Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ডিএনসিসির বরাদ্দ বেড়েছে ৩ থেকে ১৫ গুণ, স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন


৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৮:১৯

ঢাকা: ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য ৩ হাজার ৫৭ কোটি ২৪ লাখ টাকার লক্ষ্যমাত্রা ধরে বাজেট ঘোষণা করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। কিন্তু এ বাজেটের কোনো কোনো খাতে ৩ থেকে ১৫ গুণ পর্যন্ত বরাদ্দ বাড়িয়ে বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে বাজেট প্রণয়নের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পরিকল্পনাবিদরা।

পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, যেভাবে জনমতের ভিত্তিতে উন্নয়নের পরিকল্পনা নিয়ে বাজেট প্রণয়ন করার কথা তা এবারের বাজেটে পরিলক্ষিত হয়নি। ফলে কোন খাতে কেন এবং কীভাবে অর্থখরচ করা হবে সেটি নিজেদের মতো ঠিক করেছে। সেখানে পরিকল্পনার যথার্থতা নেই। ফলে এবারের বাজেট প্রণয়নের প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট স্বচ্ছ নয় বলে মনে করেন তারা।

বিজ্ঞাপন

ডিএনসিসির অনুমোদিত বাজেট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সংস্থাটির সেবামূলক বিভিন্নখাতে বরাদ্দ বেড়েছে দেড় থেকে দশগুণ পর্যন্ত। আবার উন্নয়নমূলক বিভিন্নখাতে বরাদ্দ বেড়েছে ৩ থেকে ১৫ গুণ পর্যন্ত।

ডিএনসিসির ২০১৯-২০ অর্থবছরের ঘোষিত বাজেটের সেবা খাতের ‘মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম’ পরিচালনার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৪৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা। গতবছর এ খাতে বরাদ্দ (২০১৮-১৯) ছিল ১৭ কোটি ৫০ লাখ। এ বছর বরাদ্দ বেড়েছে ১৮২ শতাংশ বা প্রায় ৩ গুণ। আবার ‘মশক নিয়ন্ত্রণ’ কার্যক্রমের পাশাপাশি ‘মশক নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতি’র জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১০ কোটি। যা গত বছরের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি। গত বছর ছিল ৮ কোটি। ‘প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা’ খাতে এ বছর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে দেড় কোটি টাকা। যা গতবছর ছিল মাত্র ২০ লাখ। এ বছর এ খাতটিতে বরাদ্দ বেড়েছে ৬৫০ শতাংশ বা সাড়ে সাতগুণ।

বর্জ্য অপসারণ কাজে ব্যবহৃত ‘সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন’ (এসটিএস) খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫ কোটি টাকা। যা গত অর্থবছর ছিল মাত্র ৫০ লাখ টাকা। এবার বরাদ্দ বেড়েছে ৯০০ শতাংশ বা ১০ গুণ। ঠিক একই অবস্থা ‘বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের ট্রাক, মটরসাইকেল’ খাতেও। এ খাতেও বরাদ্দ বেড়েছে ৯০০ গুণ আবার ‘বর্জ্য বিভাগের মাধ্যমে যন্ত্রপাতি আধুনিকায়ন, উন্নয়ন ও ক্রয়’ সংক্রান্ত অপর একটি খাতেও ব্যয় বরাদ্দ বেড়েছে ১১০ শতাংশ। এ খাতে গতবছর সাড়ে ৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও এবার বরাদ্দ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ২০ কোটি টাকা।

বিজ্ঞাপন

সেবা খাতের বরাদ্দ বাড়ার মতো অবস্থা উন্নয়ন খাতেও। উন্নয়নের জন্য ‘সরঞ্জাম, যন্ত্রপাতি সম্পদ ক্রয়’ খাতে বরাদ্দ বেড়েছে ১৭৯ কোটি টাকা। গতবছর বরাদ্দ ছিল সাড়ে ৩২ কোটি। এ বছর ধরা হয়েছে ৯০ কোটি ৭৫ লাখ। আবার উন্নয়নের জন্য ‘নিজস্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান’ খাতে বরাদ্দ বেড়েছে ৩০০ শতাংশ। গতবছর বরাদ্দ ছিল মাত্র ২৫ লাখ টাকা। এবার বরাদ্দ বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ১ কোটি টাকা। ‘ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন’ খাতে বরাদ্দ বেড়েছে ১৪০০ শতাংশ। গতবছর এ খাতে বরাদ্দ ছিল ১ কোটি টাকা। এ বছর বরাদ্দ বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ১৫ কোটি। যা গতবছরের চেয়ে ১৫ গুণ বেশি।

মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমখাতে ৪৯ কোটি ৩০ লাখ টাকার মধ্যে ৩০ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে মশক ওষুধ ক্রয়ে। ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে কচুরিপানা বা আগাছা পরিষ্কার ও পরিচর্যার কাজে। ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে ফগার মেশিন পরিবহনের কাজে। মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের বিশেষ কর্মসূচির কাজে খরচ করা হবে ১ কোটি টাকা এবং ১২ কোটি টাকা খরচ হবে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের জন্য।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সহ-সভাপতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের বরাদ্দ বাড়ুক এটি আমরাও চাই। কিন্তু সেটি যৌক্তিকভাবে বাড়তে হবে। তবে বিষয় হলো— বাজেট প্রণয়নের আগে প্রাক-বাজেটকালীন পরিকল্পনাবিদদের সঙ্গে আলাপ করতে হবে। কিন্তু এখনও সে সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। অথচ এটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কারণ হল স্থানীয় সরকার মানেই হলো স্থানীয় জনগণ। এখন যারা স্থানীয় জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তাদেরকে অবশ্যই বাজেট প্রণয়নে সম্পৃক্ত রাখতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘কচুরিপানা পরিচর্যার কাজে যে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা বেশি হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। এত কচুরিপানার উৎস আছে কি না জানি না। আবার আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে যে বরাদ্দ ধরা হয়েছে তা পর্যালোচনার বিষয়। সেটি কোন আঙ্গিকে পরিকল্পনা করা হয়েছে তা করপোরেশনই ভালো বলতে পারবে।’

এ বিষয়ে অধিকারকর্মী ও নগর পরিকল্পনাবিদ এবং স্থপতি ইকবাল হাবীব সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিবছরই সিটি করপোরেশনের উচিৎ তার আগের বছরের অভিজ্ঞতায় বিভিন্ন খাতওয়ারি তার যে অর্জন এবং সে অর্জনের ভুল-শুদ্ধতা সাপেক্ষে নতুন কৌশল ঠিক করে সে অনুযায়ী বাজেট রি-অ্যাডজাস্ট করা। গতবছর তারা আগের টাকা দিয়ে কী করেছে, কোনটা তাদের সঠিক হয়েছে, কোনটা তাদের ব্যর্থ হয়েছে, সেটির মূল্যায়ন সাপেক্ষে এবারের বাজেটের বরাদ্দের যথার্থতা নিরূপণ করা দরকার ছিল। সে কাজটা তারা এবারও করল না, তাই এবারের বাজেট আমার কাছে যৌক্তিক উপস্থাপন মনে হয় না। কারণ ওই টাকা (গতবছর) যে খাতে রেখেছে এটা ঠিক কি বেঠিক তা বোঝার ক্ষমতা তাদের নেই, আমাদেরও নেই। যদি আগের বছর যা খরচ করেছে অথবা তার আগের বছর সেগুলোতে খরচ করার পরও কেন মশা কমল না-নিয়ন্ত্রণ হলো না, তাহলে কী করা উচিত ছিল? সেটি করতে গিয়ে তারা যদি দেখে সাকসেস হয়নি, অথবা হয়েছে এসব পর্যালোচনার ওই জায়গাতেই আমরা মস্তবড় ভুল করে বসে আছি। এই যে পরীবীক্ষণ ছাড়া, পর্যালোচনা ছাড়া, বাজেট নতুন করে আরোপ করা বা নতুন করে ঘোষণা করা এটি অবশ্যই একটি অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এবং এটির মধ্যদিয়ে যে খুব বড় উন্নয়ন হবে বা উন্নয়নের ধারা অর্জিত হবে এটি আমি কোনোভাবে তা বিশ্বাস করি না।’

ইকবাল হাবীব আরও বলেন, ‘মশক নিয়ন্ত্রণে আউটসোর্সিংয়ের ব্যাপারে তারা যদি মনে করে তাদের লোকবল নিয়োগ করবে। তাহলে তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, নিজেদের নিয়োগকৃত লোকদের পারফরমেন্স নিশ্চিত করতে পারল না তারা। তাহলে আউটসোর্সিংয়ের পারফরমেন্স তারা কীভাবে নিশ্চিত করবে। ওরা কি প্রতি মাসে মাসে মশা গুনবে? যে এ মাসে মশা কমছে তোমাকে পয়সা দেব, এ মাসে মশা কমে নাই তোমাকে পয়সা দেব। আর যদি এটি হয় তাহলে মনিটরিং সিস্টেম টা কী, কীভাবে করবে সেটি জানা প্রয়োজন। আর সেটা যদি জানা না থাকে, তাহলে মনে করতে হবে পুরো সিস্টেমটা একটা মানির আউটসোর্সিং হবে। যদি এটি তারা বলতে না পারে তাহলে বুঝতে হবে, এটিও বানোয়াট যথার্থ সিদ্ধান্ত।’

ইকবাল হাবীব বলেন, ‘পরীবীক্ষণের মাধ্যমে যথার্থ জরিপ এবং পর্যালোচনা সাপেক্ষে বাজেটগুলো যদি তৈরির প্রক্রিয়া হতো এবং সেগুলো জনগণকে জানান দেওয়া যেত। এতে সিটি করপোরেশনের কার্যপরিসীমা বাড়ত এবং একইসঙ্গে জনগণ সন্তুষ্ট হতো। জনগণও বলত না গতবারের ভুলটা থেকে তারা শিখেছে, এটার পরিবর্তে তারা এখন এটা করছে সে জায়গাতে আমাদের যথেষ্ট আপত্তি রয়েছে।’

ডিএনসিসির এবার বাজেটটি ঝুঁকিপূর্ণ বলে আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, বাজেটটি বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ হবে। এ বাজেট বাস্তবায়নে যথেষ্ট পরিমাণ যুক্তিযুক্ত হবে না তার অন্যতম কারণ এ বাজেটের সময়কালের মধ্যে মেয়র নির্বাচন হবে এবং মেয়র পরিবর্তন হবে। বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়া যথেষ্ট স্বচ্ছ ও যথার্থ নয় বলে মনে করি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএনসিসির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবারের বাজেটে নগরবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। প্রতিটি খাতের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে জনগণের সেবা নিশ্চিত করার জন্য। মশকখাতে আউট সোর্সিংয়ের বিষয়টি রাখা হয়েছে এ জন্য যে, অনেকে মশক কর্মীদের কাজ নিয়ে অসন্তুষ্ট। তাই আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে পার্থক্য নিরূপণ করা হবে যে, কারা বেশি দক্ষ।’ তবে আগামীতে মেয়রের নির্বাচনে বাজেট বাস্তবায়নে কোনো প্রতিফলন ঘটবে না বলে মনে করেন তিনি।

আগামী অর্থবছর ডিএনসিসি বাজেট মেয়র আতিকুল ইসলাম সিটি করপোরেশন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর