দুর্গা পূজার মহাসপ্তমী, ভোরে কলা বৌ স্নান
৫ অক্টোবর ২০১৯ ০৬:৩৭
ঢাকা: বোধন শেষে ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গা পূজা। আনন্দময়ী, বিপদনাশিনী দেবী দুর্গার আগমনে মুখরিত পূজা মণ্ডপগুলো। ধূপ-আগরবাতির গন্ধে আর শঙ্খ, ঘণ্টা আর কাঁসরের সঙ্গে ঢাকের শব্দের সঙ্গে ভক্তদের আরাধনায় মহাষষ্ঠীতে ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ।
মহাষষ্ঠীর লগ্ন পেরিয়ে আজ শারদীয় দুর্গোৎসবের মহা সপ্তমী। পঞ্জিকার সূচি অনুযায়ী, শনিবার (৫ অক্টোবর) সকাল ৯টা ৫৮ মিনিটে শুরু হবে নবপত্রিকা প্রবেশ ও সপ্তমীর পূজা শুরু হবে।
প্রতিটি পূজামণ্ডপে ধূপধুনো, বেল-তুলসী, আসন, বস্ত্র, নৈবেদ্য, পুষ্পমাল্য, চন্দনসহ ১৬টি উপাচার দিয়ে দেবী দুর্গাকে আজ পূজা করা হবে। ত্রিনয়নী দেবী দুর্গার চক্ষুদান করা হবে।
মহাসপ্তমীর সকালে সর্বপ্রথম চক্ষুদানের মধ্যদিয়ে ত্রিনয়নী দেবী দুর্গার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। হিন্দু পুরাণ মতে, মহাসপ্তমীতে ভক্তদের কল্যাণ ও শান্তির আশীর্বাদ নিয়ে হিমালয় নন্দিনী দেবী দুর্গা পূজার পিঁড়িতে বসবেন।
দেবী দুর্গার নবপত্রিকা প্রবেশ ও স্থাপন করা হবে। এই নবপত্রিকা প্রবেশের আরেকটি নাম হলো কলা বৌ স্নান। এরপর সপ্তমাদি কল্পারম্ভ ও মহাসপ্তমীর পূজা অনুষ্ঠিত হবে। দেহ শুদ্ধি, অঙ্গ শুদ্ধি সেরে শুরু হয় পূজা-অর্চনা। ঢাকঢোল, শঙ্খ ধ্বনি-উলু ধ্বনি আর কাসরসহ বিভিন্ন ধরনের বাদ্যবাজনা বেজে উঠবে। এর পরে প্রতিমার সামনে পুজো শেষে দেওয়া হবে অঞ্জলি।
নবপত্রিকা কী?
দুর্গা পূজার সময় পূজামণ্ডপে যদি শ্রী গণেশের পাশে লাল পেড়ে শাড়িতে ঘোমটা তে ঢাকা একটি কলা গাছ দেখা যায়। অনেকে এটি কে কলা বৌ ও শ্রী গণেশের স্ত্রী হিসাবে মনে করে থাকেন। কিন্তু আসলে এটি শ্রী গণেশের বৌ নয়। এটিকেই বলা হয় ‘নবপত্রিকা’। এটি মা দুর্গা। অর্থাৎ গণেশের জননী।
শুদ্ধ ভাষায় নবপত্রিকা শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল নয়টি গাছের পাতা। যদিও বাস্তবে এই নবপত্রিকা নয়টি পাতা নয়, আসলে ৯টি গাছ। মূলত এটা কলাগাছ তার সঙ্গে থাকে কচু, বেল, হরিদ্রা (হলুদ), দাড়িম্ব (দাড়িম), অশোক, মান জয়ন্তী এবং ধান গাছ।
শাস্ত্রে কথিত আছে এই নবপত্রিকার ৯টি গাছ আসলে দেবী দুর্গার নয়টি বিশেষ রূপের প্রতীকস্বরূপ৷ কলা গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ব্রহ্মাণী, কচু গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কালিকা, হরিদ্রা গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী উমা, জয়ন্তী গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কার্ত্তিকী, বিল্ব গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শিবা, দাড়িম্ব গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী রক্তদন্তিকা, অশোক গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শোকরহিতা, মান গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী চামুন্ডা ও ধান গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষ্মী। আর উনারা সবাই নবদুর্গা রূপে পূজিত হয়৷
কলাগাছের সঙ্গে একেবারে মূল থেকে উৎপাটিত করে তা বেঁধে দেওয়া হয় এবং গণেশের ডান পাশেই বসানো হয় এই নবপত্রিকাকে। একেই লাল পাড় সাদা শাড়ি পড়িয়ে একবারে ঘোমটা পড়া কলা বৌয়ের রূপ দেওয়া হয়ে থাকে৷ দেবী দুর্গার ছেলে মেয়ে এবং মহিষাসুরের সঙ্গে পুজো পায় এই নবপত্রিকা৷
নবপত্রিকা কী ভাবে দুর্গা পূজার সঙ্গে মিশলো, তা নিয়ে আছে নানা মত। মার্কণ্ড পুরাণে নবপত্রিকা পূজার বিধান নেই। দেবী ভাগবতে নব দুর্গার উল্লেখ থাকলেও নবপত্রিকার উল্লেখ নেই। কালিকা পুরাণে এই নিয়ম না থাকলে সপ্তমী তে পত্রিকা পূজার কথা আছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণে এর উল্লেখ পাওয়া যায় — ‘বাঁধিলা পত্রিকা নব বৃক্ষের বিলাস।’
কলা বৌ স্নান কী?
কলা বৌয়ের স্নান দুর্গাপুজোর এক বিশেষ অঙ্গস্বরূপ রীতি৷ দেবীপক্ষের সপ্তমীর দিন সকালে কোনো নদী বা জলাশয়ে নিয়ে যাওয়া হয় নবপত্রিকাকে মহাস্নান করাতে৷ এ সময় বাজতে থাকে ঢাক৷ এখানেই শাস্ত্রবিধি মেনে স্নান করিয়ে নতুন শাড়ি পরানো হয় নবপত্রিকাকে। তারপর তাকে ফিরিয়ে আনা হয় পুজোমণ্ডপে৷ সেখানে নবপত্রিকা প্রবেশের পরই দুর্গা পূজার মূল অনুষ্ঠানটির প্রথাগত সূচনা হয়। এই নবপত্রিকা প্রবেশের পরই দেবীকে মহাস্নান করানো হয় দর্পণে বা আয়নায়। এরপর থেকে বাকি দিনগুলিতে নবপত্রিকা প্রতিমা দেবদেবীদের সঙ্গেই পূজিত হতে থাকে। এই নবপত্রিকা প্রবেশের পূর্বে দেবী চামুণ্ডার আবাহন ও পূজা করা হয়।
মহাস্নান কী?
শুধুমাত্র মহাসপ্তমীই নয়, মহাষ্টমী ও মহানবমীর দিনও পূজার মূল অনুষ্ঠান শুরুর আগে মহাস্নান অনুষ্ঠিত হয়। দেবী দুর্গার প্রতিমার সামনে একটি আয়না রেখে সেখানে প্রতিফলিত প্রতিমার প্রতিবিম্বে বিভিন্ন জিনিস দিয়ে মহাস্নান করানো হয়৷
এই মহাস্নানের সময় শুদ্ধজল, নদীর জল, শঙ্খজল, গঙ্গাজল, উষ্ণ জল, সুগন্ধি জল, পঞ্চগব্য, কুশ ঘাসের দ্বারা ছেটানো জল, ফুলে দ্বারা ছেটানো জল, ফলের জল, মধু, দুধ, নারকেলের জল, আখের রস, তিল তেল, বিষ্ণু তেল, শিশিরের জল, রাজদ্বারের মাটি, চৌমাথার মাটি, বৃষশৃঙ্গমৃত্তিকা, গজদন্তমৃত্তিকা, বেশ্যাদ্বারমৃত্তিকা, নদীর দুই তীরের মাটি, গঙ্গামাটি, সব তীর্থের মাটি, সাগরের জল, ঔষধি মেশানো জল, বৃষ্টিজল, সরস্বতী নদীর জল, পদ্মের রেণু মেশানো জল, ঝরনার জল ইত্যাদি দিয়ে দুর্গাকে স্নান করানোর রীতি আছে।
বলা হয়ে থাকে এই সব রীতি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজের কৃষিসম্পদ, খনিজসম্পদ, বনজসম্পদ, জলজসম্পদ, প্রাণীজসম্পদ, ভূমিসম্পদ ইত্যাদি রক্ষা করার জন্য সাধারণ মানসে বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়।
নৈতিকতা স্থাপনে সর্বভূতে দেবীরই অধিষ্ঠানস্বরূপ পতিতোধ্বারের ভাবটিও ফুটিয়ে তোলা এই মহাস্নানের উদ্দেশ্য। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ বিশ্ব সংহতি ও বিশ্বের কাছে এক অসাম্প্রদায়িক সম্প্রদায়ের সমন্বয়বার্তা প্রেরণ করা হয়। এককথায় সার্বিক ভাবে সমাজ কল্যাণের চিন্তা ফুটে ওঠে এই মহাস্নানে।
তবে চলিত ভাষায় কলা বৌ স্নান নামের রীতিই শুদ্ধ ভাষায় নবপত্রিকা স্থাপন বলেও বলা হয়ে থাকে।
মহাসপ্তমী পূজা উপলক্ষে প্রসাদ বিতরণ ছাড়াও সন্ধ্যায় বিভিন্ন পূজামণ্ডপে অনুষ্ঠিত হবে বিভিন্ন ভক্তিমূলক সংগীত, রামায়ণ পালা, আরতিসহ নানা রকমের অনুষ্ঠান।
রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির মেলাঙ্গনে আজ দুস্থদের মাঝে বস্ত্র বিতরণ করা হবে।