‘ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে প্রধান ১০ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে এনবিআর’
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৭:৪০
ঢাকা: ১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। আইনটি বাস্তবায়নে এরইমধ্যে কাজও শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে প্রথমত ১০টি চ্যালেঞ্জ থাকলেও তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে রাজস্ব বোর্ড। ভ্যাট আইনের নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে সারাবাংলার সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা পশ্চিম ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার ড. মইনুল খান।
নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে এনবিআরের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল পুনঃরেজিস্ট্রেশন। আগের রেজিস্ট্রশনে প্রতিষ্ঠানের এলাকা বা কোন কমিশনারেটের অন্তর্ভূক্ত তা বোঝা যেত না। এখন যে কেউ ঘরে বসে বা যেকোনো জায়গা থেকে ভ্যাট অনলাইনের পেজে গিয়ে আবেদন করতে পারেন। কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া তাকে আর ভ্যাট অফিসে যেতে হচ্ছে না। অনলাইনে পুনঃ ও নতুন রেজিস্ট্রেশনে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।
ভ্যাটের সীমা বাড়ানোতে (বার্ষিক টার্নওভার ৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অব্যাহতির) কেউ কেউ ধারণা করেছিলেন অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান ভ্যাটের বাইরে চলে যাবে। সম্প্রতি একটি পরিপত্র জারির মাধ্যমে এনবিআর পরিস্কার করেছে যে প্রায় ১৭০ ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বার্ষিক টার্নওভার যাই থাক না কেন তারা ভ্যাটের আওতায় থাকবে। ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের প্রতিষ্ঠান কোনো সীমায় পড়বে তা নির্ধারণের জটিলতা এড়ানো সম্ভব হয়েছে।
মাসিক রিটার্ন দাখিল কার্যক্রম অনলাইন সম্পন্ন করাকে তৃতীয় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন এই ভ্যাট কমিশনারেট। তিনি জানান, চলতি মাস থেকে অর্থাৎ আগস্ট মাসের রিটার্ন সেপ্টেম্বর মাসের ১৫ তারিখ থেকে দাখিল করা যাবে। মাঠ পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের এখন অনলাইনে রিটার্ন দাখিলে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এতে ব্যবসায়ীরা তাদের মাসশেষে কেনা-বেচা, প্রযোজ্য ভ্যাট পরিশোধের তথ্যাদিসহ অন্যান্য ঘোষণা নিজেই দেবেন। অনলাইনে রিটার্ন দাখিলের সুবিধার পর ভ্যাট অফিসে আসার হয়রানির অভিযোগ কমে যাবে। তাছাড়া এতে ভ্যাটের তথ্য ও ঘোষণার স্বচ্ছতাও নিশ্চিত হবে। ভ্যাট কর্তৃপক্ষ যেকোনো সময়ে যেকোনো ভ্যাটের ঝুঁকি এড়াতে এসব তথ্য ও ঘোষণা ব্যবহার ও কাজে লাগাতে পারবেন।
ভ্যাট আইনের চতুর্থ চ্যালেঞ্জ নিয়ে মইনুল বলেন, নতুন ভ্যাট আইন অনুযায়ী রিফান্ড ও প্রত্যর্পনের বিষয়টি স্ব-স্ব ভ্যাট কমিশনারেট দেখবে। এজন্য ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত ও আলাদাভাবে আবেদন করার প্রয়োজন নেই। ভ্যাটের রিটার্ন এসবের আবেদন হিসেবে গণ্য হবে।
নতুন ভ্যাট আইনে রিফান্ড সমন্বয় সহজ করার কথা বলেন তিনি। নতুন ভ্যাট আইন অনুযায়ী এনআরের নির্দেশনা অনুসারে কিছু শর্ত পূরন করলে যে কেউ প্রতি মাসে ১০ শতাংশ হারে সমন্বয় করতে পারছেন। ভ্যাটদাতা প্রতিষ্ঠান নিজে সমন্বয় করে তার নিজের রিটার্নে উল্লেখ করবেন। অন্যদিকে, আমদানিকারকরা কাস্টমস স্টেশনগুলোতে পরিশোধিত ৫ শতাংশ হারে অগ্রিম করের (এটি) হিসাবটি তার মাসিক রিটার্নের সাথে সমন্বয় করতে পারছেন।
ভ্যাট অনলাইন প্রকল্প অনলাইনে সেবা দেওয়া এবং মনিটরিং কার্যক্রম দায়িত্ব নিয়েই করছে। আমরা চাই ভ্যাটদাতা প্রতিষ্ঠানের জন্য দ্রুত সেবা ও হয়রানিমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা। একইসাথে, জনগণ থেকে আদায় করা প্রকৃত ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা নিশ্চিত করতেও ভ্যাট কর্তৃপক্ষ বদ্ধপরিকর বলে মনে করেন ড. মইনুল।
বড় ভ্যাট দাতা প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশেষ সফটওয়্যার তৈরির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যাকে সপ্তম চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন তিনি। যেসব প্রতিষ্ঠানের মাসিক টার্নওভার ৫ কোটি টাকার উপরে তাদের এই সফটওয়্যার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আশা করছি, সফটওয়্যারটি এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে চালু হবে। এটি চালু হলে প্রতিষ্ঠানের কেনা-বেচা, স্টক, পেমেন্টসহ যাবতীয় তথ্য কম্পিউটারে সংরক্ষিত হবে।
অভিযোগের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাকে আরেকটি চ্যালেঞ্জ বলছেন এই ভ্যাট কমিশনারেট। নতুন ভ্যাট আইনের আরেকটি দিক হচ্ছে যেকোনো ক্রেতা তার ভ্যাট জমা হয়েছে কিনা বা আশেপাশের প্রতিষ্ঠানের কোনো ভ্যাট ফাঁকির তথ্য থাকলে তিনি ১৬৫৫৫ এ কল দিতে পারবেন। এটি ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকবে এবং এই সেন্টারে যেকোনো জিজ্ঞাসার জবাব পাওয়া যাবে। তাছাড়া ব্যবসায়ীরাও তাদের যে কোন তথ্য বা সেবা প্রাপ্তির জন্য জিজ্ঞাসা করতে পারবেন। এতে তাদের হয়রানিও কমে যাবে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নতুন আইনে ভ্যাট আদায় চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করা হয়। কারণ এদের সংখ্যা ব্যাপক এবং দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে। এসব প্রতিষ্ঠানের নগদ লেনদেন বেশি হওয়ায় প্রতিটি লেনদেনের হিসাব রাখা ও তা মনিটরিং করা জটিল। এজন্য এনবিআর ২৪ ক্যাটাগরিতে ইএফডি চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর এই ইএফডি এনবিআরের সার্ভারে সরাসরি সংযুক্ত থাকায় কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ভ্যাট ফাঁকি দিতে পারবে না। এক্ষেত্রে প্রথম পর্যায়ে সারাদেশে ১০ হাজার ইএফডি সরবরাহ কররে এনবিআর।
সর্বশেষ চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে প্রশিক্ষণ। আমরা প্রায়ই নতুন আইনে টেকনিক্যাল ও জটিল ব্যাখ্যার সম্মুখীন হই। এগুলো অনেক সময় ভ্যাটদাতা ও ভ্যাট কর্মকর্তাদের কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়। তবে বিষয়টি সহজভাবে উপস্থাপন করার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়েছে। মাঠপর্যায়ে এসব সমস্যা সমাধানে সহায়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। আমি দেখেছি অধিকাংশ ব্যবসায়ী আইন মেনে ব্যবসা করতে চান। তারা আইনটা জানতে চান। খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে চান।
সবশেষে ড. মইনুল খান বলেন, সরকার ও এনবিআরের নির্দেশমত মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা নতুন আইন বাস্তবায়নে অত্যন্ত আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতার সাথে কাজ করছে। কোথাও কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা তাৎক্ষণিকভাবে সমাধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। নতুন ভ্যাট আইন পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে দেশে রাজস্ব বাড়বে, চলমান অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অর্থায়ন বাড়বে এবং সার্বিক দিক থেকে সমৃদ্ধি আসবে।