Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

৫০ বছরে বিলীন ১০০ নদী, মৃত্যুর প্রহর গুনছে শতাধিক


২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১০:৩৫

নৌকায় জেলেরা

ঢাকা: বাংলা তথা বাংলাদেশ মূলত ভাটি অঞ্চল। ফলে উজান থেকে নেমে আসা বেশিরভাগ নদী কিংবা জলাধার এ জনপদের হৃদয় ছিঁড়ে গিয়ে মিশেছে সমুদ্রে। কোনো কোনো নদী আবার থেমে গিয়েছে জনপদের ভেতরেই। তাই ভাটিবাংলাকে পশ্চিমারা আদর করে বলেন বেঙ্গল বেসিন। প্রাচ্যের সাধকেরা আবার ডেকে থাকেন জলেশ্বরী।

বাংলাদেশের সমস্ত বুক জুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে আছে নদীগুলো। তবে ঠিক কতটি নদী এদেশের পলল ভূমিকে বিদীর্ণ করেছে তার প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে এখনো নিশ্চিত কোনো তথ্য জানা যায়নি। বিভিন্ন নথিপত্র নদীগুলোর প্রকৃত সংখ্যার ভিন্ন ভিন্ন উত্তর দিয়ে আসছে। অনেক নদীর কথা পুরাণে উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। অনেক অন্তঃসলিলা নদী আবার সময়ের স্রোতে শরীর মিশিয়ে জেগে উঠেছে আপন মনে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের নদীগুলোর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে দ্বিমত থাকলেও এদেশের বেশিরভাগ নদীর অস্তিত্ব হুমকিতে আছে এ ব্যাপারে প্রায় সবাই একমত। উজানে বাঁধের কারণে এদেশের অনেক নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। অনেক নদী আবার ভরাট করে ফেলছে স্বার্থান্বেষী ব্যবসায়ীরা। এছাড়াও নাব্যতা সংকট সহ বিভিন্ন কারণে পলি জমে জমে অনেক নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে প্রতিবছর।

ভরাট হয়ে যাওয়া এসব নদীর বুকে তরতর করে উঠে যাচ্ছে বহুতল ভবন। তৈরি হচ্ছে পথঘাট, পার্কসহ নানা আধুনিক স্থাপনা। এ কারণে দেশে নদ-নদীর ভবিষ্যৎ নিয়ে যেমন শঙ্কা তৈরি হয়েছে, তেমনি বড় হুমকির মুখে পড়েছে জীব-বৈচিত্র্য।

নদী গবেষকরা বলছেন, গত ৫০ বছরে এ দেশে কমপক্ষে ১০০টি নদী বিলীন হয়ে গেছে। মুমূর্ষু অবস্থায় মৃত্যুর প্রহর গুনছে আরও শতাধিক নদী। নদীর এসব সংকটের বেশিরভাগ কারণই মানব সৃষ্ট!

বিজ্ঞাপন

হেমন্ত থেকে গ্রীষ্মের শুরু পর্যন্ত পর্যাপ্ত পানি প্রবাহ না থাকায় দেশের এক তৃতীয়াংশ নদী এখন রীতিমত ধুঁকছে। গ্রামাঞ্চলে শুকনো নদীর বুকে চাষাবাদ হলেও শহরের পাশের নদীগুলো একটু একটু করে দখল করে ফেলছে সুবিধাভোগীরা। ফলে বর্ষাকাল ছাড়া অন্যান্য ঋতুতে এসব নদীকে-নদী বলে ডাকার সুযোগ থাকছে না কারো। অনেক নদী আবার পানি প্রবাহের অভাবে এরইমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

পোস্তগলা এলাকায় জাল ফেলে মাছ ধরার চেষ্টায় স্থানীয় কেউ

বাংলাদেশের নদীগুলোর মধ্যে মুমূর্ষু অবস্থায় দিনযাপন করছে ময়মনসিংহের পুরনো ব্রহ্মপুত্র, নেত্রকোনার মগড়া, কংস, সোমেশ্বরী, খুলনার রূপসা, শিবসা, ডাকি, আত্রাই, ফরিদপুরের কুমার, বগুড়ার করতোয়া, কুমিল্লার গোমতি, পিরোজপুরের বলেশ্বর, যশোরের ভৈরব, কপোতাক্ষ, ইছামতি, বেতনা, মুক্তেশ্বরী, কিশোরগঞ্জের নরসুন্দা, ঘোড়াউত্রা, ফুলেশ্বরী, রাজবাড়ীর হড়াই, কুড়িগ্রামের ধরলা, গাইবান্ধার ঘাঘট, বান্দারবানের সাঙ্গু, খাগড়াছড়ির চেঙ্গী, নওগাঁর আত্রাই এবং জামালপুরের ঝিনাই নদী।

এসব নদীর তীরবর্তী মানুষেরা বর্ষা ঋতুতে নদীকে জেগে উঠতে দেখলেও সারাবছর মৃত নদীকে সঙ্গী করেই কাটিয়ে দেয় সময়। যদিও একসময় এসব স্রোতস্বিনীকে কেন্দ্র করেই নির্ধারিত হতো তাদের জীবন ও যাপন। এমনকি শহরগুলোর গোড়াপত্তনও হয়েছিল এই নদীগুলোকে কেন্দ্র করে। আর শহরের চাহিদা মেটাতে গিয়েই বার্ধক্যের দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে এসব নদী।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার উত্থানও এমনই একটি নদীকে কেন্দ্র করে। প্রাথমিকভাবে বুড়িগঙ্গা নদীর দুই তীরে জনবসতি নির্মাণ শুরু হলেও, আরও তিনটি নদীর সঙ্গে রয়েছে ঢাকার মানুষের নিবিড় যোগাযোগ। পরিখার মতো করে ঢাকাকে বেষ্টন করে থাকা তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা এবং ধলেশ্বরী নদীও এখন দখল ও দূষণের করুন শিকার। ফলে এই নদীগুলোর অস্তিত্ব পড়েছে হুমকির মুখে।

গবাদি পশু চড়ানো হচ্ছে নদীর পাড়ে

আজ বিশ্ব নদী দিবস। নদী রক্ষায় সচেতনা বাড়াতে প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের চতুর্থ রোববার বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হয়ে আসলে ও বাংলাদেশে তা রাষ্ট্রীয়ভাবে  এখনও পালন করা হয়না। এবারে দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো- ‘নদী একটি জীবন্ত সত্তা, এর আইনি অধিকার নিশ্চিত করুন।’

দিবসটি নিয়ে নদী পরিব্রাজক দলের সভাপতি মো. মনির হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, অনান্য দিবসে রাষ্ট্রীয়ভাবে যে গুরুত্ব দেওয়া হয় বা পালন করা নদী দিবসে তা হয়না। যদিও আমাদের অনুরোধে  ২০১৬ সাল থেকে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনক কর্তৃপক্ষ আমাদের আয়োজনে যোগ দেয়। কিন্তু দিনটি যদি গুরুত্বের সঙ্গে সরাকারিভাবে জাকজমকপূর্ণ করে পালন করা হত তাহলে নদী রক্ষায় মানুষের সচেতনতা  কিছুটা হলেও বাড়বে।

মনির হোসেন  বলেন, আমাদের জাতীয় নদী নাই বা জাতীয় নদী দিবসও নাই। ইতিহাস বলে ঊনবিংশ শতাব্দীতে দেশে সাড়ে ৪ হাজার নদী ছিল্ ।  পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে বর্তমানে নদীর সংখ্যা সাড়ে চারশ। বেসরকারি হিসেবে তা ৭ শ। কিন্তু এখনও পর্যন্ত নদী শুমারিই হয়নি। তাই দেশের প্রকৃত নদীর সংখ্যা কত তা আসলে বলা মুশকিল। নদী শুমারি ও নদীর সজ্ঞা নির্ধারণ করলেই কেবল দেশের নদ-নদীর সঠিক হিসেব বের করা আনা সম্ভব।

নদী গবেষকদের মতে, নদী কখনো একা মরে না। নদীর মৃত্যু হলে পাড়ের জনপদও একটু একটু করে মরতে শুরু করে। রাজধানী ঢাকা যদি বুড়িগঙ্গার মৃত্যুর কারণ হয় তবে নদীর মৃত্যুতে ঢাকার অবস্থাও এখন মুমূর্ষু প্রায়! বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বংশী, বালু এবং শীতলক্ষ্যা নদীর দুধারে গড়ে ওঠা শিল্প কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্যের বিষক্রিয়ায় এসব নদী ধীরে ধীরে প্রাণহীন হয়ে পড়েছে।

তাই নদী বাঁচাতে সম্প্রতি দেওয়া একটি রায়ে যুগান্তকারী মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের উচ্চ আদালত। ঢাকার চার নদী বাঁচাতে প্রয়োজনে রাজধানী সরিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন হাইকোর্ট। নদীকে জীবন্ত সত্তা উল্লেখ করে গত ১ জুলাই দেওয়া ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে এমনই মন্তব্য করেছেন আদালত।

২৮৩ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ ওই রায়ে পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, সবচেয়ে সৌভাগ্যবান শহর সেটি যার পাশ দিয়ে কিংবা মধ্য দিয়ে নদী প্রবাহিত হয়। আমাদের ঢাকা শহরের পাশ দিয়ে একটি দুটি না, চার চারটি নদী প্রবাহিত। এসব নদীর যথাযথ এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে পারলে ঢাকা বহু আগেই সিঙ্গাপুরের চেয়েও সুন্দর নগরীতে পরিণত হত। কিন্তু আমরা সেই সৌভাগ্যকে দুর্ভাগ্যে পরিণত করছি ক্রমাগতভাবে নদীদখল এবং দূষণের মাধ্যমে।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, চারপাশের নদী রক্ষা করতে হলে ঢাকা থেকে জনসংখ্যার চাপ অবশ্যই কমাতে হবে। সেক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর সিদ্ধান্তটি হবে রাজধানী সরিয়ে দূরে কোনো সুবিধাজনক স্থানে নিয়ে যাওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ছিল প্রথমে ফিলাডেলফিয়া যা পরে প্রয়োজনের তাগিদে নিউইয়র্ক এবং আরও পরে ওয়াশিংটন ডিসিতে স্থানান্তরিত হয়। তেমনটি মালয়েশিয়া তার রাজধানী কুয়ালালামপুর থেকে সরিয়ে পুত্রাজায়ায় স্থানান্তর করে।

রায়ে নদী দখলদার ও নদী ভরাটকারীকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশও দিয়েছেন আদালত।

নদী দখলদারদের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশটি ঐতিহাসিক, কারণ নদীর মৃত্যুর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণগুলো মনুষ্য সৃষ্ট সবচেয়ে বড় কারণ এটিই। শুকনো মওসুমের দিনে ভরাটকারীরা দুই পাশ থেকে নদীর প্রশস্ততা কমিয়ে আনে! জলাধার হয়ে পড়ে অস্তিত্বহীন। ফারাক্কা বাঁধ এবং তিস্তা ব্যারাজ এবং উজানে বাঁধ দিয়ে পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দেওয়ার কারণেও অনেক নদীর মৃত্যু ঘটছে। এছাড়া নদীতে প্রতি বছর পলি জমায় তার স্রোত কমে যাচ্ছে। ফলে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

উজানে বাঁধ নির্মাণের কারণে ধীরে ধীরে করুণ পরিণতি বরণ করছে বাংলাদেশের তিস্তা নদী। এককালের খরস্রোতা এই নদীর ১২৫ কিলোমিটার অববাহিকায় জীবনযাত্রা ও জীববৈচিত্র্য এখন ধ্বংসের সম্মুখীন। তিস্তাকেন্দ্রিক সেচ প্রকল্পটিও একরকম অকেজো হয়ে পড়ে আছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে চাষের জন্য এ অঞ্চলে পানির অভাব দেখা দেয়। তিস্তায় পানি না থাকায় উত্তরবাংলার ধরলা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরী, দুধকুমার বুড়িতিস্তাসহ ছোট বড় প্রায় ৩৩ নদীও ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

তিস্তার পর বাঁধ নির্মাণের নির্মম শিকার হওয়া গুরুত্বপূর্ণ নদীটির নাম পদ্মা। পানির অভাবে সর্বনাশা পদ্মা নদী একরকম বালুচরে পরিণত হয়েছে। এই নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ আর জীবনযাত্রাও হয়ে পড়েছে কঠিন। শুকনো মৌসুমে নৌযান চলাচল অব্যাহত রাখতে পদ্মার বুকে ড্রেজিং করে চ্যানেল তৈরি করতে হয়। যে কারণে যমুনার বুকেও জেগে উঠেছে অসংখ্য ডুবোচর।

পদ্মা ও যমুনায় পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় করতোয়া, ইছামতি, বাঙালী নদী, ফুলজোড়, দইভাঙ্গা, হুরসাগর ও বড়াল শুকিয়ে গিয়ে আবাদি জমিতে পরিণত হয়েছে। শুকনো মৌসুমে এসব নদীর মাঝখান দিয়ে নালার মতো পানি প্রবাহিত হয়।

বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালে বাংলাদেশে ৪০৫টি নদী ছিল। তবে অনেকে বলেন বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা ২৩০টি। বেসরকারি হিসেবে সবমিলিয়ে ৯শ থেকে ২ হাজারটি নদী রয়েছে।

নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, যেসব নদী দখল হয়ে গেছে সেগুলোকে যে কোনো মূল্যে উদ্ধার করতে হবে। বাংলাদেশের জন্য নদীগুলো হলো আশীর্বাদ। এটা আমরা যত তাড়াতাড়ি অনুধাবন করতে পারব, ততই মঙ্গল। তা না হলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়বে এদেশের প্রাণ ও প্রকৃতির ওপর।

নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, দেশের সবগুলো নদী নিয়ে নৌ মন্ত্রণালয় কাজ করছে। গুরুত্বপূর্ণ নদ-নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নদীর বুক থেকে দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবে।

নদী বাংলাদেশের নদী বুড়িগঙ্গা হাইকোর্ট

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর