত্রদের থাকার জন্য একটি পরিত্যক্ত হোস্টেল রয়েছে। সেখানে শিক্ষক বা ছাত্রদের কেউই থাকেন না। ফলে হোস্টেলে ভেতরটা একপ্রকার ‘ভূতের বাড়ি’র মতো অবস্থা। এই হোস্টেলের বিভিন্ন কক্ষ ঘুরে ইয়াবা সেবনের নমুনা পাওয়া যায়। এছাড়াও সিগারেটের খালি মোড়ক, দিয়াশলাই ও ম্যাচের কাঠিতে সয়লাব হয়ে আছে কয়েকটি কক্ষ।
হোস্টেলটির ঠিক পশ্চিম দিকে বিদ্যালয়ের পেছনের একটি সরু গলি। গলিপথ ধরে সামনে এগুতেই দেখা যায় তালাবদ্ধ একটি দরজা। দরজাটি দূর থেকে তালাবদ্ধ মনে হলে কাছে গিয়ে দেখা যায়, পকেট গেট বন্ধ থাকলেও মূল গেটটি আটকানো। যে কেউ এটি খুলে বিকল্প আসা যাওয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছেন।
সেখানে একজন ছাত্রের সাথে কথা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত ওই ছাত্র জানান, এই পথ ধরে বড় ভাইয়েরা হোস্টেলে আসেন। আর ছাত্ররাও ক্লাস ফাঁকি দিয়ে অথবা বিরতিতে হোস্টেলে এসে একসঙ্গে মাদকসেবন করে দীঘিরপাড় ঘেঁষে ওই গলিপথ ধরেই গেট থেকে বের হয়ে যান।
বিদ্যালয়ের দক্ষিণ দিকে রয়েছে আরেকটি পরিত্যক্ত ভবন। ভবনটি একসময় প্রধান শিক্ষকের বাসভবন ছিল। কিন্ত বেশ কয়েকবছর ধরে এই ভবনটি পরিত্যক্ত। এর ভেতরের কক্ষগুলোতেও ইয়াবা সেবনের উপাদান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
বিদ্যালয়ের উত্তর প্রান্তে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি পরিত্যক্ত ভবনে নিয়মিতই ইয়াবা সেবনের নমুনা পাওয়া গেছে। গোটা কক্ষ জুড়েই সিগারেটের খালি মোড়ক, দিয়াশলাই, ইয়াবা সেবনের উপকরণের নমুনা চোখে পড়ে।
এই স্কুল শিক্ষার্থীদের কয়েকজন অভিভাবক জানান, ছাত্ররা দিন দিন ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। শহরের কথিত বড় ভাইয়েরা ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য এদের হাতে ইয়াবা ধরিয়ে দেয়, এখানেই চলে ইয়াবা সেবনের প্রাথমিক কার্যক্রম। এই বড় ভাইরাই ছাত্রদের বিপথগামী করছে।
‘বড় ভাই’ কারা? প্রশ্ন করা হলে অভিভাবকদের কয়েকজন জানান, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন হলো কথিত বড় ভাই। এরা উঠতি কিশোর বিশেষ করে জিলা স্কুলের কিশোরদের টার্গেট করে এসব অপকর্ম করছে। তাদের ব্যাপারে পুলিশ ও অবগত। কিন্তু দীর্ঘদিনের এই সমস্যার সমাধান কেউ করে না, এমনকি এদের ব্যাপারে কেউ মুখও খোলে না।
রিফাত হত্যার পর মাদক ও গ্যাং গ্রুপ যখন মাসব্যাপী দেশে আলোচনার শীর্ষে, তখন নিজেই যেন অন্ধকারে বসবাস করছেন বিদ্যালটির প্রধান শিক্ষক। বিদ্যালয় কম্পাউন্ডে এমনকি প্রধান শিক্ষকের বাসভবন ও হোস্টেলে মাদকসেবীদের এমন আড্ডার ব্যাপারে কোনো তথ্যই নেই প্রধান শিক্ষকের কাছে। এমনকি কিশোর গ্যাং নিয়ে দেশে তোলপাড় হলেও বিষয়টি নিয়ে তেমন অবগত নন বরগুনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ।
তিনি বলেন, ‘মাদক বা কিশোর গ্যাং এর বিষয়টি আমার জানা ছিল না, আমি এ ব্যাপারে এখন থেকে সচেতন হব। শিক্ষদেরও এ ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে বলব। আর বাউন্ডারি ওয়াল ও গেটের সংস্কার করা হবে যেন বহিরাগতরা প্রবেশ করতে না পারে।’
বরগুনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবির হোসেন মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা বিশেষ করে কিশোর গ্যাং ও এদের কার্যক্রম ও সার্বিক বিষয় নিয়ে তদারকি শুরু করেছি। শহরের কোথাও যেন এমন গ্যাং গড়ে না ওঠে, সেদিকে আমাদের কড়া নজরদারি রয়েছে। মাদক বা গ্যাং কোনোটারই বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই, সে যেই হোক।’
রিফাত শরীফ হত্যার ঘটনায় যখন গোটা জাতি যখন হতভম্ব, তখন বরগুনা জিলা স্কুলের মাদকের আখড়া ও কিশোরদের গ্যাং এ জড়িয়ে যাওয়া নিয়ে কি সচেতন মহল কী ভাবছেন, সেটা নিয়ে কথা হয় বরগুনার শিক্ষাবিদ ও জিলা স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক মাহবুব চৌধুরির সাথে।
মাহবুব চৌধুরি সারাবাংলাকে বলেন, ‘কিশোর বয়সে কিশোরদের একাংশ রঙ্গিন স্বপ্নে বিভোর থাকে। এদেরই টার্গেট করে মাদক ব্যবসায়ীদের সংঘবদ্ধ চক্র। তাছাড়া প্রুযুক্তি ও কর্পোরেট যুগে পারিবারিক অনুশাসনও কমে আসছে। সন্তানদের সময় দেওয়া থেকে তাদের হাতে টাকা তুলে দেওয়া জরুরি মনে করছেন অনেকে। ফলে বখে যাচ্ছে কিশোর-তরুণরা। পাশাপাশি শিক্ষকদের একাংশও বাণিজ্যিক ধারায় প্রত্যবর্তিত। এসব মিলিয়ে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের সময় এসেছে পারিবারিক অনুশাসন, সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত একটি জাতি গঠনে মনোনিবেশ করা।’
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন বরগুনা জেলার সভাপতি জাকির হোসেন মিরাজ বলেন, ‘রিফাত হত্যার পর আমাদের সমাজের বর্তমান অবস্থাটা আয়নায় স্পষ্ট হয়েছে। আমাদের এখন উচিত অসঙ্গতিগুলো নিয়ে কাজ করা। আর এটা করতে ব্যর্থ হলে আমাদের জন্য ভয়াবহ ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।’