৪৫ মিলিমিটারের ‘স্বাভাবিক’ বৃষ্টি, তাতেই নাকালের চূড়ান্ত
১ অক্টোবর ২০১৯ ২০:২৭
ঢাকা: মাঝ আশ্বিনে টানা দুই ঘণ্টা তুমুল বৃষ্টিপাত। আবহাওয়া অফিস বলছে, এই সময়ে এমন বৃষ্টি অস্বাভাবিক নয়। পরিমাপও বলছে সে কথা— বৃষ্টির পরিমাণ ৪৫ দশমিক ৩ মিলিমিটার। তবে তাতেই নাভিশ্বাস ছুটেছে রাজধানীবাসীর। দেখা দিয়েছে ‘বৃষ্টি এলেই বাড়তি যানজটে’র চিরচেনা রূপ। তাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়কে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রিকশা, সিএনজি, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেলসহ গণপরিবহন। পথ এগোনোর অপেক্ষা শেষ না হওয়ায় অনেকেই গণপরিবহন থেকে নেমে পড়েছেন পথে। কিন্তু পথ দিয়ে যে হেঁটে যাবেন, সে সুযোগটুকু নেই। তাদের সামনের রাজধানীর সড়কগুলো যে আর সড়ক নেই, একেকটি স্থান যেন একেকটি ‘মিনি সমুদ্রসৈকত’।
৪৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেও টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে ঢাকার প্রায় সব এলাকার রাজপথ। বিভিন্ন সড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশা আর রিকশায় উঠে পড়েছে পানি। সড়ক থেকে পানি নামতে না পারায় সন্ধ্যার পর পর্যন্তও জলজটে স্থবির হয়ে রয়েছে রাজপথ। গণপরিবহন থেকে নামতেই একেকজনকে হাতে নিতে হয়েছে জুতা-মোজা। আবহাওয়া অফিসের ‘স্বাভাবিক’ বৃষ্টিতে তাই চূড়ান্ত নাকাল হতে হয়েছে রাজধানীবাসীকে।
মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) দুপুরের পর থেকে পুরো রাজধানীর চিত্র এমনই। এদিন দুপুর সাড়ে ১২টার কিছু পর রাজধানীজুড়ে শুরু হয় বৃষ্টি। ২টা পর্যন্ত চলে সেই ঝুম বৃষ্টি চলে। থেমে থেমে চলে আরও প্রায় আধা ঘণ্টা। আর তাতেই প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালায় থেকে শুরু করে পল্টন, বিজয়নগর, কাকরাইল, রমনা, বাংলামোটর, ফার্মগেট, তেজগাঁও, ধানমন্ডি, আগারগাঁও, শ্যামলী, মিরপুর পর্যন্ত প্রায় সব এলাকাতেই জমে যায় হাঁটুজল।
আবহওয়া অধিদফতর বলছে, ঢাকায় দুপুর ১২টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে। এ সময়ে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৪৫ দশমিক ৩ মিলিমিটার। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বৃষ্টিপাতের এই পরিমাণ ‘স্বাভাবিক’।
আবহাওয়া অফিসের হিসাবে দেখা যায়, এ বছরের ১২ জুলাই রাজধানীতে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড করা হয়েছিল। সেদিন বৃষ্টি হয়েছিল ৮১ মিলিমিটার। এছাড়া ৮ আগস্ট ৭৩ মিলিমিটার, ১ সেপ্টেম্বর ৪০ মিলিমিটার, ১৩ জুলাই ৬৬ মিলিমিটার, ১ জুন ৪৬ মিলিমিটার, ৫ জুন ৫০ মিলিমিটার, ৩ মে ৬০ মিলিমিটার ও ৮ এপ্রিল ৫৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এ হিসাব অবশ্য পুরো ২৪ ঘণ্টার। তবে ভুক্তভোগীরা বলছেন, মাত্র এক বা দেড় ঘণ্টার এমন বৃষ্টি এর আগে খুব কমই দেখা গেছে।
আবহাওয়াবিদ বজলুর রহমান রশিদ সারাবাংলাকে বলেন, ঢাকায় মাত্র ৪৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এমন বৃষ্টিপাত মাঝেমধ্যেই হয়। আর মৌসুমের শেষ দিকে এমন বৃষ্টি হয়ে থাকে।
অন্যান্য এলাকার মতো কারওয়ান বাজারেও দুপুরে বৃষ্টির পর হাঁটুজল জমে যায়। পানি জমে থাকায় রাস্তার গতিপথ ভুল করে একটি বাস প্রায় উল্টে যাওয়ার উপক্রম হয়। একই অবস্থা দেখা গেছে মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায়। সিএনজিতে পানি ঢুকে বন্ধ হয়ে থাকতে দেখা গেছে। আর সব মিলিয়ে তীব্র যানজট তো ছিলই। স্থানে স্থানে জমে থাকা পানি পার হতে রিকশা ব্যবহার করতে হয়েছে নগরবাসীকে।
পল্টন মোড় থেকে পল্টন টাওয়ারে আসবেন ধ্রুব। তিনি বলেন, খামারবাড়ি থেকে বাসে করে পল্টন মোড়ে এসেছি। সেখান থেকে নেমে পল্টন টাওয়ারে আসব। কিন্তু অন্য দিনের চেয়ে দ্বিগুণ ভাড়া চেয়েছে রিকশাওয়ালা। হেঁটে যাব, তারও উপায় নেই। বাধ্য হয়ে দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়েছে।
শাহবাগ এলাকায় দেখা গেল অফিস ফেরত রুবিনা জাহানকে। তিনি বলেন, বর্ষার পুরোটা সময় বৃষ্টি-শূন্য ছিল, কিন্তু কিন্তু শরতে এসে বর্ষার মতো আচরণ করছে আকাশ। বাসা থেকে বের হয়েছিলাম ছাতা ছাড়া, অফিসে যাওয়ার সময় একদফা ভিজতে হয়েছে। এখন বাড়ি ফিরছি যানজট পেরিয়ে। ঢাকার বড় রাস্তাগুলো খুঁড়ে রাখায় যানজটের তীব্রতা অনেক বেড়েছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে জলাবদ্ধতা।
রুবিনা জানান, দুই ঘণ্টা ধরে যানজটের সঙ্গে লড়াই করে মতিঝিল থেকে শাহবাগ পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছেন তিনি। এখানে এসে শুনছেন, ফার্মগেট পর্যন্ত রয়েছে গাড়ির জট। একই অবস্থা সায়েন্স ল্যাব থেকে ধানমন্ডি ও মিরপুরের দিকের রাস্তাতেও।
মিরপুরের বাসিন্দা নাসিফ সারাবাংলাকে বলেন, বৃষ্টি মানেই আমাদের জন্য মহাদুর্ভোগ। অন্য দিনের মতো আজকের অবস্থাও প্রায় একই। বৃষ্টির কারণে দুপুরের পর বাসা থেকেই বের হতে পারিনি। একই এলাকার আরেক বাসিন্দা অন্তু বলেন, কাজে বের হয়েছিলাম। ভিজে একাকার হয়ে ময়লার পানিতে প্রায় গোসল করে বাসায় ঢুকতে হয়েছে।
নাখালপাড়ার দোকানি কাঞ্চন বলেন, বৃষ্টির কারণে প্রায় দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করে খাবার খেতে বাসায় গিয়েছি। পুরো রাস্তা পানিতে ডুবে ছিল। খাবার খেয়ে আবার দোকানে আসার সময়ও একই অবস্থা।
শাহবাগ সিগন্যালে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ আরিফ বলেন, আজ কিছুই করার নেই। গাড়ির ভিড় অনেক বেশি, কিন্তু রাস্তাগুলো জলাবদ্ধতার কারণে সরু হয়ে গেছে। এজন্য যানজট এত তীব্র হয়েছে। তিনি জানান, রাস্তা থেকে পানি নামার কোনো পথ নেই। নালাগুলো আবর্জনায় জমে আছে। এজন্য পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না।
বৃষ্টির পূর্বাভাস আরও ২ দিন
আবহাওয়া অফিস বলছে, মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় থাকায় আরও দুই দিন সারাদেশে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। সেইসঙ্গে বরিশাল, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে।
আবহওয়াবিদ আব্দুল মান্নান সারাবাংলাকে বলেন, সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে এমন বৃষ্টি হয়ে থাকে। আর সাগরে দুর্বল লঘু চাপ থাকায় আগামী দুই দিন এমন বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আরেক আবহাওয়াবিদ আফতাব উদ্দিন জানান, আগামী ৩ অক্টোবর থেকে সারাদেশে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমতে পারে। বর্তমানে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিপাত কমে আসছে। পরবর্তী ৭২ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাতের প্রবণতা আরও কমতে পারে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায়; খুলনা ও বরিশাল বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।
সেই সঙ্গে বরিশাল, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, বগুড়া, ময়মনসিংহ, পাবনা, ঢাকা, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, মাদারীপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং সিলেট অঞ্চলের ওপর দিয়ে দক্ষিণ অথবা দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে ঘণ্টায় ৪৫ থেকে ৬০ কিলোমিটার বেগে অস্থায়ীভাবে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। সেইসঙ্গে বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।
ছবি: হাবিবুর রহমান, সুমিত আহমেদ, ঝর্ণা রায়