ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর বিষয়ে সতর্ক হতে হবে
১৭ আগস্ট ২০১৯ ২০:৫৮
ঢাকা: কাশ্মির ইস্যুকে কেন্দ্র করে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। পারমাণবিক শক্তিধর উপমহাদেশের এই দুই বড় রাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনার কারণে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোও চিন্তিত। এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভয় পাওয়ার কিছু নেই, যুদ্ধ বাঁধবে না। তবে এখনকার উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে সন্ত্রাসী ও জঙ্গিগোষ্ঠী এবং সুবিধাবাদীরা মাথাচাড়া দিতে পারে, সে বিষয়ে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে।
পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে জানান, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ। এই উত্তেজনা কমানোর মতো কোনো সুযোগ পেলে বাংলাদেশ তা ব্যবহার করবে।
অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশনের (ওআইসি) জেদ্দাভিত্তিক স্বাধীন স্থায়ী মানবাধিকার কমিশনের (আইপিএইচআরসি) সদস্য, রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির সারাবাংলাকে বলেন, ‘কাশ্মিরকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ যে সৃষ্টি হচ্ছে তা ঠিক। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সন্ত্রাস এবং সন্ত্রাসীদের ভূমিকা, যেমন, পাকিস্তানের জয়শ-ই-মোহাম্মদ বা এই ধরনের যে সকল সন্ত্রাসী গোষ্ঠী রয়েছে, সব কয়টা কোনো না কোনোভাবে চেষ্টা করবে যে ভারতে কীভাবে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়। এই যে দুইদিন আগে কোয়েটায় বেলুচিস্তানের একদল লোক একটি মসজিদে বোমা হামলা চালিয়েছে। যারা এই কাজ করেছে, তারা বলেছে যে ভারতের উচিৎ আমাদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া, যাতে আমরা পাকিস্তান থেকে আলাদা হতে পারি। তবে সার্বিকভাবে কাশ্মিরকে ভিত্তি করে পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে দুইটি পারমানবিক যুদ্ধ বাঁধার শঙ্কা খুবই কম।
যদিও একপক্ষের (ভারতের) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যে, তাদের মধ্যে পারমাণবিক শক্তি পরিহারের যে চুক্তি ছিল তা সবসময়েই মেনে চলতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমার মনে হয় যে পারমাণবিক যুদ্ধ হবে না। কেননা এতে গোটা উপমহাদেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
মোহাম্মদ জমির বলেন, ‘এদিকে, চীন এই ঘটনায় জাতিসংঘে রুদ্ধদ্বার (ক্লোজডোর মিটিং) বৈঠক করেছে। চীন বলেছে যে আমাদের সক্রিয় সচেষ্ট হতে হবে যাতে এই এলাকায় অস্থিতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি হয় এমন কোনো ঘটনা না ঘটে। কারণ হচ্ছে— চীন ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে ২০/৩০ বিলিয়ন ডলার খরচ করছে। এখন অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হলে তো তাদের এই অর্থনৈতিক পদক্ষেপ বাধাগ্রস্ত হবে। এর সঙ্গে গুরুত্ব হচ্ছে, আগামী অক্টোবরে ভারতের বানারসিতে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিং পিং সফরে আসবেন। সেখানে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে তার বৈঠকের পাশাপাশি অর্থনীতি ফোরাম নিয়ে বিশাল অনুষ্ঠান হবে। অক্টোবরের আগে যদি এখন এই অঞ্চলে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তবে এখানে অর্থনৈতিক ফোরাম হওয়া, ওখানে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক হওয়া, এই সবকিছুইতো উল্টা-পাল্টা হয়ে যাবে। তাই মনে হয় না, পরিস্থিতি যুদ্ধের দিকে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কাশ্মির অঙ্গনে আবার আরেকটা দিক দেখা দিয়েছে। সেটা হচ্ছে, লাদাখকে আলাদা অঞ্চল ঘোষণা করে সেখানে বৌদ্ধদের অগ্রাধিকারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনায় শ্রীলংকা খুশি প্রকাশ প্রকাশ করলেও নেপাল কিন্তু একটি বাক্যও উচ্চারণ করেনি।’
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী (বীর বিক্রম) সারাবাংলাকে বলেন, ‘কাশ্মিরকে কেন্দ্র করে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে নতুন উত্তেজনা দেখা দিচ্ছে। নিঃসন্দেহে এই সময়টা উত্তেজনাকর। ভারত বলছে, এটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় কিন্তু পাকিস্তান মানছে না। যে নতুন উত্তেজনা দেখা দিচ্ছে তাতে উপমহাদেশে যুদ্ধের আশঙ্কা না থাকলেও রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অস্থিরতার সম্ভাবনা রয়েছে। এই ঘটনা কোথায় যাবে, কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আসবে তা বলা মুশকিল। ভারত-পাকিস্তান উপমহাদেশের দুইটি বড় সদস্য রাষ্ট্র এবং তারা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম আঞ্চলিক ফোরাম সার্কেরও সদস্য রাষ্ট্র। তাদের মধ্যে যখন উত্তেজনা বিরাজ করছে তখন আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।’
চলমান অবস্থায় বাংলাদেশে অবস্থান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই বিষয়টি নিতান্তই ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এখানে বাংলাদেশের অবস্থান নেওয়ার সুযোগ নেই।’
শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, ‘যখন এক ধরনের অশান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করে তখন সেখানে অনেক সুবিধাবাদী বা সন্ত্রাসী বা জঙ্গিগোষ্ঠী সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে। আর কাশ্মির জঙ্গিবাদিদের তৎপরতা সবসময়েই রয়েছে। তাদের এই সময়ের সুযোগ নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বেশ কিছুদিন আগে শ্রীলংকাতেও সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে গেল। সবকিছু মাথায় রেখেই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, যাতে জঙ্গিবাদিরা এই ঘটনার সুযোগ নিতে না পারে।’
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) এর চেয়ারম্যান রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফায়েজ আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘যে কোনো প্রতিবেশীর মধ্যে সংঘর্ষ বা দ্বন্দ্ব বাঁধে বা উত্তেজনা বাড়ে তবে তা চিন্তার বিষয়। আর ভারত যা করেছে তা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আমরা মনে করি, ভারতের টেরিটরিতে যা আছে তা তাদের আর পাকিস্তানের টেরিটরিতে যা আছে তা তাদের নিজস্ব। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান এমন মনে করে না। এই সময়কার উত্তেজনা তারো জন্যই ভালো না। এই উত্তেজনা থেকে বড় ধরনের সংঘর্ষ বেঁধে গেলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। সে জন্য স্বাভাবিকভাবেই আমরা চিন্তিত। আমরা চাই, দুইপক্ষই সংযম পালন করুক এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান ঘটুক। আর বিশেষ করে কাশ্মিরের জনগণের ন্যায্য অধিকারের ব্যবস্থা করার প্রতি আমাদের আহ্বান থাকবে। কাশ্মিরের জনগণের অধিকার খর্ব করা যাবে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘দুইটা দেশই আনবিক অস্ত্রের অধিকারী। একটা দুর্ঘটনা ঘটলে কোথায় গিয়ে থামবে সেটা বলা মুশকিল। আবার আরেকটা বিষয় যে দুই পক্ষই যেহেতু আনবিক শক্তির অধিকারি সেহেতু উভয়েই নিজেদের সংযত রাখার চেষ্টা করবে। যেমন ঠান্ডা যুদ্ধের সময় (কোল্ড ওয়ার) সকলেই একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকতেন। কেননা এতে দুই পক্ষেরই ক্ষতি হবে আর উভয়েই সেটা জানে। তাই দুই পক্ষই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে।’
এমন পরিস্থিতিতে অস্ত্রের ব্যবসা বা ব্যবহার সম্পর্কে রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফায়েজ আহমেদ বলেন, ‘আশেপাশের দেশ থেকে তাদের নিজেদের দেশে অস্ত্রের ব্যবসা বা ব্যবহার বাড়তে পারে। তারা যদি মনে করে যে তারা যুদ্ধের দিকে এগুচ্ছে তবে তো তারা যুদ্ধের প্রস্তুতিই নিবে। এতে তারা অস্ত্র-গোলা-বারুদ এসব সরঞ্জাম সংগ্রহের জন্য সাপ্লাইয়ারদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। তবে আমার মনে হয় না যে দুই পক্ষ যুদ্ধের দিকে যাবে।’
‘এই ঘটনায় রোহিঙ্গা সংকটের ওপর দূরবর্তী প্রভাব পড়তে পারে’, উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফায়েজ আহমেদ বলেন, ‘এই ঘটনায় ঢাকার অবস্থান পর্যবেক্ষণ করা ছাড়া আর কিছুই করার নাই। আর আশা করা যে এই উত্তেজনা যেন না বাড়ে এবং কাশ্মিরের জনগণের যাতে কষ্ট না হয়।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাহাব এনাম খান সারাবাংলা’কে বলেন, ‘কাশ্মির ইস্যুকে কেন্দ্র করে উপমহাদেশে বড় ধরনের অস্থিরতার (জিও পলিটিকেল এবং জিও স্ট্র্যাটেজিক টেনশন) সৃষ্টি হতে পারে। এই উত্তেজনা বাড়তে থাকলে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া ঘটতে পারে। যার একটা হলো অস্ত্রের ব্যবহার এবং অস্ত্র কেনাবেচা (আর্মস রেইস এন্ড আর্মস এক্সপেন্ডিচার)। আরেকটা হল, এই অঞ্চলের দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক গুণগত পরিবর্তন আসবে। গুণগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দেখা যাবে যে ভারত এক ধরনের রাজনৈতিক বলয় তৈরি করার চেষ্টা করবে। আবার চীন-পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে অন্য ধরনের রাজনৈতিক বলয় সৃষ্টি হবে। ফলে একটা বড় ধরনের পলিটিকেল ডিভিশন এবং স্ট্র্যাটেজিক ডিভিশনের সৃষ্টি হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এতে বাংলাদেশের অবস্থান একটু দোদুল্যমান। বাংলাদেশের জন্য এটা একটা চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি। কেননা, একটা মার্কিন-ভারত বলয়, আরেকটা চীন-পাকিস্তান বলয় এবং সেই সঙ্গে দেখব যে পাকিস্তান, ভারত, চীন সকলেরই ফোকাস মিয়ানমার। সবকিছু মিলে একটা জটিল পরিস্থিতি তৈরি হবে। যেখানে বাংলাদেশের নিজের স্বার্থের জন্য এখনই পরিস্কারভাবে একটা চিন্তাধারার দিকে যেতে হবে। কারণ যে বলয়গুলো বা পাওয়ার সেন্টারগুলো তৈরি হবে সেখানে বাংলাদেশ কতটুকু ব্যালান্স মেইনটেইন করবে এবং উপমহাদেশের অন্য রাষ্ট্রগুলো কতটুকু ব্যালান্স মেইনটেইন করবে, সেটা এখনই দেখার বিষয়। সে কারণে অন্য দেশগুলো এখন কী করছে বাংলাদেশের সে বিষয়গুলো মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি, রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এই প্রতিটা বিষয় চিন্তা করে একটি সুচিন্তিত নীতিতে বাংলাদেশের থাকা প্রযোজন। এবং হুটহাট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া মোটেই ঠিক হবে না। কোনো ভুল কূটনৈতিক বা রাজনৈতিক বার্তা যেন না আসে সেদিকে বাংলাদেশের নজর রাখতে হবে।’