Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চোখের সামনে বিক্রি হতো গ্যাস বেলুন, কিছুই ‘বলত না’ পুলিশ


৩১ অক্টোবর ২০১৯ ১৮:২২

ঢাকা: সিলিন্ডারের গ্যাস বেলুনে ভরে বিক্রি অনেকদিন ধরে নিষিদ্ধ থাকলেও রাজধানীর রূপনগরে শিয়ালবাড়ি-মাতবর বস্তিতে আবু সাঈদ কীভাবে বাচ্চাদের কাছে গ্যাস বেলুন বিক্রি করতেন তা জানতেন না বস্তিবাসী।

সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত ও আহত পরিবারগুলোর দাবি, আবু সাঈদ দীর্ঘদিন ধরে বস্তির বাচ্চাদের কাছে বেলুন বিক্রি করে আসছিলেন। পুলিশ বেলুন বিক্রি করা দেখলেও সাঈদকে কিছুই বলতেন না। আর গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হবে তা কেউ জানতেন না। এমনকি সিলিন্ডার ব্যবহার করে বেলুন বিক্রি যে, নিষিদ্ধ সেটাও বস্তিবাসীর কেউ জানত না বলে দাবি করেন তারা।

বিজ্ঞাপন

তবে পুলিশের দাবি, সিলিন্ডারের মাধ্যমে বেলুনে গ্যাস ভরিয়ে বিক্রির খবর পুলিশের কাছে ছিল না। জানলে বেলুন বিক্রি করতে দেওয়া হতো না। বস্তিতে প্রায়ই এ ধরনের বেলুন বিক্রি হতো। বস্তিবাসীও নিষেধ করেনি কিংবা পুলিশের কাছেও কোনোদিন অভিযোগ করেনি।

বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) রূপনগরের ওই বস্তিতে সরেজমিনে গেলে এসব তথ্য জানা যায়।

রূপনগর ১১ নম্বর সড়কের মাথায় লোহার গেটের কাছে বিকেল ৩টা থেকে বেলুন বিক্রি করছিলেন আবু সাঈদ। এর কয়েক হাত দূরে পিঠা বিক্রি করছিলেন রাশেদা বেগম।

রাশেদা বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘কিছুক্ষণ আগেই বেলুন বিক্রেতা আমার সামনে দিয়ে যায়। প্রায় দিনই এখানে তিনি বেলুন বিক্রি করতেন জেনেই বাচ্চারা বেলুন কিনতে ভিড় করেন। এর কিছুক্ষণ পর প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। চারদিক ধুলো আর ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যায়।’

‘এরপর দেখি কতগুলো বাচ্চা আর মানুষ রাস্তায় পড়ে আছেন। আমার ভাগিনা বউ জান্নাতি (২৫) একটু আগে তার বাচ্চা সুমাইয়াকে (৬) একটি বেলুন কিনে দিয়ে বাজারে যায়। মাছ আর পান কিনে নিয়ে আসছিল। গেটে গিয়ে দেখি জান্নাতি পড়ে আছে। তার হাত হাত উড়ে গেছে আর ডান উড়ুর মাংস আলাদা হয়ে গেছে।’

বিজ্ঞাপন

রাশেদা বেগম বলেন, ‘এ অবস্থা দেখে উপস্থিত লোকদের সহযোগিতা করতে বলি। তারা সহযোগিতার পরিবর্তে মোবাইলে ভিডিও আর ছবি তোলা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। সবাইরে বাবা ডাকতাছি, ভাই ডাকতাছি, একটু ধরেন সহযোগিতা করেন। কিন্তু কেউ ধরল না, কেউ শুনল না। ২০ মিনিট পর পুলিশ আসে। এরপর উদ্ধার কাজ শুরু হয়। বেলুন বিক্রেতা প্রায়ই বেলুন বেঁচত, পুলিশ তো জানতই, কোনোদিন কিছু বলতে শুনিনি।’

রাশেদা বলেন, ‘আট বছরের মিরাজুর রহমান। পাঁচটা বেলুন কিনে ফিরছিল। একটু দূরে সরতেই বিস্ফোরণ ঘটে। আমি ছিটকে পড়ি আরেক জায়গায়। বাম হাতে আঘাত পাই।’

গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের প্রত্যক্ষদর্শী ইসহাক। ঘটনার সময় তিনি পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি দেখছিলাম সিলিন্ডার থেকে চাবি অন করছিলেন আর বেলুন ফুলিয়ে বাচ্চাদের দিচ্ছিলেন আবার চাবি বন্ধ করছিলেন। এক পর্যায়ে একটি বাচ্চা বলে, সিলিন্ডার দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। তখন ধোঁয়া বের হওয়ার স্থানে বেলুন বিক্রেতা পানি দিচ্ছিলেন। এ সময় ভাত যেভাবে বলকায় সেভাবে বলক উঠছিল। তখন বিক্রেতা চাবির গোড়ায় প্লাস দিয়ে বাড়ি দিচ্ছিলেন যেন চাবিটি লেগে যায়। এর কয়েক সেকেন্ড পরেই বিস্ফোরণ ঘটে। আমার কপালে এসে শক্ত একটা কিছু লেগে কেটে যায়। পরে আমি সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিই।’

আবু ইসহাক বলেন, ‘এই জায়গায় আবু সাঈদ বেলুন বিক্রি করত, তা পুলিশ জানত। তবুও কিছু বলতে দেখিনি। পুলিশ কেন কিছু বলত না তাও জানি না। কোনোদিন টাকাও নিতে দেখিনি পুলিশকে।’

৭ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি এস এম শামীম আহমেদ বলেন, ‘লোহার গেটটি খোলা থাকলে এতটা প্রাণহানি ঘটত না। কারণ বিস্ফোরণে সিলিন্ডারটি ছিটকে গিয়ে লোহার গেটে ধাক্কা খেয়ে ঘটনাস্থলে ফিরে আসে। ফলে প্রাণহানির সংখ্যা বেশি ঘটে বলে মনে করি।’

এই সিলিন্ডার বিস্ফোরণের বিষয়ে জানতে চাইলে বিস্ফোরক পরিদফতরের প্রধান পরিদর্শক সামসুল আলম বলেন, ‘এটি আসলে সিলিন্ডার নয়, গ্যাস প্রডিউসিং রিয়েক্টর। গ্যাস সিলিন্ডারকে মডিফাই করে সিলিন্ডারের ভেতরেই হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরি করার পদ্ধতি বানিয়েছে। সিলিন্ডারের ভেতরে কস্টিক সোডা ও অ্যালুমিনিয়াম পাউডার দিয়ে হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরি করতে থাকে। এর সাহায্যে বেলুন ফোলাতে থাকে। এরমধ্যে কিছুক্ষণ ফোলানোর পরে কোনো কাস্টমার না থাকলে সাধারণত সিলিন্ডারের চাবিটি বন্ধ করে রাখে। এই সময়ের মধ্যে হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরি হতে থাকে। এতে সিলিন্ডারের ওপর গ্যাসের চাপ বাড়তে থাকে। আর তাতে ভেতরে ক্ষয় হতে থাকে। এক পর্যায়ে গ্যাসের চাপ বেশি বেড়ে গেলে সিলিন্ডারটি গরম হয়ে নরম হয়ে যায়। এ অবস্থায় যখন আবার বেলুনে গ্যাস ভরার জন্য চাবি খোলা হয়, তখনই বিস্ফোরণ ঘটে।’

বিস্ফোরক পরিদফতরের প্রধান পরিদর্শক সামসুল আলম আরও বলেন, ‘এই ধরনের রিঅ্যাক্টর একেবারে নিষিদ্ধ। এ ধরনের সিলিন্ডার যার কাছে দেখবে, তাকেই পুলিশের ধরা উচিত। পুলিশ প্রশাসনকে আমরা বহুবার চিঠি দিয়ে এ বিষয়ে জানিয়েছি। কিন্তু পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন করছে না।’

তিনি বলেন, ‘আইন অনুযায়ী কোনো কারখানায় হাইড্র্রোজেন তৈরি হলে সিলিন্ডারে ভরে তা সরবরাহ করতে হবে। সিলিন্ডার থেকে বেলুন ফোলাবে। তারা তা না করে সরাসরি সিলিন্ডারের ভেতরেই হাইড্রোজেন তৈরি করে, যা খুবই বিপজ্জনক।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রূপনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বস্তিতে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করে বেলুন বিক্রির খবর পুলিশের কাছে ছিল না। জানতে পারলে আমরা বন্ধ করে দিতাম। এ ব্যাপারে পুলিশকে বলা আছে। যারা বলেছে পুলিশ জেনেও বন্ধ করেনি তা সত্য নয়। আমরা এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিয়েছি। পুলিশ বাদী হয়ে বিস্ফোরক ও হত্যা মামলা করেছে। সেই মামলায় বেলুন বিক্রেতাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।’

আরও পড়ুন

রূপনগরে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ৩ শিশুসহ ৫ জনের মৃত্যু
রূপনগরে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, আহত আরেক শিশুর মৃত্যু
রূপনগরে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, আহত বেলুন বিক্রেতা গ্রেফতার

 

গ্যাস বেলুন গ্যাস সিলিন্ডার বেলুন রূপনগর শিয়ালবাড়ি

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর