৩৬টি ওয়ার্ডে ‘স্যাটেলাইট ফায়ার সার্ভিস স্টেশন’ করবে ডিএনসিসি
১ নভেম্বর ২০১৯ ১০:৪৮
ঢাকা: ২৮ মার্চ, ২০১৯। রাজধানীর বনানীর ১৭ নম্বর রোডের এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বিল্ডিংয়ে থাকা মানুষজন প্রাণের বাঁচার জন্য ছুটে চলছিলেন। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যখন ঘটনাস্থলে গিয়ে কাজ শুরু করে তখন আগুনের মাত্রা আরও বেড়ে গেছে। প্রায় ছয় ঘণ্টা পর আগুন যখন নিয়ন্ত্রণে আসে তখন ঝরে গেছে ২৬টি প্রাণ, আহত ৭০ জনেরও বেশি।
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি ভবনে সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে যখন কাজ শুরু করে তখন সেখানে পানি পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে ফায়ার সার্ভিসের ১৬টি ইউনিটে কাজ করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
পৃথক এ দুই ঘটনাতেই দেখা গেছে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করতে বিলম্ব হওয়াও বেড়েছে হতাহতের সংখ্যা। রাজধানীতে বর্তমানে ২২টি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন কাজ করলেও দেখা যায় ট্র্যাফিক জ্যামের কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঠিক সময় ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারে না। আবার অনেক সময়ে দেখা যায় সরু রাস্তা, পানি সংকটসহ নানা কারণে ঠিক ভাবে কাজ করতে পারেন না ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। এ কারণে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে চালু করতে যাচ্ছে ‘স্যাটেলাইট ফায়ার সার্ভিস স্টেশন’।
ঢাকার ৩৬টি ওয়ার্ডের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্থাপন করা হবে এই স্যাটেলাইট ফায়ার সার্ভিস স্টেশন, যেখানে থাকবে একটি ম্যানেজমেন্ট অফিস। এই স্টেশনের আওতায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের। যারা নিজেদের এলাকায় স্থাপন করা এই অফিসের সাহায্যে অগ্নিকাণ্ডস্থলে নিজেরাই প্রাথমিক ভাবে চেষ্টা করবেন আগুন নিয়ন্ত্রণে রাখার।
স্যাটেলাইট ফায়ার সার্ভিস স্টেশন কি?
কোনো স্থানে যদি আগুন তবে তবে সেখানে দ্রুততার সঙ্গে প্রাথমিক ভাবে আগুন নেভানোর কাজ করবে এই স্যাটেলাইট ফায়ার সার্ভিস স্টেশন। একই সঙ্গে এই সার্ভিসে সংযুক্ত থাকবে ফার্স্ট এইড সার্ভিস যা দুর্ঘটনাস্থলে ক্ষতিগ্রস্থদের সাহায্য করতে পারে। ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের গাড়ি আসার আগেই যাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান কমিয়ে আনা যায় এবং আগুন নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় সেই ব্যবস্থায় করবে এই স্যাটেলাইট ফায়ার সার্ভিস স্টেশন।
এই সার্ভিসে থাকবে ৩০০ লিটার পানিপূর্ণ একটি ২০ ফুটের কনটেইনার, ৫০ মিটারের একটি হোস পাইপসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, অগ্নিনির্বাপক কাজে প্রশিক্ষণ পাওয়া দুইজন কর্মকর্তা, ফাস্ট এইড সার্ভিসসহ অক্সিজেন, অগ্নিনির্বাপক কাজে অংশ নেওয়া কর্মীদের শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ ও একটি মাঝারি আকারের পিকআপ ভ্যান।
স্যাটেলাইট ফায়ার সার্ভিস স্টেশন বিষয়ে ডিএনসিসির পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ড. তারিক বিন ইউসুফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘অনেক দিন ধরেই আমরা পরিকল্পনা করছিলাম এমন একটি সার্ভিসের বিষয়ে। জোন পর্যায়ে আমরা ইতোমধ্যেই ওয়্যারহাউজ করেছি। এর আওতায় আমরা সিটি করপোরেশনের আওতায় থাকা কর্মচারীদের এবং স্থানীয়ভাবে কাজ করতে চাওয়া তরুণদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি ওয়ার্ড পর্যায়ে। জোনাল ভাবে এখন আমাদের একটি করে এমন ওয়্যারহাউজ আছে। প্রতিটি জোনেই আবার আমাদের ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট টিম করা আছে। এছাড়াও ১২টি মডেল কমিউনিটি ডেভেলপ করা হয়েছে। আমরা আশা করছি খুব দ্রুতই এই সার্ভিস চালু করতে পারবো।’
স্যাটেলাইট ফায়ার সার্ভিস স্টেশন ঢাকা শহরে কতটুকু কার্যকর হতে পারে বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘প্রথমত বলতে হয় সুউচ্চ ভবনে নিজস্ব অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা থাকার কারণে ফায়ার ব্রিগেড আসার আগ পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে রাখার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু আমাদের নগরায়নে এখনো সুউচ্চ ভবনের সংখ্যা, পরিমাণ, ক্লাস্টারিং কিছু সুনির্দিষ্ট জায়গায়। ফলে অন্যান্য সকল জায়গায় আগুন দ্রুততম সময়ে নিয়ন্ত্রণ না করলে দেখা যায় মানুষ সর্বস্ব হারাচ্ছে। ফলে এখানে সময়টা একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঢাকা শহরের রাস্তার নিয়ন্ত্রণহীন ট্রাফিক জ্যাম। এইসব কারণে অঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে নেওয়া এই উদ্যোগ সেই সময়ের ফ্যাক্টরটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে। ফলে জান-মালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণ রেখার মধ্যে রাখা যেতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেকোনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তিনটি ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত ফায়ার এলার্ম বা সতর্কীকরণ। দ্বিতীয়ত ইভাকুয়েশন বা আগুনের স্থান থেকে প্রস্থান ও সর্বশেষ হচ্ছে অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ। প্রস্থান নিশ্চিত করা না গেলে উচ্চতর ভবনে আগুন নিরোধ করা সম্ভব না। যেখানে আমাদের দেশে এখন ৪০ তলা ভবনও তৈরি হচ্ছে সেখানে আপনি মই ব্যবহার করে কতক্ষণে নামবেন? এভাবে আদৌ যে আগুন থেকে বাঁচা সম্ভব না যেটা আমরা এফ আর টাওয়ারে দেখেছি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন যে ৩৬টি ওয়ার্ডে ফায়ার সার্ভিস স্যাটেলাইট স্টেশন করার পরিকল্পনা করছে সেখানে নাগরিকদেরই অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এইক্ষেত্রে নাগরিক সচেতনতাও বৃদ্ধি পাবে। এটা একটা ইতিবাচক দিক।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা ডিএনসিসির ৩৬টি ওয়ার্ডে একটি করে স্যাটেলাইট অগ্নিনির্বাপণ স্টেশন স্থাপন করতে যাচ্ছি। সম্প্রতি কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত সি ফোরটি মেয়রদের সম্মেলনে ডিএনসিসি ও কোপেনহেগেনের মধ্যে অগ্নি নির্বাপন বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।’ এর ফলে অল্প সময়ের মধ্যে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হবে বলেও জানান তিনি।