বন্ধ হয়ে যাচ্ছে মিরপুরের ‘জারা জিন্স’, বেকার হবেন ৮শ শ্রমিক
১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৯:১৫
ঢাকা: ক্রয় আদেশ না পাওয়া ও গার্মেন্টস পরিচালনায় মালিকপক্ষের ব্যর্থতার কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে মিরপুরের জারা জিন্স অ্যান্ড নিটওয়্যার নামের একটি কারখানা। এতে সাময়িকভাবে বেকার হয়ে পড়বেন অন্তত ৮০০ শ্রমিক।
পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, ওই জারা জিন্সের মালিকপক্ষ ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধে কারখানার যন্ত্রপাতি বিক্রির চেষ্টা করছে মালিকপক্ষ। তবে দরদামে বনিবনা না হওয়ায় এখনো সেগুলো বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। ফলে বকেয়া পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত গার্মেন্টের অভ্যন্তরে অবরুদ্ধ হয়ে থাকছে মালিকপক্ষ।
আরও পড়ুন- ‘পাওনা টাকা পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত মালিক অবরুদ্ধ থাকবেন’
জানতে চাইলে বিজিএমইএ’র সিনিয়র সহসভাপতি ফয়সাল সামাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘তারা (জারা জিন্স) কারখানা বন্ধ করে দেবে। কারণ তারা আর কারখানা চালাতে পারছে না। এখন বন্ধ করার প্রক্রিয়া চলছে। তাদের কোনো অর্ডার (ক্রেতা) নেই। অনেকদিন ধরে শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিচ্ছে।’
এক প্রশ্নের উত্তরে ফয়সাল সামাদ বলেন, ‘কোনো মালিক ইচ্ছা করে কারখানা বন্ধ করে না। কারখানা বন্ধ বা চালু করা— দু’টিই কঠিন প্রক্রিয়া। ক্রেতা না থাকার কারণেই মালিক পক্ষ কারখানা বন্ধের দিকে এগুচ্ছে।’
বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে রোববার (১৫ সেপ্টেম্বর) বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা
বিজিএমইএ’র পরিচালক (শ্রম) রেজওয়ান সেলিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘গার্মেন্টেসের ভেতরে শ্রমিকরা অবস্থান নিয়েছে। টাকা না পাওয়া পর্যন্ত তারা অবস্থান ছাড়বে না। কিন্তু মালিকের টাকা নেই। প্রথমদিকে জারার মালিককেও খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে পুলিশ তাকে ধরে বিজিএমইএ’তে নিয়ে আসে। এখন তিনি মেশিন বিক্রির চেষ্টা করছেন। গতকাল (রোববার, ১৫ সেপ্টেম্বর) তিনটি পার্টি এসেছিল। কিন্তু বনিবনা হয়নি। উনি (মালিক) সময় নিয়েছেন। তিন দিনের মধ্যে অর্থাৎ ১৮ তারিখ টাকা পরিশোধ করার কথা দিয়েছেন তিনি।’
নাম প্রকাশ না করা শর্তে বিজিএমইএ’র একটি সূত্র জানায়, ঈদের সময় কারখানাটিতে যখন আন্দোলন চলছিল তখন বিজিএমইএ’র মধ্যস্থতায় ওই মালিকের জন্য একটি ব্যাংককে এক কোটি টাকা ঋণ দিতে সুপারিশ করা হয়। পরে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা ঋণ দিলে ওই মালিক বিজিএমইএ’র ওপরই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। বিজিএমইএ’র একজনের ভাষ্য, ‘আমরা ঋণের ব্যবস্থা করে দিলাম। অথচ তিনি আমাদের ওপরই ক্ষিপ্ত হলেন। এটা দুঃখজনক।’
আরও পড়ুন- বিজিএমইএ’র উপর ভরসা নেই, পাওনা টাকা নিয়েই ফিরতে চান শ্রমিকরা
এবারে জারা জিন্সের মালিক নতুন কোনো স্থানে কারখানা চালুর চেষ্টা করলে তাকে বিজিএমইএ লাইসেন্সই দেবে না বলে জানান সংগঠনটির পরিচালক (শ্রম) রেজওয়ান সেলিম। তিনি বলেন, এ ধরনের ব্যক্তির এ খাতে থাকা উচিত নয়।
এদিকে, আন্দোলনে অংশ নেওয়া জারা জিন্সের অপারেটর নুপুর আক্তার মমতাজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘মালিক এখনো ভেতরে আছে। উনি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, ২ মাসের বেতন ও একমাসের বেসিক দেবেন। কিন্তু কবে টাকা দেবেন, এখনো জানাননি।’
এক প্রশ্নের উত্তরে এই শ্রমিক বলেন, ‘উনি ফ্যাক্টরি কিভাবে চালাবেন? উনার তো চালানোর ক্ষমতা নেই। এই খবর (আন্দোলন) তো সারাবিশ্ব জেনে গেছে। কোনো বায়ার কি আর তাকে অর্ডার দেবে?’ নুপুর জানান, কারখানাটির মালিকের কাছে ওই ভবন অর্থাৎ মিরপুরের মল্লিক টাওয়ারের মালিকের ভাড়া এবং গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির বিলসহ ১ কোটি ১০ লাখ টাকা পাওয়া রয়েছে। সেই টাকা আদায়ে ভবন মালিকও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
মল্লিক টাওয়ারের সামনে শ্রমিকদের অবস্থান
আন্দোলনে অংশ নেওয়া আরেক শ্রমিক মেহেদি হাসান (প্যাকিং ম্যান) সারাবাংলাকে বলেন, বর্তমানে পরিস্থিতি ঠান্ডা রয়েছে। মালিক পক্ষ কারখানা বন্ধ করে দেবে। আর বুধবারের মধ্যে পাওনা টাকা দেওয়ার কথা রয়েছে।
বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, চিড়িয়াখানা রোডের জারা জিন্স নামের ওই কারখানাটির মালিক পাঁচ জন। এর মধ্যে গোলাম মোস্তাফা, রেজা ও রিয়াজুল ইসলাম রাজু— এই তিন জনের নাম জানা গেছে, বাকি দু’জনের নাম জানা যায়নি। তবে শ্রমিকরা রিয়াজুল রাজুকেই মালিক হিসেবে জানেন। কারখানাটিতে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে তাকেই।
রিয়াজুল ইসলাম রাজুর সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হলে তিনি নিজেও কারখানার একজন মালিক বলে জানান সারাবাংলাকে। তবে তার দাবি, কারখানাটিতে ‘সামান্য আন্দোলন’ চলছে। এর বেশি তথ্য জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।
আরও পড়ুন- ৩ মাস ধরে বেতন-ভাতা নেই, মিরপুরে পোশাক শ্রমিকদের অবরোধ
এর আগে, রোববার (১৫ সেপ্টেম্বর) বকেয়া বেতনের দাবিতে মিরপুরের রাস্তায় নামেন জারা জিন্সের কর্মীরা। রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া শ্রমিকদের দাবি, টানা তিন মাস ধরে বকেয়া বেতন-ভাতা দিতে টালবাহানা করছে মালিকপক্ষ। একাধিকবার প্রতিবাদ করেও এর সমাধান পাননি তারা।
রোববার শ্রমিকরা মিরপুরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করলে যানজট তৈরি হয় গোটা রজধানীতে। পরে পরিস্থিতি সামলাতে ওইদিন বিকেলে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিজিএমইএ প্রতিনিধিদের নিয়ে মালিকের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। প্রায় সাত ঘণ্টার টানা আলোচনা শেষে কারখানার মালিক সিদ্ধান্ত নেন, আগামী বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) শ্রমিকদের পাওনা টাকা পরিশোধ করবেন। শ্রমিকরা এ সিদ্ধান্ত মানলেও কারখানা থেকে মালিক রিয়াজুল ইসলাম রাজুকে আর বের হতে দেননি। শ্রমিকরা শর্ত দেন টাকা পাওয়ার পরেই তিনি কারখানা থেকে বের হতে পারবেন।
এদিকে, গত চার মাসে দেশের ৩৫টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতিবেশী প্রতিযোগী দেশের সক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় দেশের কারখানাগুলোর ক্রয় আদেশ কমে যাওয়াকেই এসব পোশাক কারখানা বন্ধের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ১৭ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে গেছেন। জারা জিন্সের কার্যক্রম গুটিয়ে গেলে বন্ধ হওয়া কারখানায় তালিকায় যোগ হবে আরেকটি নাম, নতুন করে বেকার হয়ে পড়বেন আরও ৮০০ শ্রমিক।
কারখানা বন্ধ জারা জিন্স জারা জিন্স অ্যান্ড নিটওয়্যার বিজিএমইএ বেতন বকেয়া