পর্যটনে সংকট: ব্র্যান্ডিং-প্রচারণা-সরকারি উদ্যোগেই সমাধান
২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১০:০৫
ঢাকা: যথাযথ ব্র্যান্ডিংয়ের অভাবে বাংলাদেশের পর্যটন খাতকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরা যাচ্ছে না। ব্র্যান্ডিংয়ের নামে কিছু পর্যটন মেলার আয়োজন করা হলেও যথাযথ পরিকল্পনা না থাকায় সে মেলাও কাজে আসছে না। পাশাপাশি দেশের দর্শনীয় স্থানগুলো নিয়ে গণমাধ্যমে যেমন নেই পর্যাপ্ত প্রচারণা, তেমনি সরকারি উদ্যোগেও পর্যটন খাতকে তুলে ধরতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।
এদিকে, পর্যটকদের ভিসা বিষয়ক জটিলতা রয়েছে। পর্যটন নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। দর্শনীয় স্থানগুলোতে পর্যটকদের জন্য নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা। দেশের বাইরে দূতাবাসগুলো থেকেও পর্যটন বিষয়ক তথ্য পাওয়ার পর্যাপ্ত সুযোগ নেই, তথ্য নেই সরকারি ওয়েবসাইটগুলোতেও।
এসব সমস্যার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের পর্যটন খাত। ফলে প্রচুর সম্ভাবনা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণে বাংলাদেশ এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত হতে পারছে না। তবে এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারলে বাংলাদেশের জন্য পর্যটন খাত হয়ে উঠতে পারে অপার সম্ভাবনাময়।
‘বিশ্ব পর্যটন দিবস ২০১৯’ সামনে রেখে বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর) বিকেলে অনলাইন নিউজ পোর্টাল সারাবাংলা ডটনেট আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে পর্যটন খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এসব কথা বলেন। ‘টুরিজম অ্যান্ড জবস: এ বেটার ফিউচার ফর অল’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকটি সারাবাংলা ডটনেট কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের সার্বিক সহায়তায় ছিল ট্যুর অপারেটর ‘ট্রাবেলারকি’। অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়েছে ইউর ট্রাভেলসের সৌজন্যে। গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন সারাবাংলা ডটনেট ও জিটিভির এডিটর ইন চিফ সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা এবং সারাবাংলা ডটনেটের নির্বাহী সম্পাদক মাহমুদ মেনন খান।
গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকরা বলেন, পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনাকে বাস্তবে অনূদিত করতে বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের পর্যটন শিল্পের জন্য আইকন তৈরি করে তার ব্র্যান্ডিং করতে হবে। খাতটির সামগ্রিক উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন রয়েছে বলেও মত দেন সংশ্লিষ্টরা।
পর্যটন খাতকে এগিয়ে নিতে ২০১৬ সালকে পর্যটন বর্ষ ঘোষণা করে সরকার। এ উদ্যোগ আরও অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু কেন তা হলো না, আজকের আলোচনার মাধ্যমে তা উঠে আসবে।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কায় বোমা হামলার পর ওই দেশের ট্যুরিজম বোর্ড তিন দিন পর পর আমাকে মেইল দিয়ে আপডেট জানায়। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে কবে মেইল পাব, তা আমরা জানি না। আদৌ পাব কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
বাংলাদেশের চেয়ে মালয়েশিয়া বা নেপালের ব্যতিক্রম তেমন কোনো পণ্য নেই। কী আছে তাদের? আমরা যখন বান্দরবান বা রাঙ্গামাটি যাচ্ছি, তখন প্রকৃতি দেখছি, পাখি উড়ছে, বৃষ্টি পড়ছে। পর্যটকদের আকর্ষণের বিষয় কিন্তু এগুলোই। প্রকৃতির আকর্ষণই পর্যটকদের জন্য সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। আর তাতে বাংলাদেশ কোনোভাবেই পিছিয়ে নেই।
তবে আমাদের সমস্যা আছে। পর্যটন বোর্ড থেকে একটি মাস্টারপ্ল্যান হবে হবে বলেও হচ্ছে না। ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য আমাদের ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলো; কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশনের জন্য বছরে আমরা ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকার বেশি ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য খরচ করতে পারিনি। অথচ বিদেশে ব্র্যান্ডিংয়ের জন্যই সবচেয়ে বেশি খরচ হয়।
বাংলাদেশের মানুষ খুব হাশিখুশি। এখানকার খাবার খুব ভালো। পর্যটন খাতের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীকে আরও বেশি নজর দিতে হবে। আশা করি শিগগিরই তার হাত ধরে মাস্টারপ্ল্যান অনুমোদন পাবে।
হলি আর্টিজানে হামলার পর অনেক দেশ বাংলাদেশ ভ্রমণে রেড অ্যালার্ট জারি করেছে। কিন্তু আমাদের সরকার বা মন্ত্রণালয় এই ব্যাপারে কোনো ধরনের নির্দেশনা দেয়নি। হলি আর্টিজানের চেয়ে অনেক বড় বড় ঘটনা পৃথিবীর অনেক দেশে ঘটেছে। সেসব দেশের সরকার বা মন্ত্রণালয় কিন্তু কিছুদিন পরপর নিয়মিত আপডেট তথ্য দিচ্ছে। সরকার যদি এগিয়ে না আসে, তাহলে শুধু বেসরকারি উদ্যোগে পর্যটন খাত খুব একটা আলোর মুখ দেখবে না। আমরা মনে করি, প্রতিটি দেশের হাইকমিশনে একটি ট্যুরিজম ডেস্ক চালু করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের পক্ষ থেকে বিদেশে আন্তর্জাতিক মেলা করা হচ্ছে। কিন্তু কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই এসব মেলা হচ্ছে। আবার মেলায় ট্যুর অপারেটরদের চেয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের প্রাধান্য বেশি। তাহলে এসব মেলা আয়োজন করে লাভ হচ্ছে কী? এভাবে মেলা করায় কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং ভালোভাবে হচ্ছে না। আমাদের পরিকল্পনার অভাবে এত বড় সুযোগ আমরা নিতে পারছি না।
আবার আমরা এমন দেশে গিয়ে মেলা বা প্রচারণা করি যেখান থেকে কোনো ফল মেলে না। যেমন— কক্সবাজারের প্রচারণা যদি সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়াতে করা হয়, সেটা তো ভুল। তাদের দেশেই তো বড় বড় বিচ আছে। ফলে যে এলাকায় সমুদ্র নেই, যেমন— মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, সেখানে গিয়ে কক্সবাজারের ব্র্যান্ডিং করলে তা ফলপ্রসূ হবে।
একটি দেশের জন্য নদী যেমন একটি নেটওয়ার্ক, তেমনি টুরিজমও সমস্যা ও সম্ভাবনার একটি নেটওয়ার্ক। আমরা বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুইটি নদীর অধিকারী। আমাদের চা বাগান পৃথিবীর অন্যান্য দেশের চা বাগানের তুলনায় অনন্য। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের বড় অংশও বাংলাদেশেই। তারপরও বিদেশিরা সুন্দরবন বলতে ভারতীয় অংশের সুন্দরবনই ভ্রমণ করছেন। আমাদের পাহাড় আছে। কিন্তু শান্তি চুক্তির পর বিদেশিদের জন্য পাহাড়ে ভ্রমণ কঠিন হয়ে পড়েছে। তারা ভ্রমণে গেলে তাদের সঙ্গে একজন পুলিশ দেওয়া হয়। অথচ সরকার পাহাড়ে কোনো ট্রেইল বা এলাকা নির্দিষ্ট করে দিতে পারত, যেখানে পর্যটকরা নিরাপদে ভ্রমণ করতে পারে।
বিশ্বখ্যাত স্থপতি লুই আই কানের চমৎকার স্থাপত্যশৈলী রয়েছে বাংলাদেশে। তার নকশা করা আমাদের জাতীয় সংসদ ভবন একটি মাস্টারপিস। ফ্রান্সে যেমন আইফেল টাওয়ার, ইতালির যেমন পিসার হেলানো মন্দির এসব দেশের পর্যটন খাতের আইকন হয়ে উঠেছে, আমরাও তেমনি জাতীয় সংসদ ভবনকে আইকন করে তুলতে পারতাম। কিন্তু এই স্থাপনাকে আমরা দেশের ব্র্যান্ডিংয়ে কাজে লাগাতে পারিনি। এটা সর্বসাধারণসহ পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া যেতে পারত।
শুধু তাই নয়, আমাদের সড়ক নিরাপদ নয়। সড়কে নিরাপত্তাও নেই। পর্যটন স্থানগুলোতে নিরাপত্তার অভাব রয়েছে।
সিভিল এভিয়েশনে কাজ করার সূত্র ধরে ট্যুরিজম নিয়ে কিছু অভিজ্ঞতা ছিল। সেখান থেকে অবসর নেওয়ার পর ট্যুরিজম নিয়ে কিছু কাজ করেছি। আমি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করতে চাই। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের ভেতরে বিশ্বব্যাপী ৩০ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে ট্যুরিজম খাতে। এই বিশাল কর্মসংস্থানের কতটুকু চাপ আমরা নিতে পারব, সেটাই দেখার বিষয়।
আমাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আছে, একটি গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস আছে, আমাদের বিপুল জনবলও আছে। ট্যুরিজমের জন্য প্রয়োজনীয় এই তিনটি জিনিসই আমাদের আছে। জনবল তো ট্যুরিজমের প্রাণ। কিন্তু আমাদের যেটা নেই, সেটা হলো উদ্যোগ, সদিচ্ছা। পর্যটন খাতকে সমন্বিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে, তেমন নেতৃত্বও আমাদের নেই। নিরাপত্তাতেও ঘাটতি আছে। আমরা সড়কে পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে পারছি না, নিরাপত্তা দিতে পারছি না দর্শনীয় স্থানগুলোতেও। তারপর গত ১০ বছরে ব্যক্তি উদ্যোগে এই খাতটি যেভাবে এগিয়ে গিয়েছে, তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এবার এই খাতে সরকারেরও এগিয়ে আসা উচিত।
আটাবের জন্ম ৪৫ বছর ধরে আটাবের জন্ম। আমরা মূলত সরকারকে সহায়তা করি। এভিয়েশন ও ট্যুরিজম খাতে যেসব সমস্যা রয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করে সরকারকে জানাই, সরকার সেই অনুযায়ী কাজ করে। বর্তমানে এই খাতে আমরা সবচেয়ে বড় যে সমস্যা দেখছি, তা হলো— এই খাতকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো নেতৃত্বের শূন্যতা রয়েছে। এই শূন্যতা পূরণ না হলে ট্যুরিজমকে এগিয়ে নিতে যাওয়া সম্ভব নয়।
আমরা ট্যুরিজম নিয়ে মাস্টারপ্ল্যানের জন্য দীর্ঘদিন ধরে বলছি। কিন্তু এখনো সেই মাস্টারপ্ল্যান আসেনি। আসলে, একজন ব্যবসায়ী যখন বিনিয়োগ করতে আসবেন, তিনি দেখবেন তার রিটার্নটা কী, সেই রিটার্ন কত দিনে আসবে। অনেকেই এই খাতে বিনিয়োগ করতে আসেন, কিন্তু অগোছালো দেখে পিছিয়ে যান। তাই আমরা মন্ত্রণালয়কে বলেছি, দ্রুত মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হোক। সেই প্ল্যানের আঙ্গিকে দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ী কিংবা পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে যখন বড় বড় বিনিয়োগ হবে, তখন আমরাও থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ার মতো পর্যটন খাতে বড় বড় প্রকল্প দেখতে পাব।
আর আমরা এই মুহূর্তে পর্যটন খাত নিয়ে সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জ দেখতে পাচ্ছি, তা হলো— আমাদের দেশের মানুষদের মধ্যে ট্যুরিজম নলেজ বা ট্যুরিজম সেন্স খুব কম। একজন বিদেশি পর্যটক এলে তার সঙ্গে কোথায় কেমন আচরণ করতে হবে, এগুলো যদি প্রাথমিক পর্যায় থেকেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে বড় একটি পরিবর্তন আসবে। আমরা এগুলো প্রাইমারি থেকেই পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়ে আসছি দীর্ঘ দিন ধরে। কিন্তু এর কোনো ফল এখনো পাইনি।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ। এ দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও মানুষের আতিথেয়তা নিয়ে যদি আমরা প্রচারণা চালাতে পারি, তাহলেই মানুষ এখানে আসতে উদ্বুদ্ধ হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমুদ্র সৈকত, সুন্দরবনসহ নানা আশ্চর্য লুকিয়ে আছে এই দেশেই। সেগুলো নিয়ে ভালো পরিকল্পনা থাকলে এ দেশে পর্যটকের সংখ্যা আগামীতে অনেক বাড়বে। তবে এর জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিটি দেশে বাংলাদেশ হাইকমিশনের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের পর্যটন সম্পর্কে তথ্য থাকতে হবে।
পর্যটন একটি সেবা খাত— সেই মানসিকতার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলছি। পর্যটনে বিশ্বের শীর্ষে রয়েছে— এমন কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো করেই আমাদের পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে পর্যটকবান্ধব মানসিকতা তৈরি করছি। বাংলা, ইংরেজিসহ তাদের অন্য একটি ভাষাও শেখানো হচ্ছে।
বাংলাদেশ এক আজানা বিস্ময়। যারা বাইরে থেকে এ দেশে আসে, তারাই এ দেশ সম্পর্কে এমন ইতিবাচক অভিব্যক্তি প্রকাশ করে যায়। আমার অভিজ্ঞতা বলে, বাংলাদেশ সম্পর্কে ভালোলাগা জানতে চাইলে তারা বলেন এ দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা। মানুষ এ দেশে আসার জন্য কাঁদে, আবার আসার পর ফিরে যাওয়ার সময় থাকতে না পারার কষ্টেও কাঁদে।
প্রতিদিন সংবাদপত্র হাতে নিলে কত দুর্ঘটনা ও অনাচারের খবর পাওয়া যায়। অথচ প্রকৃতি নিয়ে একটি লাইনও চোখে পড়ে না। এ দেশের দর্শনীয় জায়গাগুলো সম্পর্কে তেমন প্রচারণা দেখা যায় না। সারাবিশ্বের মানুষ যেন এ দেশ সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পারে, এজন্য প্রচারণা খুব দরকার।
এয়ারপোর্টে এসে পর্যটকদের একঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, এটা খুবই বিড়ম্বনার বিষয়। আবার সাত দিনের বেশি পর্যটন ভিসা দেওয়া হয় না। এগুলো খুবই দুঃখজনক। পর্যটন শিল্পের প্রসারে এই বিষয়গুলো বড় ধরনের বাধা। আরেকটি বিষয় বলতে চাই, আজকের এই সেমিনারে পর্যটন খাত নিয়ে অনেক সম্ভাবনা, অনেক সমস্যা ও সেগুলো সমাধানের অনেক উপায় উঠে এসেছে। আমরা চাই না এই আলোচনা শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাক। যাদের উদ্দেশে সমস্যা ও সংকট উত্তরণের উপায় বলা হয়েছে, তারা যেন এগুলো বাস্তবায়ন করেন, সেটুকুই প্রত্যাশা করি।
বিশ্বব্যাপী পর্যটনের ধারা প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে। নতুন নতুন ট্রেন্ড তৈরি হচ্ছে। সেই ট্রেন্ডের সঙ্গে আমরা তাল মিলিয়ে উঠতে পারছি না। আমাদের অভ্যন্তরীণ পর্যটকও খুব একটা বাড়ছে না। আর অভ্যন্তরীণ পর্যটক যদি বাড়াতে না পারি, তাহলে বিদেশি পর্যটকও বাড়বে না। এ ক্ষেত্রে দর্শনীয় স্থানগুলোতে স্থানীয়দের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। তরুণদের মধ্যে পর্যটন নিয়ে ইতিবাচক ধারণা গড়ে তুলতে হবে।
দেশে পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো যে স্থানগুলো রয়েছে সেগুলো তুলে ধরতে সাংবাদিকদেরও দায়িত্ব রয়েছে। তবে ট্যুরিজম জার্নালিজম কেমন হবে সে ধারণা আমাদের কম। অনেক স্পট রয়েছে যেখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক। ফলে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা সেখানে যেতে চাইলেও পারেন না। যোগাযোগের উন্নয়নের মধ্যদিয়ে আমাদের পর্যটন ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব। সাংবাদিকতার মাধ্যমে পর্যটনখাতের উন্নয়নে সারাবাংলা তার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে।
আমাদের এখানে পর্যটনের ধারণাই ঠিকমতো গড়ে ওঠেনি। আমরা যখন ট্যুরিজম বিভাগ খুলেছি, এমন প্রশ্নও অভিভাবকদের কাছে শুনতে হয়েছে— এই সাবজেক্টে পড়বে কি বাবুর্চি হতে কিংবা হোটেলে ওয়েটার হতে? ধীরে ধীরে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে।
আমাদের পর্যটনের পাঠ্যক্রমেও সমস্যা রয়েছে। পর্যটনের একটি অংশ ট্রাভেল, আরেকটি অংশ হসপিটালিটি। এর মধ্যে ট্রাভেলে কর্মসংস্থানের পরিমাণ অনেক কম, হসপিটালিটিতে এর চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু আমাদের যে ৪৪টি বিষয় রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে দেখা যায় তিন থেকে চারটি বিষয় হসপিটালিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত। আবার আমাদের হাতে-কলমে শিক্ষার কোনো সুযোগ নেই। আমরা হসপিটালিটিতে কোনো ল্যাব ফ্যাসিলিটি তৈরি করতে পারিনি। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে বললেই তারা বলে, হোটেল আছে, সেখানে শিখবে।
আমাদের অভিজ্ঞতা যতটুকু, তাতে বলতে পারি, দেশে অ্যানালগ ট্যুরিজম হচ্ছে। অথচ পর্যটন খাতের প্রতিটি বিষয়কে ডিজিটালাইজড করা সম্ভব এবং পর্যটন খাতের এগিয়ে থাকা দেশগুলো সেটাই করছে। একজন পর্যটকের জন্য দর্শনীয় স্থান নির্ধারণ থেকে শুরু করে তার ভ্রমণ, থাকা-খাওয়া— সবকিছুর ব্যবস্থাপনাই ডিজিটাল উপায়ে করা সম্ভব। আমাদেরও সেদিকে যেতে হবে।
আমি অনেকদিন থেকেই বাংলাদেশে আছি। বাংলাদেশ সম্পর্কে আগে তেমন কিছু জানতাম না। তবে এখানে আসার পর বাংলাদেশের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছি। আমি সিলেট গিয়েছি, কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিনসহ বিভিন্ন স্থানে গিয়েছি। প্রতিটি জায়গা অসাধারণ। বাংলাদেশ ইজ বিউটিফুল। বাংলাদেশে চীনের অনেক মানুষই আছেন। আমার মনে হয়, তারাও আমার মতো বাংলাদেশে থাকাটা খুব উপভোগ করেন। আর আমার বাংলাদেশে সবচেয়ে যে বিষয়টি ভালো লাগে, তা হলো এখানকার মানুষ ও আতিথেয়তা।
দেশের পরিবেশ এখনও পর্যটকবান্ধব নয়। বিদেশিরা যা চায়, আমরা তা সরবরাহ করতে পারি না। অনেকেই হয়তো কেবল ব্যবসার জন্য ট্যুর অপারেটর কোম্পানি খুলে বসে। দেখা যাবে, হয়তো তার পর্যটন সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। ফলে একজন পর্যটকের জন্য যে সেবা প্রয়োজন, তা তিনি দিতে পারছেন না। এ ধরনের যারা আছেন, তাদের জন্যই কিন্তু অন্য অপারেটরদের সম্পর্কেও নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। অথচ সবচেয়ে জরুরি হলো সেবাটা দেওয়া। আমি ট্যুরিজম সেক্টরে ২০ বছর কাজ করছি। থাইল্যান্ড থেকেও আমি যেটা শিখে এসেছি, সেটা হলো এই সেবা। এটিই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ট্রাভেল কোম্পানি হিসেবে আমরা আমাদের জায়গা থেকে যথেষ্ট চেষ্টা করে যাচ্ছি। যেসব সীমাবদ্ধতা ছিল, সেগুলো আমরা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। এরই মধ্যে কিছু পরিবর্তন দৃশ্যমানও হয়ে উঠছে। ভ্রমণ কিন্তু মানুষকে সমৃদ্ধ করে। তাই আমি বলতে চাই, আরও বেশি করে ভ্রমণ করুন, আরও সমৃদ্ধ হোন।
ব্যক্তিগতভাবে পড়ালেখার জন্য ট্যুরিজমকে বিষয় হিসেবে বেছে নেওয়া আমার একান্তই নিজের পছন্দ। কারণ আমি মনে করি যে স্নাতক পর্যায়ে পড়ালেখার জন্য আমি এমন একটি বিষয়কেই বেছে নেব যেটা নিয়ে ভবিষ্যতে ভালো চাকরি করতে পারব। আমার কখনো মনে হয়নি যে পড়ালেখা শেষ করে আমি ভাববো যে আমি কী চাকরি করব। তাই এইচএসসি পাস করার পরই আমি ঠিক করি, আমি এয়ারলাইন্সে এক্সিকিউটিভ হিসেবে কাজ করব। পরে এই বিভাগে যখন ভর্তি হলাম তখন জানতে পারলাম, শুধু এয়ারলাইন্স নয়, হোটেলসহ পর্যটন খাতে বড় একটি চাকরির বাজার রয়েছে এই বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য। তাছাড়া এই খাতটি দিন দিন আরও আপডেটেড হচ্ছে। তাই আমার মনে হয়, এই বিভাগকে পছন্দ করে আমি ভালো একটি সিদ্ধান্তই নিয়েছি।
সবার আলোচনা শুনে এটা স্পষ্ট, পর্যটন নিয়ে আমাদের ব্র্যান্ডিংয়ের ঘাটতি রয়েছে। এটা নিয়ে কাজ করা দরকার। বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক যেসব খবর রয়েছে, সেগুলো নিয়েও কাজ করতে হবে। এটা আমাদের গণমাধ্যমের দায়িত্ব। কক্সবাজার, সুন্দরবনের মতো প্রোডাক্ট আমাদের আছে। আমাদের এগুলো নিয়ে কাজ করা উচিত। পর্যটন নিয়ে সারাবাংলা ডটনেটের এই আয়োজনে উপস্থিত হওয়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।
https://youtu.be/Bz-Zc4WYKEM
ট্যুরিজম পর্যটন পর্যটন খাতের সমস্যা পর্যটন খাতের সমস্যা উত্তরণের উপায় পর্যটন খাতের সম্ভাবনা পর্যটন শিল্প পর্যটনে সরকারি উদ্যোগ প্রচারণার অভাব বিশ্ব পর্যটন দিবস ২০১৯