গ্রেনেড হামলায় আহত মোস্তফা আজও পাননি প্রধানমন্ত্রীর দেখা!
৩১ অক্টোবর ২০১৯ ০১:০৫
ঢাকা: একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় ক্ষত-বিক্ষত গোলাম মোস্তফা আজও কাঁতরান গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের যন্ত্রণায়। ওই হামলার দেড় দশক পেরিয়ে গেলেও এখনো তিনি পাননি প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার দেখা। তা সত্ত্বেও শেখ হাসিনার প্রতি ভালোবাসা কমেনি তার। তবে একনজর শেখ হাসিনাকে কাছ থেকে দেখবেন এবং পায়ে হাত দিয়ে দোয়া নেবেন— এটুকু চাওয়া এখনো বুকে লালন করে বেড়ান গোলাম মোস্তফা।
সারাবাংলার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন মোস্তফা। আর বলছিলেন, এ জনমে কি আর পাব না প্রাণপ্রিয় আপার দেখা!
একুশে আগস্টের সেই ভয়াল স্মৃতি মনে করে মোস্তফা বলেন, ২০০৪ সালের একুশে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি সমাবেশ চলছিল। সমাবেশে দলের টানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একনজর দেখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওই সমাবেশে গিয়েই যে সারাজীবন এক যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হবে, সেটা কল্পনাতেও ছিল না।
https://youtu.be/wfwfG9PYxSY
ঘটনার বিবরণ টেনে গোলাম মোস্তফা বলেন, সেদিন অনুষ্ঠানের জন্য মঞ্চের অনুমতি চাওয়া হলেও সরকার মঞ্চ করতে দেয়নি। তারপর ট্রাক এনে ট্রাকের ওপর মঞ্চ বানিয়ে মেয়র হানিফ ভাই, মায়া ভাই, মতিয়া আপা, আইভি আপাসহ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বর্তমান নীতি নির্ধারকরা সবাই সেই ট্রাকে উপস্থিত ছিলেন। তখন বক্তব্য রাখছেন প্রয়াত মেয়র হানিফ। জাতীয় নেতাদের বক্তব্য যখন চলছিল, আপা (শেখ হাসিনা) সভাস্থলে পৌঁছান। এরপর মাইকে ঘোষণা দেওয়া হলো, সবাই আপার কাছে যেতে চান। একনজর আপাকে দেখতে চান। তখন আইভি আপা ট্রাকের সামনে মহিলা আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ে বসে। আমরা ট্রাকের একটু পেছনে দাঁড়ানো ছিলাম। নেত্রী ট্রাকে উঠলেন এবং কিছুক্ষণ পর বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন।
সেই ভয়াল স্মৃতি মনে করে যেন এখনো শিউরে ওঠেন গোলাম মোস্তফা। বলেন, আপা কথা বলতে বলতেই হঠাৎ এক বিকট শব্দে আমার দুই কান স্তব্ধ হয়ে যায়। আর কিছুই শুনতে পাই না। আশপাশে তাকিয়ে দেখি মানুষ রাস্তার ওপরে লুটিয়ে পড়ে আছে। মঞ্চে তাকিয়ে দেখি, জাতীয় নেতারা আপাকে বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে রেখেছে। চারদিকে শুধু মানুষের চিৎকার আর বাঁচার আকুতি। কারও হাত নেই, পা নেই, কারও দিকে তাকানো যাচ্ছে না। এদিকে, আমার শরীর দিয়ে অঝোরে রক্ত ঝরছে। আমার কোনো জ্ঞান ছিল কি না, জানি না। আমি মানুষের দিকে তাকাচ্ছি আর চিৎকার করছি। সামনে তাকিয়ে দেখি, আইভি আপাকে কোলে করে আমার বন্ধু কাশেম বাঁচাও বাঁচাও, কে আছে বলে চিৎকার করছে। এর মধ্যে দুই পাশ থেকে পুলিশ এসে আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালাতে থাকে।
মোস্তফা আরও বলেন, আপাকে যখন তার গানম্যান গাড়িতে ওঠানোর জন্য গাড়ির দরজা খুলবেন, এর মধ্যে দেখলাম তিনি দাঁড়ানো থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গেলেন। আমার একটি কথা তখন মনে আছে, তখন আপার ড্রাইভার যিনি ছিলেন, তিনি মুহূর্তেই গাড়িটাকে ঘুরিয়ে ফেলেন। এরপর শুধু গুলির আওয়াজ। নিজে বেঁচে আছি কি না, সেটাও তখন খেয়ালই করিনি। মনে আছে, আদা চাচা নামে এক মুরব্বি ছিলেন। তিনি পার্টি অফিসের সামনে চা বিক্রি করতেন। ওনার হাত-পা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে চারদিকে পড়ে আছে। রাস্তায় দেখি শুধু মানুষের পা আর জুতা চারদিকে পড়ে আছে। আমি শুধু দেখছি আর চিৎকার করছি। কিন্তু কেউ কারও কথা শুনছে না। কেয়ামত কী জিনিস, সেটা ওদিন যারা ওখানে ছিলেন, তারা হয়তো সেটা আঁচ করতে পেরেছেন।
যতক্ষণ জ্ঞান ছিল, সৃষ্টিকর্তার কাছে গোলাম মোস্তফা প্রার্থনা করেছেন, শেখ হাসিনা যেন বেঁচে থাকেন, অক্ষত থাকেন। পরে তাকে সহকর্মীরা উদ্ধার করে নিয়ে যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। মোস্তফা নিচে তাকিয়ে দেখেন, ডান পা রক্তে ভেজা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তখন নার্স নেই, ডাক্তার নেই। এদিকে-সেদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে শত শত মানুষ, কারও হাত নেই, কারও পা নেই। এসব দেখতে দেখতেই সংজ্ঞা হারান তিনি।
মোস্তফা বলেন, জ্ঞান ফেরার পর দেখি, আমি বাড্ডার একটি হাসপাতালে। এরপর আমার পরিবার হাসপাতালে এসে দেখে আতঙ্কিত হয়ে আমাকে কুমিল্লা নিয়ে চলে যায়। এরপর আমি চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে টানা চার মাস চিকিৎসাধীন ছিলাম। এরপর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে থাকি। তবে পুরোপুরি সুস্থ তো আর কখনো হতে পারব না।
এর কারণ কী— জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার ডান পা স্প্লিন্টারে ভরা। ডাক্তাররা ২০টির মতো বের করেছেন। কিন্তু এখনো অনেক স্প্লিন্টার রয়ে গেছে। সেদিনের সেই ক্ষত আজও আমাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। রাতে পা বাঁকা করে ঘুমালে সকালে পা সোজা করতে পারি না। কানের পর্দা এখনো ফাঁটা, মাঝে মাঝে কান দিয়ে আওয়াজ বের হয়। অনেক সময় কানে শুনতেও পাই না। স্তব্ধ হয়ে থাকে সবকিছু। আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব, চিকিৎসা করিয়েছি।
দল থেকে কোনো সহায়তা পাননি বলে অনুযোগ মোস্তফার। বলেন, দল থেকে আমাকে কখনো সহায়তা করা হয়নি। এমনকি আমার কোনো খোঁজখবরও নেওয়া হয়নি। অথচ যারা গ্রেনেড হামলার শিকার হয়েছে, প্রত্যেকেরই খোঁজ-খবর নিয়েছে দল, কোনো না কোনোভাবে সহায়তা করেছে। কিন্তু আমি সহায়তা তো দূরের থাক, দলের কোনো নেতার সহানুভূতিও পাইনি। অথচ এখনো কোনো কোনো রাতে প্রচণ্ড ব্যাথায় ঘুমাতে পারি না।
দল সহায়তা না করলেও দলীয় পরিচয়ের কারণে অবশ্য ভুগতে হয়েছে গোলাম মোস্তফাকে। তিনি বলেন, কোনোমতে সুস্থ হওয়ার পর আবার আমার নামে ১৯টি রাজনৈতিক মামলা দেওয়া হয়েছে। র্যাব আমাকে ধরে নিয়ে অত্যাচার করেছে। আমার বাবা সহ্য করতে না পেরে এক পর্যায়ে স্ট্রোক করে মারা গেছেন।
তবে আওয়ামী লীগের রাজনীতি ছাড়েননি গোলাম মোস্তফা। তিনি বলেন, মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত আওয়ামী পরিবারের সঙ্গে থাকব। এখনো আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে দেখি, সামনে যেতে সাহস পাই না। কিন্তু আমি সামনে গিয়ে বলতে চাই— ‘আপা, আপনাকে একটু সালাম করব। আমার জন্য একটু দোয়া করবেন। আমি গ্রেনেড হামলায় আহত সেই গোলাম মোস্তফা।’
এই ইচ্ছাটুকু পূরণ হওয়ার আগ পর্যন্ত যেন মৃত্যু না হয়, সেটুকুই চাওয়া গ্রেনেড হামলায় আহত গোলাম মোস্তফার।