Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সিন্ডিকেট চালাচ্ছে বিআরটিসি বাস, লাভের ভাগ কর্মকর্তাদের পকেটে


১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১০:২২

ঢাকা: সংস্থার নিজস্ব লোকবলের মাধ্যমে বিআরটিসি বাস পরিচালনায় মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকলেও সাবেক চেয়ারম্যান চড়া দরে তা সিন্ডিকেটের হাতে তুলে দিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সংস্থার কর্মচারীদের দাবি, নিজের পকেট ভারি করে সম্পূর্ণ অবৈধ প্রক্রিয়ায় চেয়ারম্যান সরকারি বাস ছেড়ে দিয়েছেন বেসরকারি খাতে। সাবেক চেয়ারম্যান ‘সুষ্ঠুভাবে’ বাস পরিচালনার স্বার্থে বহিরাগতদের হাতে বাস দেওয়ার কথা স্বীকার করলেও ‘চড়া দাম’ নেওয়ার কথা স্বীকার করেননি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কাগজে-কলমে ধানমন্ডি চক্রাকার রুটে বিআরটিসির বাস চালান আলী হোসেন মোল্লা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই রুটের বাসের দায়িত্বে মোল্লার পরিবর্তে আছেন হেলাল নামে একজন। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে হেলাল ও তার সহযোগীরা যুবলীগ ঢাকা উত্তরের সভাপতি মাইনুল হক নিখিলের লোকজন বলে পরিচয় দেন।

মতিঝিল থেকে চক্রাকারে ২০টি নতুন এসি বাস চলে। এখন এই ২০টি বাসে বিআরটিসির লোগো থাকলেও তা পরিচালনা করছেন যুবলীগের ঢাকা উত্তর শাখার সভাপতি নিখিলের লোকজন। দিনশেষে তারাই লাভের হিসেব গুনছেন বলে অভিযোগ আছে। এ বিষয়ে সংস্থার সাবেক চেয়ারম্যান ফরিদ আহমেদ ভুঁইয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাইনুল হক নিখিলের অনুরোধে তাদের হাতে তিনি বাস দিয়েছেন।’

গাবতলী বাস ডিপোর নতুন নন-এসি টাটা বাস চালাচ্ছেন শিবালয় উপজেলা পরিষদের সাবেক এক চেয়ারম্যানের ভাতিজা জসিম। তার বিরুদ্ধে ২০১৪ সালে রাজনৈতিক সহিংতার সময়ে গাড়িতে অগ্নিসংযোগের মামলা রয়েছে। তারপরও সাবেক বিআরটিসি চেয়ারম্যানকে ‘ম্যানেজ করে’ জসিম গাবতলী ডিপোর বাস দখলে নিয়েছে বলে অভিযোগ আছে।

জোয়ার সাহারা বাস ডিপোতে দেওয়া হয়েছে ভারত থেকে আসা নতুন ৩০টি বাস। এর মধ্যে ১০টি নতুন এসি বাস ও ২০ নতুন দোতলা বাস। দোতলা বাস পরিচালনা করছে লিটন নামের একজন। জানা গেছে, লিটন হোটেল রিজেন্সির একাংশের মালিক আরিফ মোতাহারের লোক। এসব বাস ছাড়াও আরিফ আব্দুল্লাহপুর-মতিঝিল বিআরটিসির এসি বাস চালান। এই বাসগুলোর সিট নোংরা এবং তদারকির অভাবে নষ্ট হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে।

মতিঝিল আব্দুল্লাহপুর রুটের জন্য বরাদ্দ প্রায় ৩০টির মতো বাস বহিরাগতরা এ রুট থেকে তুলে নিয়ে অন্য রুটে চালাচ্ছে। এ কারণে মতিঝিল-আব্দুল্লাহপুর রুটের যাত্রীরা এখন বিআরটিসির এসি বাস তেমন পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন। এছাড়া, নতুন চালু হওয়া উত্তরা সার্কুলার রুট থেকে বাস তুলে নিয়ে উত্তরা-মতিঝিল রুটে চালাচ্ছেন খিলক্ষেত ছাত্রলীগের সাবেক নেতা সাদিকুর রহমান।

অভিযোগ আছে, বাস কাউন্টার থেকে তারা বিআরটিসির টিকিট বিক্রি করছেন নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে দ্বিগুণে। এ অভিযোগ শুনে বিআরটিসির নির্ধারিত ভাড়া নিতে নির্দেশ দিয়েছেন নতুন চেয়ারম্যান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিআরটিসি বাস লিজ দেওয়া বন্ধে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বারবার কঠোর নির্দেশনা দিলেও আরিফকে দীর্ঘমেয়াদি ইজারায় আরও ২০টি গাড়ি দিয়েছেন সাবেক চেয়ারম্যান। ঢাকা-মাওয়াসহ বিভিন্ন রুটে এগুলো চলছে। নারায়ণগঞ্জ বাস ডিপোতে ১১টি নতুন এসি বাস দেওয়া হয়েছে। এগুলোও আলী হোসেন মোল্লা ও লিটন— এ দু’জন সমন্বয় করে চালাচ্ছেন।

বিআরটিসির কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন কেনা বাস বহিরাগত লোকজনের হাতে ছেড়ে নিজের পকেটে টাকা ভরেছেন চেয়ারম্যান ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া। এই টাকা তিনি ডিপো ম্যানেজারের কাছ থেকে সংগ্রহ করতেন। নতুন চেয়ারম্যান এহছানে এলাহী যোগদানের পর এসব অভিযোগ শুনেছেন। তবে তিনি বলেন, ‘এগুলো ঠিক কি না, হলফ করে বলা যাচ্ছে না। তবে এখন থেকে এ ধরনের ঘটনা একটিও ঘটবে না।’

নতুন চেয়ারম্যান জানান, বিআরটিসির নিজস্ব লোকবলের সংকট থাকায় এখন বাসগুলো বহিরাগতরা চালালেও পর্যায়ক্রমে এগুলো নিজস্ব লোকই চালাবে— এমন ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছেন তিনি। ‘এখন থেকে বাস ইজারাদার বা মৌখিক ইজাদার কেউ বিআরটিসির প্রাপ্য এক টাকাও পকেটে তুলতে পারবে না। আর বিআরটিসির কাউকে টাকা দেওয়া হলে পরিণতি ভালো হবে না,’— বলেন এহছানে এলাহী।

বিভিন্ন ডিপো ঘুরে জানা গেছে, ডিপো ম্যানেজাররা তাদের বরাদ্দের গাড়ি বিভিন্ন সিন্ডিকেটের হাতে পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে এসি গাড়ি প্রতি ১ লাখ ও নন-এসি গাড়িতে ৫০ হাজার টাকা করে নেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিআরটিসির একজন ডিপো ম্যানেজার সারাবাংলাকে বলেন, এসব টাকা পরে সাবেক বিআরটিসি চেয়ারম্যানকে দিতে হয়েছে।

ওই ডিপো ম্যানেজার আরও জানান, টাকা বরাদ্দ না দেওয়া পর্যন্ত চেয়ারম্যান কোনো ডিপোতে বাস দেন না। এজন্য আগে সিন্ডিকেট টাকা তুলে দেয়, তারপর তারা বাস পায়। তবে টাকা না পেলে বাস দেওয়া হয় না। এজন্য  খুলনা, বগুড়াসহ বিভিন্ন ডিপোতে বাস দেয়া হয়নি বলেও জানান তিনি।

টাকা না পাওয়ায় বহু বাস ডিপোতে অলস পড়েছিল। নতুন চেয়ারম্যান যোগ দিয়েই বাসগুলো দ্রুত সড়কে নামানোর নির্দেশ দিয়েছেন। এজন্য এখন মাস্টাররোলে চালক নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে।

বিআরটিসির প্রধান কার্যালয়ের একজন কমকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘ঈদের আগে ভারত থেকে আনা ৮৩টি নতুন বাস টাকা না পেয়ে বসিয়ে রেখেছিলেন চেয়ারম্যান। টাকা না দেওয়ায় এগুলো ছাড়া হয়নি।

এছাড়া বিভিন্ন রুট হিসেবে বহিরাগত সিন্ডিকেটের কাছ থেকে আলাদা টাকা নিতেন বিআরটিসি চেয়ারম্যান ফরিদ আহমেদ ভুঁইয়া। অভিযোগ আছে, বিআরটিসির কুড়িল বিশ্বরোড থেকে নরসিংদীর পাঁচদোনা পর্যন্ত বাস পরিচালনাকারী শুভ নামে একজন প্রতিমাসে চেয়ারম্যানকে দুই লাখ টাকা করে দিতেন। এখান থেকে ডিপো ম্যানেজার প্রতি মাসে পান ১ লাখ টাকা।

এছাড়া গাজীপুর ডিপোর অধীনে কুড়িল থেকে গাউছিয়া পর্যন্ত আর্টিকুলেটেড বাস পরিচালনা করেন জিল্লুর রহমান। প্রতি মাসে বিআরটিসির নির্ধারিত রাজস্ব জমা দেওয়ার পর গাজীপুর ডিপো ম্যানেজারকে ৩ লাখ টাকা করে দিতে হয় তাকে। যেখান থেকে বিআরটিসির আগের চেয়ারম্যান প্রতিমাসে পেতেন ২ লাখ টাকা করে। গাজীপুর ডিপো ম্যানেজারকে তার ডিপো থেকে আরও অতিরিক্ত তিন লাখ টাকা দিতে হতো আগের চেয়ারম্যানকে। এভাবে শুধু গাজীপুর বাস ডিপো থেকেই বিআরটিসির সাবেক চেয়ারম্যান প্রতি মাসে নিতেন ৫ লাখ টাকা।

এ নিয়ে জানতে চাইলে সাবেক বিআরটিসি চেয়ারম্যান ও সদ্য জাতীয় আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদফতরের মহাপরিচাক হিসেবে যোগ দেওয়া ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, ‘এগুলোর কোনোটি সঠিক নয়। ইজারাদারদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’

অন্যদিকে ইজারাদার জিল্লুর সারাবাংলাকে জানান, বদলির সপ্তাহখানেক আগেও ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া তাকে অফিসে ডেকে নিয়েছিলেন। তাকে বাদ দিয়ে অন্য আরেকজনকে এ সময় এ রুটে ইজারা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন সাবেক চেয়ারম্যান— বলেন তিনি।

বিআরটিসি বিআরটিসি বাস লাভের টাকা সিন্ডিকেট


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর