খাতায় অঙ্ক শেষ করতে পারেননি আবরার
৮ অক্টোবর ২০১৯ ০০:১৮
ঢাকা: হলে নিজের রুমে বসে খাতার শেষ পৃষ্ঠায় অঙ্ক করছিল আবরার ফাহাদ। এর মধ্যেই ডেকে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। এরপর আর আবরার রুমে ফিরতে পারেনি। টিউশনি থেকে ফিরে আবরারকে আর রুমে পাইনি। দেখলাম, খাতাটা পড়ে আছে বিছানায়। খাতায় অঙ্কটাও শেষ হয়নি। সেই অঙ্ক শেষ করার আগেই চলে গেল না ফেরার দেশে।
কথাগুলো বলছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেরে বাংলা হলের ১০১১ নম্বর রুমে থাকা আরেক শিক্ষার্থী। এই রুমেরই আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলেন আবরার ফাহাদ। বিশ্ববিদ্যালয়েরই কয়েকজন শিক্ষার্থী তাকে রোববার (৬ অক্টোবর) রাতে রুম থেকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার পর আর নিজের রুমে ফিরতে পারেননি তিনি। সোমবার (৭ অক্টোবর) হলের সিঁড়ির নিচে পাওয়া যায় তার নিথর দেহ। সহপাঠীদের অভিযোগ, তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আর আবরার হত্যায় জড়িত বুয়েট শাখা ছাত্রলীগেরই কয়েকজন নেতা।
আরও পড়ুন- ‘ছেলেকে তো ফিরে পাব না, হত্যার বিচার যেন পাই’
আবরারের সহপাঠীরা জানান, আবরার ফাহাদ অত্যন্ত মেধাবী একজন শিক্ষার্থী। কুষ্টিয়া সরকারি স্কুল থেকে এসএসসিতে পেয়েছিলেন জিপিএ ফাইভ। পরে ভর্তি হন ঢাকার নটরডেম কলেজে। সেখান থেকে এইচএসসি পরীক্ষাতেও পেয়েছেন জিপিএ ফাইভ।
সোমবার দুপুরে বুয়েটের শেরে বাংলা হলে কথা হয় আবরারের ফুপু শাম্মী আফরোজের সঙ্গে। সকাল ৬টার দিকে খবর পেয়ে মিরপুর থেকে ছুটে এসেছেন।
শাম্মী সারাবাংলাকে বলেন, মেডিকেল কলেজগুলোর ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে মেধা তালিকা থেকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয় আবরার, ক্লাসও শুরু করে। একই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিউক্লিয়ার সায়েন্স বিভাগে চান্স পেয়েও ভর্তি হয়নি। তবে তার পছন্দ ছিল তড়িৎকৌশল (ইইই)। বুয়েটে পছন্দের বিভাগে ভর্তির সুযোগ হওয়ায় আর পেছনে ফিরে তাকায়নি তিনি।
শাম্মী আফরোজ বলেন, কেউ গায়ে হাত দেবে— আবরার এমন ছেলে নয়। খেলাধুলা-রাজনীতি— কিছুই পছন্দ করত না। সারাক্ষণ পড়ালেখা আর নামাজ, এর বাইরে কিছুই বুঝত না। কেউ তার নাম জিজ্ঞাসা করলেও মাথা তুলে বলতে পারত না। মাথা নিচু করেই উত্তর দিতো।
আবরারের নিথর দেহ উদ্ধারের পর খবর পেয়ে শাম্মীর সঙ্গে বুয়েটে ছুটে এসেছিলেন আবরারের ফুপা, তিন চাচা, মামা, মামাতো ভাই-বোন, খালাতো ভাই-বোনসহ আরও বেশ কয়েকজন আত্মীয়-স্বজন।
আরও পড়ুন- আবরার হত্যা: বুয়েট ছাত্রলীগের ১১ নেতাকে স্থায়ী বহিষ্কার
মামা মোফাজ্জল হোসেন এসেছেন রামপুরা থেকে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, রাত ৩টার দিকে রোকেয়া (আবরারের মা) ফোন করে। আবরারের খবর নিতে বলে। জানায়, সে নাকি অসুস্থ, হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। একজনের মোবাইল নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বলে। ওই নম্বররে ফোন করলে হলে আসার জন্য অনুরোধ করে। এরপর তার রুমমেটের নম্বর নিয়ে জানতে পারি, আবরারকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে।
মামাতো ভাই আবু তালহা, আবরারের সঙ্গে খুব বেশি সময় কাটানোর সুযোগ হয়নি তার। তবে ছুটিতে কুষ্টিয়া গেলেই দেখা হতো আবরারের সঙ্গে, গল্প হতো, আড্ডা হতো। তালহা বলেন, ও বলত, বিজ্ঞানী হওয়াই ওর একমাত্র স্বপ্ন। ফুপা-ফুপু (আবরারের মা-বাবা) চাইতেন, আবরার চিকিৎসক হবে। কিন্তু ও বিজ্ঞানী হতে চেয়েছে।
আবরারের আরেক মামাতো ভাই রাজা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী। একইসঙ্গে ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ পেয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার। রাজা বলেন, আবরার ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য বিদেশে যেতে চেয়েছিল। বিজ্ঞানী হয়ে ফিরে সে দেশের উন্নয়নে কাজ করতে চেয়েছিল। বিদ্যুৎ খাতে বড় পরিবর্তন আনতে সে সবসময় স্বপ্ন দেখত।
চাচা আব্দুর রশিদ মালিবাগে থাকেন। আবরারের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে সব কাজ ফেলে ছুটে এসেছেন বুয়েটে। তিনি কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, ‘ও বড় হয়েছে, মা-বাবার কাছে কোনোদিন একটি থাপ্পড়ও খায়নি। আর পড়তে এসে এমনভাবে তাকে মেরেছে, পুরো শরীরে মারের দাগ স্পষ্ট। শরীরজুড়ে শুধুই আঘাতের চিহ্ন। কেউ কি এগিয়ে আসার মতো ছিল না? সবাই কি এতটা নির্মম?‘
চাচা বলেন, যারা আবরারকে শিবির বানিয়েছে, তারা অপপ্রচার চালাচ্ছে। ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য এমনটা করা হচ্ছে। সে কোনো রাজনীতি করত না। আমাদের দাবি একটাই— প্রকৃত ঘটনা সামনে আসুক। তদন্ত হোক, জড়িতরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাক।
শেরেবাংলা হলের নিচতলায় ১০১১ নম্বর রুমে থাকতেন আবরার। তার সঙ্গে ওই রুমে থাকেন আরও তিন জন। তাদেরই একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, আবরার অঙ্ক করছিল। এমন সময় ২০১১ নম্বর কক্ষের দু’জন এসে আবরার ডেকে নিয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পর আরেকজন এসে তার কাপড় নিয়ে যায়। এরপর রাত ২টা পর্যন্ত আর কোনো খবর নেই। পরে রাত ৩টার দিকে শুনতে পাই, আবরারের মরদেহ সিঁড়িতে পড়ে আছে।
আরও পড়ুন- থানায় জিডি, ক্যাম্পাসে তদন্ত কমিটি বুয়েট প্রশাসনের
আবরারকে মারধরের সময় ২০১১ নম্বর রুমে উপস্থিত ছিলেন বুয়েট ছাত্রলীগের সহসম্পাদক আশিকুল ইসলাম বিটু। তিনি বলেন, আবরারকে শিবির সন্দেহে রাত ৮টার দিকে হলের ২০১১ নম্বর রুমে ডেকে আনা হয়। সেখানে আমরা তার মোবাইলে ফেসবুক ও মেসেঞ্জার চেক করি। ফেসবুকে বিতর্কিত কিছু পেজে তার লাইক দেওয়ার প্রমাণ পাই। সে কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগও করেছে। তার শিবির সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাই।
বিটু আরও বলেন, আবরারকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বুয়েট ছাত্রলীগের উপদফতর সম্পাদক ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মুজতবা রাফিদ, উপসমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল, উপআইন সম্পাদক অমিত সাহা। তারা তিন জনই ২০১১ নম্বর রুমের আবাসিক শিক্ষার্থী। প্রত্যয় মুবিন নামে আরেক শিক্ষার্থী ওই রুমে থাকলেও ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন না।
আরও পড়ুন- শরীরে বাঁশ-স্টাম্পের আঘাত, অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে মৃত্যু
বিটু বলেন, ‘আবরারের শিবির সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়ার পর চতুর্থ বর্ষের ভাইদের খবর দেওয়া হয়। খবর পেয়ে বুয়েট ছাত্রলীগের ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার সেখানে আসেন। একপর্যায়ে আমি রুম থেকে বের হয়ে আসি। এরপর হয়তো ওরা মারধর করতে পারে। পরে রাত ৩টার দিকে শুনি আবরার মারা গেছে।’
আবরার হত্যার ঘটনায় এরই মধ্যে সোমবার রাতে রাজধানীর চকবাজার থানায় মামলা দায়ের করেছেন তার বাবা বরকত উল্লাহ। মামলায় বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল ও সহসভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদসহ ১৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। পুলিশও এরই মধ্যে বুয়েট ছাত্রলীগের ৯ নেতাকে আটক করেছে।
আবরার হত্যার ঘটনা একযোগে তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের চকবাজার থানা ইউনিট।
আরও পড়ুন- হত্যার ফুটেজ চান শিক্ষার্থীরা, বুয়েটে ২ পুলিশ কর্মকর্তা অবরুদ্ধ
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সিটিটিভি ফুটেজে স্পষ্ট দেখা গেছে কারা আবরারকে বের করে সিঁড়িতে রাখছে। বাইরে থেকে কারা এসেছে ওই কক্ষে, কারা কখন বের হয়ে যাচ্ছে— সবকিছুই তদন্ত করা হচ্ছে। পিটিয়েই হত্যা করা হয়েছে আবরারকে।
পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মুনতাসির রহমান বলেন, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। এ ঘটনায় যারাই জড়িত থাকুক না কেন, সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আরও পড়ুন- ফুটেজ হস্তান্তর করে তবেই ‘ছাড়া পেলেন’ পুলিশ কর্মকর্তারা
আবরারের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার রায়ডাঙ্গা গ্রামে। তার বাবা বরকত উল্লাহ ব্র্যাকের উচ্চ পদে চাকরি করতেন। অবসর নেওয়ার পর এখন তিনি কুষ্টিয়া শহরের পিটিআই রোডে থাকেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে আবরার বড়। ছোট ভাই আবরার ফায়াজ ঢাকা কলেজে প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত। আবরারের স্বজনরা জানিয়েছেন, ময়নাতদন্ত শেষে তার মরদেহ গ্রামে নিয়ে যাওয়া হবে।
আরও পড়ুন-
বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যায় ছাত্রলীগের ৯ নেতা আটক
বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যার প্রতিবাদে ঢাবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
বুয়েটের আবাসিক হলে শিক্ষার্থীর মৃতদেহ, শরীরে আঘাতের চিহ্ন
আবরার হত্যায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা জড়িত, স্বীকার বুয়েট সভাপতির
আবরারের জন্য সহপাঠীদের কান্না, দুপুর অবদি বুয়েটে আসেননি উপাচার্য