প্রথমবারের মতো স্বামী-স্ত্রীর একসঙ্গে অর্থনীতিতে নোবেল জয়
১৪ অক্টোবর ২০১৯ ১৯:১৮
অমর্ত্য সেনের পরে দ্বিতীয় বাঙালি হিসেবে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক। সঙ্গে আরও একটি রেকর্ড গড়েছেন অভিজিৎ— নোবেলের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একই বছরে অর্থনীতিতে স্ত্রী এস্থার দুফলোর সঙ্গে নোবেল সম্মান অর্জন করেন।
সোমবার (১৪ অক্টোবর) রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি এবছর তিনজন অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তাদের মধ্যে আছেন এই দম্পতি।
এর আগে ১৯০৩ সালে বিজ্ঞানী দম্পতি মেরি কুরি ও পিয়েরি কুরি পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল সম্মান অর্জন করেন। সে বছর তিন জনকে নোবেল দেওয়া হয়, যেখানে হেনরি বেকেরেলকে পুরস্কারের অর্ধেকটা এবং মেরি ও পিয়েরে কুরিকে বাকি অর্ধেকটা ভাগ করে দেওয়া হয়। তবে এবছর অভিজিৎ বিনায়ক, এস্থার দুফলো ও মাইকেল ক্রেমারের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।
নোবেল কমিটির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘তাদের গবেষণা গোটা বিশ্বকে দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়ার নতুন হাতিয়ারের সন্ধান দিয়েছে। মাত্র দুই দশকে ওদের গবেষণা পদ্ধতি উন্নয়ন অর্থনীতির রূপরেখা বদলে দিয়েছে। এখন অর্থনীতির গবেষণায় এটি অন্যতম পাথেয় মডেল।’
অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন বাঙালি অভিজিৎসহ ৩ জন
১৯৬১ সালে ভারতের মুম্বাইয়ে জন্ম অভিজিৎ বিনায়কের। সাউথ পয়েন্ট স্কুলে তিনি প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করেন। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক হন। সেখানে নোবেলজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের ছাত্র ছিলেন তিনি। এরপর ১৯৮১ সালে স্নাতকোত্তর পড়তে চলে যান জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে। হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘ইনফরমেশন ইকোনোমিক্স।’
অভিজিৎ বিনায়ক
অভিজিৎ বিনায়ক জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলেছেন। ২০১৫ পরবর্তী ডেভলপমেন্ট এজেন্ডা কর্মসূচিতে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশিষ্ট প্রতিনিধি প্যনেলে ছিলেন তিনি। অর্থনীতি বিষয়ে বিনায়কের লেখা চারটি বই বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। তার মধ্যে ‘পুওর ইকোনোমি’ বইটি গোল্ডম্যান স্যাকস বিজনেস বুক সম্মানে ভূষিত হয়।
ইতিহাসবিদ হতে চেয়েছিলেন এস্থার। কিন্তু পথ তৈরি হয় অর্থনীতিতেই। বিশ্বজুড়ে দারিদ্র্য, শিশুমৃত্যু, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের অবনতি তাকে মুচড়ে দিত, টানতও একই সঙ্গে। ইতিহাস ও অর্থনীতি, দুই নিয়েই শুরু হয় এস্থার দুফলোর জার্নি। হাত ধরেন অধ্যাপক-গবেষক, সহকর্মী অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। বিশ্ব অর্থনীতিতে দারিদ্র্য দূরীকরণ নিয়ে স্বামী অভিজিতের সঙ্গে নোবেল পেয়েছেন তিনিও। একই সঙ্গে একই বছর স্বামী-স্ত্রীর যুগ্মভাবে নোবেল প্রাপ্তি এই প্রথম।
এস্থার দুফলো
মাইক্রো-ইকনমিক্স নিয়েই মূলত গবেষণা এস্থারের। উন্নয়নশীল দেশগুলির আর্থ-সামাজিক অবস্থাও তার গবেষণাপত্রের অন্যতম বিষয়। যার মধ্যে রয়েছে গার্হস্থ্য সমস্যা, শিক্ষা, অর্থনৈতিক অবস্থা, স্বাস্থ্য-সহ অনেক কিছু। ‘Global Poverty’ নিয়ে যখন গবেষণা শুরু করেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, ডিন কারলান, মাইকেল ক্রিমার, জন এ লিস্ট এবং সেনধিল মুল্লাইনাথান, অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন এস্থার। সেই সময় তিনি সেন্টার ফর ইকনমিক অ্যান্ড পলিসি রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের ডিরেক্টর এবং ব্যুরো অব রিসার্চ অ্যান্ড ইকনমিক অ্যানালিসিস অব ডেভেলপমেন্ট (BREAD)-এর বোর্ড অব ডিরেক্টরের সদস্য।
১৯৭২ সালে প্যারিসে জন্ম এস্থারের। বাবা মাইকেল দুলফো অঙ্কের অধ্যাপক। মা ডাক্তার। ছোট থেকেই ইতিহাসের নানা বিষয় টানত এস্থারকে। জানিয়েছেন, যখন বয়স আট বছর, চেয়েছিলেন ইতিহাসবিদ হবেন। ইউনিভার্সিটিতে তার বিষয়ও ছিল ইতিহাস। ১৯৯৩ সালে মস্কোতে ১০ মাস থেকে তিনি অধ্যাপনা করেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাস, রাজনীতি নিয়ে চর্চা শুরু হয়। একই সঙ্গে তার আকর্ষণের বিষয় হয়ে ওঠে অর্থনীতি। ইউনিভার্সিটি থেকে একই সঙ্গে ইতিহাস ও অর্থনীতি নিয়ে ডিগ্রি লাভ করেন এস্থার।
স্বামী অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে এস্থার
১৯৯৯ সালে ম্যাসাচুসেটস ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (এমআইটি) থেকে অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা শেষ করেন। রিসার্চ স্কলার থাকার সময়েই তাঁর পছন্দের অধ্যাপক ছিলেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং জোসুয়া অ্যাঙ্গরিস্ট। অভিজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানেই বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন এস্থার। এমআইটিতেই অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। শিক্ষকতা ও গবেষণা পাশাপাশি, সমান্তরালভাবে চলতে থাকে।
২০০৩ সালে এমআইটিতেই ‘পোভার্টি অ্যাকশন ল্যাব’ তৈরি করেন। স্যর, বন্ধু, সহকর্মী অভিজিতের সঙ্গে এই ল্যাবেই অর্থনীতির নানা বিষয় নিয়ে অন্তত ২০০টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন এস্থার। পেশা এবং গবেষণা ছাপিয়ে সম্পর্কের গভীরতা আরও গাঢ় হয়। একসঙ্গে জীবনের পথে চলার সিদ্ধান্ত নেন এস্থার-অভিজিৎ। ২০১০ সালে কম বয়সে অর্থনীতিতে অন্যরকম ভাবনা ও পথপ্রদর্শনের জন্য ‘জন বেটস ক্লার্ক মেডেল’ পান এস্থার। ওই বছরেই ইউনিভার্সিটি অব ক্যাথলিক দে লাওভেন থেকে সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়ে যান এস্থার। সমাজ বিজ্ঞান এবং অর্থনীতিতে ইনফোসিস পুরস্কার (Infosys Prize) তার ঝুলিতে ওঠে ২০১৪ সালে।
জীবনের যেকোনো পর্যায়েই শক্ত খুঁটির মতো পাশে ছিলেন স্বামী অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০০৮ সালে বিশ্বের ১০০ জন মেধাবী মানুষের মধ্যে সামনের সারিতেই এস্থারের নাম লেখে আমেরিকার ম্যাগাজিন ‘ফরেন পলিসি’। ‘দ্য ইকোনমিস্ট’-এর তালিকায় বিশ্বের সেরা আট অর্থনীতিবিদের মধ্যে নাম ওঠে এস্থারের। ২০১১ সালে ‘টাইম ম্যাগাজিন’-এর প্রকাশিত বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ জন ব্যক্তির তালিকাতেও প্রথম সারিতেই দেখা যায় এস্থারের নাম। তার লেখা প্রথম বইও স্বামী অভিজিতের সঙ্গেই। ‘Poor Economics’ গোটা বিশ্বে সাড়া ফেলে দেয়। এই বইয়ের জন্য স্বামী-স্ত্রী দু’জনকেই ‘জেরাল্ড লোয়েব অ্যাওয়ার্ড’ পান ২০১২ সালে।
আবদুল লতিফ-জামিল পোভার্টি অ্যাকশন ল্যাব (J-PAL)-এর সহ-কর্ণধার এবং ডিরেক্টর এস্থার সমাজ বিজ্ঞানে তার দূরদর্শী ভাবনার জন্য ২০১৫ সালে স্পেনে পুরস্কার পান। বিশ্ব অর্থনীতিতে দারিদ্র্য দূরীকরণের নানা পর্যায়ে গবেষণার জন্য যে জার্নি শুরু করেছিলেন এস্থার-অভিজিৎ, সেটাই পূর্ণতা পায় চলতি বছরে। সর্বোচ্চ সম্মান পেয়ে ইতিহাস তৈরি করেন দুজনেই।
নোবেল লরিয়েট অর্থনীতিবিদের স্ত্রী-ও নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, ইতিহাসে এমন ঘটনাও আছে। সুইডিশ অর্থনীতিবিদ গুনার মিরদাল ১৯৭৪ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পান। ‘অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ঘটনার পারস্পরিক নির্ভরতার তাৎপর্যপূর্ণ বিশ্লেষণ এবং অর্থ ও অর্থনৈতিক বৈষম্যে তত্ত্বের তাৎপর্যপূর্ণ বিশ্লেষণের জন্য’ অস্ট্রিয়ার অর্থনীতিবিদ ফ্রেডরিক হায়েকের সঙ্গে যৌথভাবে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান মিরদাল। পরে ১৯৮২ সালে তার স্ত্রী আলভা মিরদাল শান্তিতে নোবেল পান। তিনিই প্রথম নারী, যিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান।