Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মিলনের দুই চোখে সেদিন ছিল বাঁচার আকুতি


২৭ আগস্ট ২০১৯ ০৬:৩০

ঢাকা: রাজধানীর শাহজাহানপুর এলাকায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে গলা কেটে যাওয়ার পর পাঠাওচালক মিলন মিয়া (৩৫) অবশেষে হার মেনেছেন। তবে যেদিন ছুরিকাঘাতে আহত হয়েছিলেন মিলন, সেদিনের কথা কোনোভাবেই ভুলতে পারছেন না পল্টন থানার এসআই মোজাম্মেল হক। তিনিই মিলনকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।

সোমবার (২৬ আগস্ট) বিকেলে পল্টন থানার এসআই মোজাম্মেল হক সারাবাংলাকে বলেন, ছুরিকাঘাতের ঘটনা যেখানটায় ঘটেছিল সেটি শাহাজাহনপুর থানা এলাকা। কিন্তু মিলন আহত অবস্থায় ফ্লাইওভার থেকে যেদিকে (শান্তিনগর) নেমেছিল সেটি পল্টন থানা এলাকা। আমি রাতের ডিউটিতে ছিলাম।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে মিলনকে দেখে হতভম্ব হয়েছিলাম। তিনি তার দুই হাত দিয়ে নিজের কাটা গলা চেপে নামছিলেন। তাকে বাঁচানোর জন্য সহযোগিতা চাইছিলেন। এগিয়ে গিয়ে দেখি, তার পুরো শরীর রক্তে ভেজা। তাকে বললাম, কারও নাম বা মোবাইল নম্বর বলতে পারবেন? উনি কথা বলতে পারছিলেন না। এরপরেও অনেক কষ্টে তার ভাইয়ের মোবাইল নম্বর আমার মোবাইলে লিখে দিলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে কল করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসতে বলি।

‘এরপর মিলনকে আমি কোলে করে গাড়িতে তুলে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে যাই। মিলনের দু চোখে সেদিন যে বাঁচার আকুতি দেখেছি তা কোনোভাবেই ভুলতে পারছি না। তাকে বাঁচাতে পারলে মানসিকভাবে নিজেও শান্তি পেতাম।’ এ কথা বলতে বলতেই এসআইয়ের গলার স্বর আটকে আসে।

ঢামেকে নেওয়ার পর তার পরিবারের লোকদের উপস্থিতিতে মিলনের অপারেশন হয়। এরপর ডাক্তারের পরামর্শে মিলনকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে নেওয়া হয়।

বিজ্ঞাপন

এরপর এসআই মোজাম্মেল চলে আসেন। এর আগেই পুলিশের আরেকটি টিম ফ্লাইওভার থেকে রক্তমাখা ছুরি ও হেলমেট উদ্ধার করে। পরে এসব জিনিস শাজাহানপুর থানা পুলিশের কাছে বুঝিয়ে দেয় পুলিশ।

সোমবার (২৬ আগস্ট) দুপুরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে কথা হয় থাকা নিহত মিলনের ছোট ভাই হিমেলের সাথে। হিমেল সারাবাংলাকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ভাইয়া প্রাইভেট কারচালক চালান। দুই ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে রাজধানীর মিরপুর এলাকায় থাকতেন। সংসারের বাড়তি খরচ মেটাতেই রাতের বেলায় মোটর সাইকেলে রাইড শেয়ারিং অ্যাপসের মাধ্যমে পাঠাও এবং উবারে যাত্রী বহন করতেন।

হিমেল বলেন, বরাবরের মতো রাতে তিনি বাসা থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে বের হন। রাত দেড়টার দিকে মিলন এক বন্ধুকে ফোনে জানায় যে, সে রাজারবাগ এলাকায় একটি ভাড়া পেয়েছেন। ওনাকে নামিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরবেন। কারণ তার বাইকে তেল কম ছিল। এরপর রাতে ২টার দিকে ৪০ মিনিটের দিকে আমার ফোনে একটি নাম্বার থেকে ফোন আসে। ফোনে জানায়, মিলনের গলায় ছুরি মারা হয়েছে।’

যাত্রীবেশে থাকা পাঠাওয়ের এক আরোহীর ছুরিকাঘাতেই জীবন দিতে হলো মিলনকে। সঙ্গে মোটরসাইকেল ও মোবাইল ফোন দুটোই ছিনতাই হয়।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের  মর্গের সামনে নিহত মিলনের বন্ধু রানা বলেন, ‘আমরা যখন ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছালাম, দেখি মিলনের গলায় সেলাই করা হচ্ছে। কাছে গেলে আমাকে দেখে শক্ত করে আমার হাতটি চেপে ধরে মিলন। বুঝতে পারলাম কিছুটা ভরসা পেয়েছে। এরপর ডাক্তারের পরামর্শে তাকে হৃদরোগ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘ হৃদরোগ হাসপাতালে আসার পর দেখি জরুরি বিভাগের সবাই ঘুমাচ্ছেন। তাদের ডাকলে আমাদের দ্রুত রক্ত জোগাড় করতে বলেন। অনেক বন্ধু মিলে তাকে রক্ত দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি মিলন শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসার চেষ্টা করছে। তার কাছে গিয়ে ওকে আগলে ধরার চেষ্টা করি। ও বড় করে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করে। এরপরই সে মারা যায়। কী নির্মম আমরা তাকে রক্তও দিতে পারলাম না।

মিলনের মরদেহের ময়নাতদন্ত চলছিল মর্গে আর বাইরে বুকফাটা আর্তনাদ করছিলেন মিলনের স্বজনরা। তবে মিলনের স্ত্রী এবং সন্তানদের দেখা মেলেনি। পরে কথা বলে জানা যায়, মিলনের স্ত্রী শিল্পী মামলা করতে থানায় গেছেন। আর ১০ বছরের ছেলে মিরাজ ও পাঁচ বছরের মেয়ে সাদিয়াকে বাসায় রাখা হয়েছে। বাবাকে হারিয়ে তারাও কাঁদছে বলে জানান মিলনের স্বজনরা।

মিলনের স্ত্রী শিল্পী বলেন, আমার তো সব শেষ হয়ে গেছে। আমার মিলনকে আমি কোনো দিন কাছে পাবো না। আমার ছেলে মেয়েরাও বাবার আদর আর পাবে না। এখন অভাবের সংসারে স্বামীকে ছাড়া কীভাবে দিন পার হবে সেটাই বুঝতে পারছি না।

এদিকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহজাহানপুর থানার এসআই আতিকুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘মিলন তার গাড়িতে আরোহী তোলার আগে অ্যাপসের মাধ্যমে নিয়েছিল নাকি চুক্তিতে উঠিয়েছিল তা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। সময় লাগতে পারে কারন ফোনটিও নিয়ে গেছে ছিনতাইকারী আরোহী।’

মতিঝিল বিভাগের উপ কমিশনার (ডিসি) আনোয়ার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছিনতাইকারী যেই হোক তাকে খুঁজে পেতে চেষ্টা চলছে। পাঠাও চালক হত্যাকারীকে খুঁজে বের করা হবেই।’

এক প্রশ্নের উত্তরে পুলিশের ডিসি বলেন, সম্ভবত চুক্তিতে আরোহী তুলেছিলেন মিলন। কারন পাঠাও অফিসের প্রাথমিক তথ্য বলছে, সবশেষ তিনি ৭ আগস্ট কল পেয়েছিলেন। বাকি সময়টাতে মিলন হয় পাঠাও চালায়নি অথবা চুক্তিতে চালিয়েছেন। যেহেতু ছিনতাইকারী মোটরসাইকেল ও ফোন দুটোই নিয়ে গেছে, এরপরও আমরা বিষয়টি খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি।

ছিনতাইকারী পাঠাও চালক মিলন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর