Monday 21 Oct 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সড়কে বেপরোয়া যানে ঝরছে প্রাণ, মিলছে না সমাধান


১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৭:৫৬

ঢাকা: সড়কে নৈরাজ্য কায়েম করেছে গণপরিবহনের চালকরা। প্রায় প্রতিদিনই ঝরছে প্রাণ, পঙ্গু হচ্ছেন অনেকে। নিয়ন্ত্রণহীন চালকদের নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ ট্রাফিক পুলিশও।

চলতি মাসের ৫ তারিখে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ফারহা নাজ (২৫) নামে এক নারীর। তার ১৫ মাস বয়সী একটি কন্যা শিশুও রয়েছে। সেদিন সকাল পৌনে ৯টার দিকে স্বামী পাভেলের সঙ্গে মোটরসাইকেলে করে মিরপুরের মনিপুর থেকে মহাখালীর আমতলী অফিসে যাচ্ছিলেন ওই নারী। মহাখালীর আমতলীতে পৌঁছে মোটরসাইকেল থেকে নেমে রাস্তা পার হওয়ার জন্য ফুটপাতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন। সে সময় কাকলী পরিবহনের একটি বেপরোয়া গতির বাস এসে চাপা দেয় তাদের দুজনকে। ফারহা নাজের স্বামী অল্পের জন্য রক্ষা পেলেও মৃত্যু হয় তার।

বিজ্ঞাপন

এর সপ্তাহখানেক আগে গত ২৭ আগস্ট দুপুরে বাংলামোটরে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে ব্যাংকে যাচ্ছিলেন বিআইডব্লিউটিসির সহকারী ব্যবস্থাপক কৃষ্ণা রায় চৌধুরী (৫৫)। সে সময় ট্রাস্ট ট্রান্সপোর্ট নামের একটি বাস বেপরোয়া গতিতে ফুটপাতে উঠে চাপা দেয় কৃষ্ণাকে। ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গেলেও হারাতে হয় বাম পা।

কৃষ্ণা রায় বাসের চাপায় পা হারিয়ে প্রাণে বাঁচলেও, বাঁচতে পারেননি কণ্ঠশিল্পী আপেল মাহমুদের ছোট ভাই কণ্ঠশিল্পী ও সংগীত পরিচালক মো. পারভেজ রব (৫৬)। ৫ সেপ্টেম্বর সকালে রাজধানীর তুরাগের ইস্ট-ওয়েস্ট হাসপাতালের সামনে সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ভিক্টোর পরিবহনের একটি বেপরোয়া বাসের চাপায় মৃত্যু হয় তার। ঠিক তার দুদিন পর ৭ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে একই কোম্পানির আরেকটি বেপরোয়া বাসের চাপায় মৃত্যু হয় পারভেজ রবের ছেলের বন্ধু ইয়ামিন আলভির (২০)-এর। পারভেজ রবের মৃত্যুতে তিন দিনের লোক খাওয়ানোর জন্য আগের রাতে কাঁচা বাজারে যাচ্ছিলেন তারা দুই বন্ধু।

বিজ্ঞাপন

বিশেষজ্ঞরা এই মৃত্যুর কারণকে দুর্ঘটনা না বলে হত্যা বলে মনে করছেন। তাদের মতে, খুব শিগগিরই সব পক্ষের সমন্বয়ে রাস্তার শৃঙ্খলা না ফেরালে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। এক্ষেত্রে বাসের মালিক-শ্রমিকদেরকে আরও সচেতন হওয়ারও তাগিদ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠান (এআরআই)-এর হিসাব মতে, গত আগস্ট মাসেই সারাদেশে মোট সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৯৫টি। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৪৭১ জন। আর আহত হয়েছেন ৮৯২ জন।

এছাড়া শুধু রাজধানীতেই গত একমাসে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৫টি। এতে প্রাণ হারিয়েছেন ৩৭ জন এবং আহত হয়েছেন ৪২ জন। এসব দুর্ঘটনার অধিকাংশই ছিল বেপরোয়া গতি। যার জন্য ৯০ শতাংশই চালক-হেলপাররা দায়ী।

বুয়েটের এআরআই-এর পরিচালক ডক্টর মিজানুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর কিছুদিন সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামলেও এখন আবারও সেই পুরোনো অবস্থা। নিয়মের তোয়াক্কা করছে না কেউ। জেব্রা ক্রসিং থাকলে সেখানে যেন গাড়ির গতি আরও বেড়ে যায়। যাত্রী ওঠানো-নামানোর চিত্র তো আরও ভয়াবহ। এছাড়া দুই বাসের প্রতিযোগিতা দেখলে আতঙ্ক ছড়ায় যাত্রীদের মাঝেই। এসবের জন্য পরিবহনের মালিকরাই দায়ী। তারাই চালকদের বাধ্য করে এসব পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে।’

মালিকরা যত শক্তিশালীই হোক না কেন, রাষ্ট্র বা সরকারের থেকে তো বেশি শক্তিশালী না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সরকারের একটা স্ট্রং স্টেটমেন্ট থাকা দরকার। এই যে পরিবহনের নৈরাজ্য এটা নিয়ে মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। এমনকি এর কারণে সরকারের অনেক সাফল্য ম্লান হচ্ছে। এটা সরকারের বোঝা উচিত এবং একটা কঠোর অবস্থানে গিয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ যেন বাস্তবায়ন করা যায় সেই কাজ করা উচিত।’

এ বিষয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতি মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী তড়িঘড়ি করে ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ পাশ করা হলেও এখন পর্যন্ত আইনটির বাস্তবায়ন হয়নি। চালকদের প্রশিক্ষণ, যানবাহনের ফিটনেস আধুনিকায়ন, রুট ফ্রাঞ্চাইজি সিস্টেমে বাস চলাচল নিশ্চিত করা, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য বন্ধ, সড়কে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা বন্ধ করা, শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নিশ্চিত করতে সরকারের অঙ্গীকার আজও দৃশ্যমান নয়।’

 

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুর্ঘটনা তাকেই বলে যা কখন, কিভাবে, কোথায় ঘটবে তা মানুষ জানে না। কিন্তু যেটি আমাদের সৃষ্টি করা বা সহজে দূর করা যায় কিংবা সুনির্দিষ্ট কারণে ঘটে সেটিকে আর দুর্ঘটনা বলা যায় না, সেটি নিঃসন্দেহে হত্যাযজ্ঞ। এর জন্য সরকার কোনভাবেই দায় এড়াতে পারবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘যখনই কোনো চালককে আটক করা হয়, দেখা যায় তার রুট পারমিট অথবা লাইসেন্স কোনো কিছু একটা নেই। অথবা লাইসেন্স থাকলেও হালকা যানের লাইসেন্স নিয়ে ভারী যান চালাচ্ছেন। এসব ব্যাপারে যারা গাফিলতি করছে তাদের গাফিলতি দেখার দায়িত্ব কি সরকারের নয়? আমাদের দেশে চালককে দায়ী করতে গিয়ে প্রকৃত দোষীরা বাইরে থাকছেন? এটা তাদের জন্য একটা পুরষ্কারও বটে। কিন্তু চালককে যতই শাস্তি দেওয়া হোক না কেন, যেহেতু তারা কারণ না তাই যারা এটার জন্য মূল দায়ী তাদের যদি শাস্তি দেওয়া যায় তাহলে এই প্রতিযোগিতার বা পচা সিস্টেমটার পরিবর্তন আসবে।’

বেপরোয়া চালক সড়ক দুর্ঘটনা

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর