হ্যানয়ের ঢাকা মিশনে দাঁত সারাতেই বছরে খরচ অর্ধকোটি টাকা
২৮ অক্টোবর ২০১৯ ১৭:০০
ঢাকা: দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদার বিষয়টি বুঝি বাংলাদেশের হ্যানয় মিশনের কূটনীতিকদের চেয়ে ভালো কেউ বুঝতে পারেন না। এই মিশনের রাষ্ট্রদূতসহ চারজনের ছয়মাসে দাঁত সারানোর বিল প্রায় অর্ধকোটি টাকা। এর কোনোটিই খুব বড় কোনো দাঁতের সমস্যা নয়। রুট ক্যানেল, স্কেলিংসহ সাধারণ কিছু চিকিৎসা। মিশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছয়মাসে দাঁতসহ আরও কিছু চিকিৎসায় খরচ করেছেন ১৫ লাখ টাকা। চিকিৎসা নেওয়ার তালিকায় মিশন কর্মচারীদের স্ত্রী কিংবা স্বামীরাও রয়েছেন।
ভিয়েতনামের হ্যানয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে রাষ্ট্রদূতসহ স্থায়ী (হোমবেইসড) জনবলের সংখ্যা মোট ৪ জন। রাষ্ট্রদূতসহ মিশনের স্থায়ী জনবল এবং তাদের স্ত্রী বা স্বামীদের দাঁত স্কেলিং চিকিৎসাখাতে এক বছরে খরচ হয়েছে অর্ধ কোটি টাকারও বেশি। এই খরচের আবার নিয়মিত কোনো রেজিস্টার সংরক্ষণ করা হয় না। রাষ্ট্রদূতসহ মিশনের স্টাফদের দাঁতসহ চিকিৎসা খাতের এ খরচকে সরকারি কোষাগারের আর্থিক ক্ষতি এবং বিধিবহির্ভূত খরচ বলে বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) কার্যালয়ের করা নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ভিয়েতনামের হ্যানয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত সময়ের আর্থিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। সিএজি কার্যালয়ের করা নিরীক্ষা প্রতিবেদনসহ সংশ্লিষ্ট সকল তথ্য-প্রমাণ সারাবাংলা’র হাতে রয়েছে।
সারাবাংলা’র অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী দূরারোগ্য ব্যাধি বা দীর্ঘদিন অসুস্থ এমন কাউকে বিদেশে নিয়োগ না দিয়ে দেশে পদায়ন করতে হবে। শুধু তাই নয়, কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী যদি ৩ মাসের বেশি অসুস্থ থাকে কবে তার পদায়ন বিদেশে থাকলে তাকে দেশে বদলি করতে হবে অথবা এমন ব্যক্তিকে বিদেশে পদায়ন করা যাবে না। অথচ হ্যানয়ের ঢাকা মিশনে সরকারের এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দূতাবাসের কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের দাঁতের চিকিৎসায় খরচ করা অনেক ভাউচারের সত্যতা পাওয়া যায়নি। গত ২০ মে একটি ভাউচারের মাধ্যমে দাঁতের চিকিৎসার জন্য ৭ হাজার ২৫৪ টাকা (ভিয়েতনাম মুদ্রা ২০ লাখ ডং) নেওয়া হয়। সিএজি’র নিরীক্ষা দল এ বিষয়ে মন্তব্য করে বলেছে, বিলটি অবিশ্বাস্য, নির্ধারিত হাসপাতালে চিকিৎসা করেননি। গত ৩১ জানুয়ারির একটি ভাউচার নিয়েও সিএজি কার্যালয় একই মন্তব্য করেছে। গত ২১ জানুয়ারির একটি ভাউচার সম্পর্কে নীরিক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ওষুধের কোনো ক্রয় রশিদ নেই।
২০১৮-১৯ অর্থ বছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দূতাবাসের পিও আব্দুস সালাম মোড়ল নিয়ম না মেনে তার স্ত্রীর দাঁতের রুট ক্যানেলের জন্য একবার ৬৯ হাজার ২৩০ টাকা, আরেকবার ভিয়েতনাম মুদ্রা ২০ লাখ ডং সরকারি অর্থ থেকে খরচ করেন। এ ছাড়া প্রায় প্রতিমাসেই তিনি ভাউচার দিয়ে নিয়মিতভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ মেডিকেলখাত থেকে নেন। যার প্রতিটিতে মিশন প্রধান রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজের অনুমোদন রয়েছে।
দূতাবাসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আকমল উদ্দিনের বিষয়ে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনি রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজের অনুমোদন নিয়ে মেডিকেল অ্যালাউন্স বাবদ মাত্র ৬ মাসেই ১৫ লাখ ৩ হাজার ৭৮৮ টাকা নিয়েছেন। এ ছাড়া প্রতিমাসেই তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ মেডিকেল অ্যালাউন্স বাবদ নিয়ে থাকেন। তিনি ২০০১ সাল থেকেই হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসে ভুগছেন। তার স্ত্রীও ডায়াবেটিস, অ্যাজমাসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত। অথচ রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজ বলছেন যে প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আকমল উদ্দিন এবং তার স্ত্রীর মেডিকেল অ্যালাউন্স স্বাভাবিক।
হ্যানয় মিশনের গত জানুয়ারির মাসের একটি ভাউচার থেকে জানা গেছে, রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজ তার নিজের চিকিৎসার জন্য ৩৮ হাজার ৪৪ টাকা, পিও আব্দুস সালাম মোড়ল চিকিৎসার জন্য ৩ হাজার ৮৮৯ টাকা এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আকমল উদ্দিন চিকিৎসার জন্য ৯ হাজার ৩৬৩ টাকা নেন।
হ্যানয় মিশনের গত মে মাসের একটি ভাউচার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ওই মাসে রাষ্ট্রদূত এবং মিশনে স্টাফ ও তাদের স্ত্রীদের জন্য মেডিকেল খাতে সরকারের ১ লাখ ৫ হাজার ৫৪৭ টাকা খরচ করা হয়।
এ বিষয়ে মন্তব্য জানার জন্য পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক এবং ভিয়েতনামে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজ এর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
সিএজি কার্যালয়ের করা নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ভিয়েতনামে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস সম্পর্কে আরও বলা হয়েছে— ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত সময়ের আর্থিক নিরীক্ষায় কোটি টাকারও বেশি আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। রাষ্ট্রদূতের বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ব্যয়, ভ্রমণ খরচসহ মোট ৩১টি খাতে এই অনিয়ম পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন
হ্যানয়ের ঢাকা মিশনের বাড়িভাড়ায় অনিয়ম, অর্ধকোটি টাকার ক্ষতি
অনিয়মের বাসা হ্যানয়ের ঢাকা মিশন
হ্যানয়ে কোটার গাড়ি বিক্রয় ৪ সাবেক রাষ্ট্রদূতের, সংকটে দূতাবাস